বিজয় পারছেন না ‘বিজয়ী’ হতে!

ক্রিকেট, খেলা

এম.এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 19:47:08

সবার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তার আউটের ধরনগুলো একটু জেনে নেই।

প্রস্তুতি ম্যাচ: তিন বল খেলে শূন্য রানে আউট। প্রস্তুতি আর হলো কোথায়? ব্যাটিংয়ের বাকি সময়টা ম্যাচ দেখেই কাটল। পরে ফিল্ডিংয়ে নেমে শরীর ঠিক রাখার চেষ্টা!

প্রথম ওয়ানডে: তিন বল খেলে এবারও শূন্য রানে আউট। অফস্ট্যাম্পের লাইনে জেসন হোল্ডারের রেগুলার ভঙ্গির একটা আউট সুইং। ইনিংসের শুরুতে এমন ডেলিভারির জন্য তো ওপেনার ব্যাটসম্যান প্রস্তুত থাকবেনই। এনামুলও প্রস্তুত ছিলেন; খোঁচা দিতে! স্লিপে তিনজন ফিল্ডারকে দেখেও কেন পা বাড়িয়ে এমন বলে খোঁচা মারবেন ওপেনার? স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের জমা তখন ১ রানে ১ উইকেট!

সেই ম্যাচে অপর ওপেনার তামিম ইকবাল করলেন অপরাজিত ১৩০ রান।

দ্বিতীয় ওয়ানডে: এবার ভিন্ন পরিকল্পনা। নেমেই ধমাধম মাইর শুরু। কোথায় বল পড়ল, সেদিকে চোখ না দিয়ে সামনে পাওয়া বলকে বেদম পিটুনি। আগের ম্যাচে তাকে আউট করায় জেসন হোল্ডারের উপর ভীষণ রেগেছিলেন যেন! ছক্কা-চারের ঝড়ে শুরুতেই এনামুলের স্কোর মাত্র ৯ বলে ২৩! তবে এসব ক্ষেত্রে যা হবার তাই হল। বেশি আক্রমনাত্মক হতে গিয়ে নিজেই কুপোকাত। প্রতি বলেই চালালে চলে নাকি? আরে ভাই বোলারও তো আপনাকে আউট করতেই বল করছেন, তাই না! ওভারের ছয়টা বলই তো আর লোপ্পা হবে না! হয় ছক্কা, নয় অক্কা-এই স্টাইলের ব্যাটিং করতে গিয়ে এনামুল এই ম্যাচে ৯ বলে ২৩ রান করে যখন ফিরছেন তখন তার স্ট্রাইক রেট ২৫৫.৫৫!

অপরপ্রান্তে চোখে বিস্ময় নিয়ে তামিম ইকবাল তাকিয়ে। তামিমের রান তখন ৮। সেই তামিম ম্যাচে করলেন ৫৪ রান।

তৃতীয় ওয়ানডে: এবার আরেক কৌশল। রক্ষণব্যূহ ধারণ! রানের দরকার নেই। দেখে শুনে সময় কাটাও। বল আসছে। ব্যাট উঁচিয়ে সেটা ছেড়ে দিচ্ছেন এনামুল। হাফভলি বলও এল। সেটাও ডেড ডিফেন্স! ফ্রিহিটও পেলেন। তাতে আবার ক্যাচ দিলেন! খানিকবাদে একেবারে অন্দরমহল ঘরানার ব্যাটিং। পুরোদুস্তুর ঘোমটায় ঢাকা। রান নেই। শুধু ডট বল। এই করতে করতে স্কোরবোর্ডের দিকে চোখ যেতে নিজেই একসময় অস্থির হয়ে উঠলেন। নাহ্, এবার রান করতে হয়; এই চিন্তা আসতেই সামনে পাওয়া পরের বলেই চালালেন। শর্ট বলটা পুল করতে গিয়ে ত্রিশ গজের বৃত্ত পার করতে পারলেন না। সহজ ক্যাচ। যথারীতি আরেকটি ব্যর্থ ইনিংস। এবার তার সঞ্চয় ৩১ বলে ১০ রান!

