-থাকার জন্য ভালো হোটেল এবং খাওয়ার জন্য ব্যতিক্রমী রেস্টুরেন্ট খুঁজছেন আপনি?
কোনো চিন্তা নেই। মাসুদ পারভেজকে একটা ফোন করুন। সমস্যার সমাধান! শুধু ভালো ক্রিকেট সাংবাদিকই নয়, মাসুদ পারভেজ ভোজনের ব্যাপারেও একেবারে আর্টিস্ট পর্যায়ের! খাওয়া, ভোজন, মেন্যু সেটের দক্ষতায় মাসুদ দারুণ চৌকস। ক্রিকেট নিয়ে রিপোর্টে যেমন চুজি ও পরিশ্রমী। ভোজন আয়োজনেও অমনই ব্যতিক্রমী। কলম্বোর ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফের ঠিকানা তার কাছ থেকে পাওয়া।
২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পর্ব শেষ পাল্লেকেলেতেই। বাংলাদেশ দল আগেভাগেই বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে গেল। আমরা সাংবাদিকরা রয়ে গেলাম। সেমিফাইনাল-ফাইনাল কাভার করে ফিরব। মাঝে একদিন কোনো ম্যাচ নেই। ক্রিকেটহীন সেই দিনেই চলে গেলাম মাসুদের দেওয়া ঠিকানা খুঁজে, কলম্বোর দি ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফেতে।
১২ ফ্লাওয়ার রোড, কলম্বো। আমার হোটেল থেকে ট্যাক্সিতে মিনিট পনের সময় লাগল। লাঞ্চ ওখানেই করব সেই সময় নিয়েই গেলাম।
কলম্বোর আর দশটা ক্যাফে-রেস্টুরেন্টের মতোই প্রবেশদ্বার এবং বাইরে পাতা, কাঠ ও বেতের চেয়ার-টেবিল। তবে বারান্দা টপকে ক্যাফে’র ভেতরের পুরোটা জুড়ে ক্রিকেট আর ক্রিকেট! সিটিং থেকে শুরু করে সাজসজ্জার পুরোটা জুড়েই ক্রিকেটময়! টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেট খেলুড়ে বিভিন্ন দেশের পতাকা ঝুলছে দেয়ালের সঙ্গে। বিভিন্ন সারিতে ঝুলছে স্মারক ক্রিকেট ব্যাট। তাতে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট তারকাদের অটোগ্রাফ। নিউজিল্যান্ড দলের একটা সোয়েটারও চমৎকার শৈল্পিক কায়দায় দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে রাখা হয়েছে। পত্রিকার পাতা কেটে ছবির ফ্রেমে বাঁধাই করা কয়েকটা ম্যাচের রিপোর্টও পড়া গেল।
গর্বের সঙ্গে গ্যাব্রিয়েলা জানালেন-‘এই সব পত্রিকার কাটিং যোগাড় করতে আমার কষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটা পত্রিকা আবার ৫০/৬০ বছর পুরনো।’
গ্যাব্রিয়েলা কলম্বোর এই ব্যতিক্রমী দ্য ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফে’র মালকিন।
কলম্বোর এই জায়গাটা বেশ নামিদামি আবাসিক এলাকা। ক্যাফে’তে এসে গ্যাব্রিয়েলাকে পেলাম না। ক্যাফে ম্যানেজার জানালেন- বস তো বাসায়।
-বাসা কত দূর?
-বেশি দূর না কাছেই।
-আমি কি তাহলে বাসায় যাব? তুমি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে। আচ্ছা তুমি বরং আমাকে টেলিফোনে ধরিয়ে দাও।
টেলিফোনে পরিচয় এবং বৃত্তান্ত শুনে গ্যাব্রিয়েলা ২০ মিনিট সময় চেয়ে বললেন-আমি আসছি। তুমি থাকো।
আমিও এই ফাঁকে লাঞ্চের অর্ডার দেই। মেন্যু হাতে নিয়ে পড়তেই গিয়ে অবাক। এখানেও ক্রিকেট আর ক্রিকেটারে ভরা সব!
ইমরান’স পাকিস্তানি পাম্পকিন। পন্সফোর্ড প্রোন। থম্মো’স থাই। গাভাস্কার’স গ্রিক। সাঙ্গাকারা’স সী ফুড পাস্তা। মাহেলা’স ম্যাটরিসিয়ানা। ডি সিলভা’স কলম্বো বার্গার। শচীন’স সসেজ। গাঙ্গুলি’স গ্রিল। ডেজার্টের তালিকায় মিয়াঁদাদ’স ম্যাঙ্গো ম্যাজিক!
মেনু ঘেঁটে ডিকি বার্ড চিকেন বার্গারে এসে পছন্দ স্থির হলো। সঙ্গে ড্রিঙ্কস লেবুর জুস। দুজনের জন্য দামটা পড়ল লঙ্কান ১৯’শ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২’শ টাকা। খেতে সুস্বাদু। ম্যাকডোনাল্ডসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। খাওয়া শেষ হতেই দেখি পোর্চে থামা গাড়ি থেকে নামলেন এক ভদ্র মহিলা। আরেক দফা পরিচয় পর্ব শেষ হতে পাশের চেয়ারে বসেই গল্প জুড়ে দিলেন গ্যাব্রিয়েলা।
কলম্বোর মতো শহরে এমন ক্রিকেট ক্যাফে চালুর সেই ইতিহাস-গল্পের বাকিটা গ্যাবি’র কণ্ঠেই শোনা যাক-
“আমরা তখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। আমার স্বামী জেমস ছোটখাট একটা ব্যবসা করে। এরমধ্যে হঠাৎ সে বলল- রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করবে।
-এত কিছু থাকতে রেস্টুরেন্ট? সত্যি বলতে কি শুরুতে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। তবে পুরোপুরি অবাক হওয়াটা তখনো বাকি। এরই মধ্যে একবার আমি আর জেমস শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে এসেছিলাম। জেমস আগেও বেশ কয়েকবার এখানে ব্যবসার কাজে এসেছিল। ও যখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শ্রীলঙ্কায় করার কথা বলল- আমি তখন বিস্মিত। থাকি অস্ট্রেলিয়ায়, কিন্তু ব্যবসা শ্রীলঙ্কায়! কেমন যেন আমার কাছে গোলমেলে লাগছিল। জেমস আশ্বস্ত করল- ব্যবসাটা আমাদের অবশ্যই দাঁড়াবে।
প্রশ্ন করলাম- শ্রীলঙ্কায় কেন?
-কারণ এখানকার পর্যটক। এই দেশে প্রচুর পর্যটক আসে। আর গোটা দেশটা ক্রিকেট বলতে এক কথায় পাগল। মজার ব্যাপার হলো জেমস এই পরিকল্পনা করেছিল সেই ১৯৭৫ সালে। আর আমরা কলম্বোতে ক্রিকেট ক্যাফে শুরু করি ১৯৯৬ সালে। যে বছর শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ জিতেছিল। পুরো ক্যাফেতে ক্রিকেটের আবহ রাখতে আমরা দুনিয়ার অনেক জায়গা থেকে ক্রিকেটীয় স্মারক সংগ্রহ করেছি। ক্রিকেট খেলুড়ে প্রায় সব দেশের স্মারকই আছে আমাদের কাছে। ক্যাফে’র বিভিন্ন কর্নারের নামও ঠিক করা হয়েছে ক্রিকেটের সঙ্গে মিল রেখে। আমাদের এখানে অনেক ক্রিকেটার এসে ঘুরে গেছেন। আগ্রহ দেখিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে গেছেন। খাবার মেন্যু আমরা সাজিয়েছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটারদের নামের সঙ্গে মিল রেখে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ক্রিকেটার বা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আইনগত কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। কপিরাইট নিয়েও কোনো জটিলতায় পড়তে হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে। গ্রাহাম গুচ ও মাইক গ্যাটিং এখানে খেতে এসে মেন্যুতে তাদের নাম না দেখে আমাকে অনুরোধ করে তাদের নামে মেন্যু তৈরি করার।”
সাফল্যের গল্পটা বলার সময় গ্যাবি’র চোখেমুখে উজ্জ্বল আভায় খুশির ঝিলিক। পুরো ক্যাফেটা ঘুরে দেখার সময় ব্র্যাডম্যান বার এর প্রবেশের পাশের দেয়ালে একটা পতাকা দেখে আমার বুকও গর্বে আন্দোলিত; পতাকাটা লাল-সবুজ, বাংলাদেশের!
পরের গল্প: তিমি’র সঙ্গে ছবি তোলা!