২০০৭ থেকে ২০১২। পাঁচ বছর।
এই সময়টাতে শ্রীলঙ্কার অনেক কিছু বদলে গেছে। নিয়ম-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা-নিশ্চয়তা অনেক কিছু।
গৃহযুদ্ধ থামার পর মোবাইল সিম কেনা থেকে হোটেল বুকিং দেওয়া বা রাস্তায় বিদেশি পরিচয়ে বের হওয়া- সবকিছুতে এখন বেশ সহজ স্বাভাবিক একটা ভাব। আগে শ্রীলঙ্কায় পা রাখলে রিপোর্টিং শুরুর আগে সোজা যেতে হতো দেশটির বিদেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত দপ্তরে। সেখানে পাসপোর্টের ফটোকপি, ছবি জমা রেখে সীল-স্বাক্ষরের আলাদা একটা আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে শহরে বেরুতে হতো। শহরের মোড়ে মোড়ে বালির বস্তার ফাঁকে রাইফেলের নল রেখে সেনাবাহিনীর কড়া পাহারা। প্রতিটি প্রবেশ পথে পরিচয় পত্র দেখাতে হতো। গৃহযুদ্ধ থামার পর সেই নিরাপত্তা এখন অনেক ঢিলে। তবে একটা জিনিস সেই আগের মতোই আছে- শ্রীলঙ্কার সৌন্দর্য! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য!
একটু ভুল হলো!
আগের মতো নয়, বরং এই সুন্দরের ছটা আরও রঙ ছড়িয়েছে। ভোর সকালে কলম্বো থেকে ক্যান্ডির ট্রেন যাত্রায় মনকাড়া সেই সৌন্দর্য আরেকবার ছুঁয়ে গেল মন-প্রাণ।
আগেরবার কলম্বো থেকে ক্যান্ডি এসেছিলাম সড়ক পথে। এবার পরিকল্পনা বদলে ভোরের ট্রেনে। আড়াই ঘণ্টার সেই যাত্রাপথ কাটল বিমোহিত মুগ্ধ নয়নে।
সবুজে চোখ পড়লে এমনিতেই চোখ ও মনের সজীবতা বেড়ে যায়। শহর ছাড়িয়ে কলম্বোর ট্রেন গ্রামের পথ ধরতেই সেই সবুজ আরও উজ্জ্বল আরও নির্ভেজাল। বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড়ে নাম না জানা হাজারো গাছ। লতাগুল্ম দুলছে দোলনার ভঙ্গিতে। পেটমোটা অশ্বথ বৃক্ষের ফাঁক গলে লালরঙা বুনো ফুলের ওপর পড়া সূর্যকিরণের ছটায় চোখ ঝলসে যাওয়া সৌন্দর্য! সঙ্গী সাংবাদিক নোমান মোহাম্মদ এই সৌন্দর্যের দার্শনিক একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন- ‘কায়সার ভাই, এই সৌন্দর্য যে মন খারাপ করে দেয়!’
কেন, এতো সুন্দরের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই বিশ্লেষণ কেন?
নোমানের উত্তর- ‘প্রকৃতির সৌন্দর্য যখন ব্যাখ্যাতীতরকম সুন্দর হয়ে যায় তখন তার বিশ্লেষণে এটাই যে সেরা প্রায়োগিক শব্দ!’
পাহাড় ও সবুজে নোমানের দুর্নিবার ভালোবাসা ও আর্কষণের গল্পটা জানা থাকায় তার এই সুন্দরের ব্যাখ্যা শুধু মেনেই নিলাম না, শিরোনামও করলাম!
পাথর কেটে সুরঙ্গ পথের বিশাল টানেলে ট্রেন প্রবেশ করতেই চারধারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’পাশের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আসা ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দের ধরন ও দোলাচলও যেন বদলে গেল। মনে হলো হঠাৎ করে অনেক অশরীরি একযোগে হাসছে! কি আশ্চর্য, সেই হাসির শব্দে কিন্তু মোটেও ভয় ছড়াল না। অ্যাডভেঞ্চার বাড়াল! পুরো শহরের পৌরাণিক ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠল অদ্ভুত শিহরণ জাগানো সেই প্রচন্ডতার শব্দে। পাহাড়ের প্রায় চার-পাঁচ হাজার ফুট ওপর দিয়ে দু’পাশের পাথুরে পথ বেয়ে ট্রেন ছুটছে। উপর থেকে অনেক দূরের নিচের রাস্তাকে দেখাচ্ছে ফিতার মতো। গাড়িগুলো যেন বড় পিঁপড়ার সারি। পুরো ক্যান্ডি শহরটাই সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলো যেন ম্যাচ বক্স। পাহাড়ের গা ঘেঁষে পিচ ঢালা কালো রাস্তা বিশাল লম্বা অলস অজগরের মতো দুপুরের রোদ গায়ে শুষছে!
পরম যত্নে সাজানো গোছানো বৌদ্ধমন্দিরগুলো ঘেরা লতায় পাতায়। গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই শহর বুনো প্রাণীদের অভয়ারণ্য। ক্যান্ডি লেকের পাশে যে হোটেলে উঠেছি তার নাম ক্যান্ডি ভিউ। হোটেলের চারতলা থেকে আশপাশের ‘ভিউ’ দেখে সুন্দরের যত সমর্থক শব্দ আছে, বর্ণনার জন্য খুঁজতে খুঁজতে হয়রান! চারতলা কক্ষের বাইরের দুপাশের পুরোটাই কাচ ঘেরা। সেই কাচের পেছনে পুরোটা জুড়ে আবার গাছ আর গাছ। সবুজের আনন্দে চোখ তৃপ্ত হলো আরেকবার।
সব ভুলে ছবি তোলার হুল্লোড়ে দিনের বাকিটা সময় ক্রিকেটের কথা মনেই রইল না!
অনেক দূরের চিকন আঁকাবাঁকা হ্রদ। চারধারে ঘিরে থাকা সুবজ গাছ। লতাগুল্ম, প্রায় শতাব্দী প্রাচীন সব বৃক্ষরাজি রঙিন প্রজাপতি। গাছের ডাল ধরে টারজানের ভঙ্গিতে দোল খাওয়া দুষ্টু বানরের দল। দূর পাহাড়ের চূড়ায় উড়ে চলা মেঘ। খোলা আকাশের গায়ে ডানা মেলা কালো চিল। বাতাসে ভেসে আসা বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি যেন বাসার ড্রইংরুমের ওয়াইন্ডচেমের নির্মল তরঙ্গ! ঢালু রাস্তায় হঠাৎ শব্দ ছুটিয়ে দৌড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলে লেপ্টে থাকা প্রেমিকজুটির স্বর্গীয় আনন্দময় সময়।
নাহ, ক্যান্ডিতে পা রাখলে যে কেউ কবি হতে বাধ্য!
এই শহরে ক্রিকেট কাভার করতে এসে প্রথমদিনের পুরোটাই কাটল জীবনানন্দের কবিতায় ডুবে!
আগামীকাল থাকছে: গল দুর্গের অ্যাডভেঞ্চারে...