তামিম ইকবাল তখন ২১ রানে খেলছেন। সেই তামিম ম্যাচে করলেন ১০৩ রান।

তাহলে তিনটি ওয়ানডেতে তিন ধরনের পরীক্ষণই চালিয়েছিলেন এনামুল হক বিজয়। কোনটিতেই সাফল্য এল না। অথচ এই তিন ম্যাচেই উইকেট এমন কোন মাইনফিল্ড ছিল না, যে তাকে পালাতে হবে; বা চোখ বুঝে অন্ধের মতো দৌড়াতে হবে। স্রেফ একজনকে অনুসরণ করলেই পারতেন তিনি-তামিম ইকবাল। ওপেনিংয়ে নেমে এনামুল যখন এমন হাঁসফাস করছেন প্রতি ম্যাচে তখন তামিম ইকবাল কি নিপুণ দক্ষতায় নিজের খেলা সামলে নিচ্ছেন সহজ এক কৌশলে। যার নাম আর কিছু নয়- ধৈর্য্য, সহনশীলতা এবং খাপ খাইয়ে নেয়ার অভ্যাস। এই তিন ম্যাচে তামিম যে দুটো সেঞ্চুরি এবং একটি হাফসেঞ্চুরি পেয়েছেন তার পেছনে কি পরিমান পরিশ্রম এবং নিজেকে বদলে ফেলার মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়েছেন সেটা হয়তো স্কোরবোর্ডে লেখা নেই, কিন্তু ঠিকই লেখা হয়ে গেছে তার ক্রিকেটীয় লগবুকে!

অন্তত প্রথম ম্যাচে তামিমের ইনিংস থেকে সেটা শিখতেও তো পারতেন এনামুল। আচ্ছা তামিমকে না হয় তিনি অনুসরণ করতে পারেননি। তাহলে সাকিব তো ছিলেন। এমন উইকেটে, এমন ম্যাচ পরিস্থিতিতে কেমন ব্যাটিং করতে হয়-সাকিবও সেটা করে দেখিয়েছেন তিন ম্যাচেই। নিজে না পারলেন কাউকে দেখেও তো শেখা যায়! এনামুল তিন ম্যাচের সিরিজে এদের দেখেও শিখতে পারেননি কারন এই দলের অনেক ক্রিকেটার তো ক্রিকেট লগবুকের চেয়ে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে বেশি ওস্তাদ!

সিরিজের প্রথম ম্যাচে এনামুল শূণ্য রানে আউট হওয়ার পর দাবি উঠে যায় পরের ম্যাচে তাকে বাদ দেয়ার। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মতুর্জা সেসময় সাফ জানিয়ে দেনÑ তিন ম্যাচে খেলার জন্যই আনা হয়েছে এনামুলকে। অর্থাৎ সুযোগ দেয়ার যে বিষয়টি সেটি পুরোপুরি দিতে চেয়েছেন অধিনায়ক। যেন বলা না হয়, এক ম্যাচের ব্যর্থতায় তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সিরিজ বাংলাদেশ জিতেছে ঠিকই; কিন্তু নিজের পারফরমেন্স নিয়ে কি এখন অধিনায়কের সামনে দাড়াতে পারবেন এনামুল?

পারবেন না। কারন তিনি পারেননি। বল না দেখে সামনের পায়ে চলে গিয়ে খেলেছেন। মেরে খেলেছেন। আবার ধরে খেলেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সবমিলিয়ে তিন ম্যাচে সাকুল্যে সঞ্চয় ৩৩ রান। টেকনিকেও তো অবশ্যই সমস্যা, মানসিকতায় পিছিয়ে আরো অনেক বেশি। তাই ঠিক কিভাবে নিজের খেলা তৈরি করবেন-সেটাই স্থির করতে পারছেন না এনামুল। এ প্রসঙ্গে জাতীয় দলের এক সাবেক ওপেনার বলছিলেন-‘ওর আউটের ধরন  দেখে মনে হচ্ছে নিজের ওপর রাগ করে ও আউট হয়ে যাচ্ছে!’

২০১৯ সালের বিশ্বকাপের জন্য ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের সঙ্গী খুঁজতে আরেকবার নতুন কোনো খোঁজে নামতেই হচ্ছে তাহলে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে!

২০১২ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলছেন। অভিজ্ঞতায় আছে ৩৭ টি ওয়ানডে। তিন বছরের লম্বা বিরতির পর চলতি জানুয়ারিতে ওয়ানডে দলে ফিরেছেন। তবে এখনো নিজেকে জাতীয় দলে অপরিহার্য করতে পারেননি এই ওপেনার।

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে চলতি বছর জাতীয় দলের হয়ে ৭টি ওয়ানডে খেলেছেন এনামুল। এই সাত ম্যাচে তার রান ৮৮। সর্বোচ্চ ৩৫। ইনিংসের শুরুতে আউট হচ্ছেন। খানিকটা থিতু হওয়ার পর আউট হচ্ছেন। উইকেটে পুরো টিকে যাওয়ার পরও আউট হচ্ছেন।

একটা বিষয় প্রায় পরিষ্কার; তিনি পারছেন না। এনামুল হক বিজয়, ব্যাট হাতে ‘বিজয়ী’ হতে পারছেন না!

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর