ওয়ানডের রঙিন পোশাকে রাঙানোর অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। সত্যিকার অর্থে রঙ ছড়ালো; মাঠে পারফরমেন্সের রঙ!
সেই উজ্জ্বলতায় জিতল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে। ব্যবধান বেশ বড়সড়, ৪৮ রানের। জেতার জন্য গায়ানার উইকেটে সঞ্চয়টাও বেশ সমৃদ্ধ করেই নামে বাংলাদেশ। স্কোরবোর্ডে রানের সেই পুঁজি সঙ্গে কৃতিত্বপূর্ণ বোলিং এবং অতি অবশ্যই অধিনায়কত্বে মাশরাফি বিন মতুর্জার প্রভাবী উপস্থিতি-এই তিন ফ্যাক্টরের হাত ধরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ এখন ১-০ তে এগিয়ে।
বাংলাদেশের ২৭৯ রানের জবাবে ৯ উইকেটে ২৩১ রানে আটকে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গায়ানার স্লো এবং স্পিন সহায়ক উইকেটে ব্যাটিংয়ের কোন সময় মনে হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই ম্যাচ জিততে পারে। শুরুতে ঠিক যখনই খোলস ছেড়ে বিপদজনক হয়ে উঠছেন ক্রিস গেইল তখনই তাকে রান আউটে ফেরায় বাংলাদেশ। এই উইকেটে বড় স্কোর তাড়া করে জেতার জন্য যে কৌশল, দক্ষতা এবং ধৈর্য্যের প্রয়োজন- সেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং ধাঁচের সঙ্গে যায় না। মিডলঅর্ডারে হেটমায়ের ছাড়া ব্যাটিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আর কোন ব্যাটসম্যান এক অর্থে দাঁড়াতেই পারেননি।
গায়ানায় সার্বিক বিচারে খেলার প্রতিটি বিভাগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দাপুটে ভঙ্গিতেই ওয়ানডে সিরিজ শুরু করল বাংলাদেশ।
ব্যাটিংয়ে তামিমের সেঞ্চুরি, সাকিবের ৯৭ এবং শেষের দিকে মুশফিক রহিমের মাত্র ১১ বলে ৩০ রানের ঝড়ো ইনিংস বাংলাদেশকে প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন দেখায়। আর সুদক্ষ অধিনায়কত্বের সঙ্গে বল হাতে দুরন্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে মাশরাফি ম্যাচ জয়ের সেই স্বপ্নটা সফল করেন। বল হাতে ম্যাচের সেরা পারফর্মার বাংলাদেশ অধিনায়ক। ৩৭ রানে ৪ উইকেট পান তিনি। যে উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলাররা সাফল্যের জন্য মাথা খুঁড়ে হতাশ হন, সেই একই উইকেটে খানিকবাদে মাশরাফি বল হাতে সেরা পারফর্মার!
১০ ওভারে ১ মেডেনসহ মাত্র ৩৭ রানে ৪ উইকেট। শুরুতে এভিন লুইসকে আউট করে ব্রেকথ্রু’টাও তিনিই এনেই দেন। মাঝে জ্যাসন হোল্ডার এবং আন্দ্রো রাসেলও তার শিকার। শেষের দিকে অ্যাসলে নার্সের উইকেট নিয়ে মাশরাফি আরেকবার জানিয়ে দিলেন কেন তাকে এই দলের ক্যারিশমাটিক নেতা বলা হয়!
দলে তার উপস্থিতি মানেই আত্মবিশ্বাসের আলোয় বদলে যাওয়া তেজি বাংলাদেশ। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় এই ওয়ানডে সিরিজে তার খেলতেই আসার কথা নয়। কিন্তু টেস্ট সিরিজে বাজে পারফরমেন্সে নেতিয়ে পড়া দলের মনোবল ফেরানোর তাগিদকেই বেশি অগ্রাধিকার দেন অধিনায়ক। সফরে একটু দেরিতে দলের সঙ্গে যোগ দিলেন। তবে বেশ দ্রুতগতিতেই কিভাবে ঘুরে দাড়াতে হয়। জিততে হয়। হোক না সেটা বিরুদ্ধ পরিবেশ!
বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে জেনেও টসে জিতে গায়ানা প্রভিন্স স্টেডিয়ামে মাশরাফি ব্যাটিং বেছে নেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়েই জানতেন কিছুটা ধীরগতির এই উইকেটে পরে ব্যাটিং করাটা সমস্যার কারণ হতে পারে। তামিমের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে এনামুল এই ম্যাচে ব্যর্থ। তিন বল খেলে শূন্য রানে আউট এনামুল। প্রস্তুতি ম্যাচের সঙ্গে বেশ ভাল একটা মিল রেখেই ফিরলন এই ডানহাতি। ওয়ানডের প্রস্তুতি ম্যাচে ফিরেছিলেন ঠিক ৩ বল খেলে শূন্য রানে। প্রথম ওয়ানডেতেও ঠিকই তাই!
সাকিব-তামিমের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে বাংলাদেশ এই ম্যাচ জেতার আসল পুঁজি পায়। গায়ানার উইকেটের চরিত্র সম্পর্কে ধারণাটা বেশ স্পষ্ঠ ছিল এই দুজনের। তাই শুরুতে কোন ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে শুধুমাত্র এক-দুই রানের দিকে মনোযোগ দেন তারা। হয়তো তাদের এই লম্বা সময়ে এমন কৌশলের ব্যাটিংটা অনেকের কাছে দৃষ্টিনন্দন হতে পারেনি। কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজন বুঝে দুই বন্ধু ধৈর্য্যশীল ভঙ্গিতে দলের রান সামনে বাড়ান।
এমন উইকেটে মেরে কেটে খেলার তেমন সুযোগ নেই। আর তাই শুরুর ব্যাটিংয়ে তারা বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টায় না গিয়ে সিঙ্গেলস নিয়েই স্কোরবোর্ডে জমা বাড়ানোর ঝুঁকিহীন ব্যাটিংয়ের পথে হাঁটেন। তামিম-সাকিবের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে বাংলাদেশ রেকর্ড ২০৭ রান যোগ করে। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুটি ডাবল সেঞ্চুরির জুটি আছে। দুটোতেই এখন সাকিব আল হাসানের নাম যুক্ত। মনে হচ্ছিল দুই বন্ধু একই সঙ্গে এই ম্যাচে সেঞ্চুরির জন্য উৎসব করবেন। কিন্তু ৯৭ রানে সাকিব ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেগস্পিনার বিশুকে সুইপ করার চেষ্টায় ক্যাচ তুলে দিয়ে আউট হলেন। মাত্র তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এই প্রথমবার নার্ভাস নাইন্টিজ থেকে ফিরলেন সাকিব।
তামিম যখন নিজের দশম সেঞ্চুরির উৎসবে ব্যাট তুললেন তখন স্কোরবোর্ডে তার রানের পাশে দেখাচ্ছে ১৪৬ বল। ওয়ানডে ক্রিকেট বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানদের এটা বলের হিসেবে সবচেয়ে ধীরগতির সেঞ্চুরি। তবে সেঞ্চুরির পরপরই দ্রুতগতিতে ১৪ বলে ৩০ রান তুলে রান ও বলের ব্যবধানটা অনেক কমিয়ে আনেন। শেষের দিকে ব্যাট হাতে গায়ানায় ছোটখাটো ঝড় তোলেন তামিম-মুশফিক জুটি। মুশফিক খেলেন পুরোদুস্তর টি-টুয়েন্টি মেজাজে। মাত্র ১১ বলে ৩০ রানের টর্নোডো ইনিংস খেলেন মুশফিক। শেষের তিন ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিংকে অসহায় বানিয়ে দেন এই দুই বাংলাদেশি। ১০,২২ ও ২১Ñ শেষ তিন ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান খরচার চিত্র এটি!
রান তাড়ায় নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজও গায়ানার স্লো উইকেটে ব্যাটিংয়ে শুরু থেকেই হাঁসফাঁস করতে থাকে। দুই ছক্কা ও এক বাউন্ডারিতে ক্রিস গেইল ৬০ বলে ৪০ রান করে সঙ্গী ব্যাটসম্যান হোপের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন। মিডলঅর্ডারে হেটমায়ের যা খানিকটা প্রতিরোধ গড়েন। নিয়মিত বিরতিতেই উইকেট হারাতে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই সঙ্গে আস্কিং রানরেটের চাহিদাও ক্রমশ অসম্ভব অবস্থানে পৌছাতে থাকে। শেষ উইকেট জুটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং কেবল তাদের হারের সময়টা বাড়ায়, ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি।
ম্যাচ যে আরো অনেক আগেই স্বাগতিকদের হাতছাড়া!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২৭৯/৪ (৫০ ওভারে, এনামুল ০, তামিম ১৩০*, সাকিব ৯৭, সাব্বির ৩, মুশফিক ৩০, মাহমুদউল্লাহ ৪*, রাসেল ১/৬২, হোল্ডার ১/৪৭, বিশু ২/৫২)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ২৩১/৯ (৫০ ওভারে, লুইস ১৭, গেইল ৪০, হেটমায়ের ৫২, হোল্ডার ১৭, রাসেল ১৩, বিশু ২৯*, জোফেস ২৯*, মাশরাফি ৪/৩৭, মুস্তাফিজুর ২/৩৫, মিরাজ ১/৩৭, রুবেল ১/৫২)। ফল: বাংলাদেশ ৪৮ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: তামিম ইকবাল।
সিরিজ: বাংলাদেশ ১-০ তে এগিয়ে।
দ্বিতীয় ওয়ানডে: ২৬ জুলাই।