তিমি’র সঙ্গে ছবি তোলা!

বিবিধ, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 01:01:00

গল ফোর্টে প্রবেশের দুটো পথ। দুটোই সুড়ঙ্গের মতো। একটা দিয়ে আগের দিন দুর্গের ভেতরের চারপাশ ঘুরে এলাম। বিচের ধার ঘেঁষে আরেকটি সুড়ঙ্গ পথ আরেক দিনের আবিষ্কারের জন্য রেখে এলাম। মাঠের ক্রিকেট শুরু হয়ে যাচ্ছে তাই পরদিনের জন্য ওটা জমিয়ে রাখলাম। দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ পথের পাশে কালো সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা-‘মেরিটাইম মিউজিয়াম, গল।’

এই শহরে সপ্তাহখানেকের বেশি থাকতে হবে- কোনো একদিন অবশ্যই সময় বের করা যাবে এই সামুদ্রিক জাদুঘর দেখার জন্য। সমুদ্রের শহরে এসে সামুদ্রিক জাদুঘর না দেখাটা ঠিক হবে না?

-শিপন, চলেন জাদুঘর দেখে আসি।

চ্যানেল টোয়েন্টি-ফোরের ক্যামেরা পার্সন নাসিরুদ্দিন ভূঁইয়া শিপনকে প্রস্তাবটা দিতেই সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ভীষণ বন্ধুবৎসল সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকা শিপন তার ডিজিটাল ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন। শিপনের সেই ক্যামেরা যে কি দারুণ কাজে দিয়েছিল!

নীল তিমির অন্য জগতে নিয়ে গেলেন এম. এম. কায়সার

-কিভাবে? সেটা না’হয় শেষেই বলি!

গল ফোর্টের বিচ ধারের প্রবেশ পথের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আরো খানিকটা হাঁটতেই সামনে একটা অফিস কক্ষ। সামুদ্রিক জাদুঘরটা কোনদিকে জানতে চাইলে হাতের ইশারায় পথ দেখিয়ে দিলেন এক ভদ্রমহিলা।

দুর্গের মূল ফটক পেরিয়ে হাতের বাঁ দিকের দোতালার ঘরটা গলের সামুদ্রিক জাদুঘর। প্রবেশ ফি তিনশ রুপি। মানিব্যাগ থেকে রুপি বের করে টিকিটের জন্য বলতেই কাউন্টারে থাকা লোকটা আমার গলায় ঝুলতে থাকা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ইউ আর মিডিয়া পিপল।’ এখানে আর সাংবাদিকের সুবিধা নিতে ইচ্ছে হলো না। বললাম- সমস্যা নেই, আমরা টিকিট কেটেই ভেতরে যাব।’

ভদ্রলোক শুনলেন না। হাসিমুখে জানালেন- ‘ইটস আওয়ার অনার, ইউ কাম হিয়ার এজ অ্যা ভিজিটর।’

শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প কেন এত উন্নত করেছে সেটা তার এই কথাতেই আরেকবার বোঝা গেল। শুধু গলে নয়, পুরো দেশটাতেই পর্যটকদের মর্যাদা দেওয়া হয় একেবারে প্রথম শ্রেণীর! হোটেলে-শপিংয়ে-ট্যাক্সিতে সবর্ত্রই পর্যটকদের সহায়তায় প্রস্তুত সবাই। গলের সামুদ্রিক জাদুঘরে সেই আতিথিয়েতা মিলল। 

ভেতরে পুরোটা সময় জুড়ে জাদুঘরের তরুণ এক অ্যাটেনডেন্টকে আমাদেরকে সহায়তার জন্য বলা হলো। পরিচয়ে জানলাম তার নাম সুরং।  প্রতিটি কর্নারে, দেয়ালে ও কাঁচের ভেতরে থাকা দ্রব্যাদির ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে সুরং আমাদের পুরো সময়টা উপভোগ্য করে তুলল। 

দোতলার জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি ভারত মহাসাগর। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই সমুদ্রের সুনামির তোড়ে মাতারা, গল এবং কলম্বো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাশের গল স্টেডিয়াম ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যায়। ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। সুরং জানাল, সুনামিতে গলের এই সামুদ্রিক জাদুঘরও পুরোপুরি তলিয়ে গিয়েছিল। পরে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সরকার এই জাদুঘর পুনর্নির্মাণ করে। 

ডাচরা যে জাহাজে চড়ে এই শহরের বন্দরে এসেছিল তার একটি মডেল

কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের সমুদ্রের ঢেউ’র দিকে আরেকবার তাকাতেই পাশে থাকা শিপনের দিকে চোখ ফেরালাম। যা আশঙ্কা করেছিলাম ঠিক তাই। ফিসফিস করে বললাম- শিপন, ঠিক এই মুহূর্তে যদি সুনামি হয়?

-আরে দূর, আপনি কি সব আজেবাজে কথা বলেন!

সুনামি নিয়ে আমাদের আগ্রহ শুনে অ্যাটেনডেন্ট সুরং আমাদের জাদুঘরের আরেকটি কক্ষে নিয়ে গেল। টেবিল-দেয়াল চারধারেই এখানে সুনামি চিত্র। মানচিত্রের আদলে আঁকা।

সুনামি কিভাবে হয়? শুরুর খানিক আগে সমুদ্রের কেমন রূপ থাকে? ভুমিকম্পে সমুদ্রের তলদেশের অবস্থার কি পরিবর্তন হয়? পানির স্তর কতটুকু উপরে উঠে-সবকিছুই চিত্র এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুরংয়ের চমৎকার বর্ণনায় মনে হলো আমরা আছি ভুগোলের ক্লাসে!

পুরো জাদুঘর জুড়ে মাছ ধরার নানান ঐতিহ্যবাহী সরঞ্জামে ভরপুর। মাছ ধরার নৌকাকে শ্রীলঙ্কানরা ‘অরু’ বলে। বাঁশের তৈরি বেশ কিছু নৌকাও দেখলাম। আদলটা প্রায় আমাদের দেশের মতোই। মোটা নারিকেল গাছের খোলসের নৌকাও বিস্ময় ছড়াচ্ছে সামুদ্রিক জাদুঘরে। ষোড়শ’ শতাব্দিতে ডাচরা যে জাহাজে চড়ে এই শহরের বন্দরে এসেছিল তার একটা মডেলও এখানে যত্নে রাখা।

শ্রীলঙ্কায় মাছের কমতি নেই। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মমিও রাখা আছে এখানে বড় বোতলে ও কাঁচের জারে। সামুদ্রিক কচ্ছপের বিলুপ্তপ্রায় পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপ এখন শুধু শ্রীলঙ্কায় পাওয়া যায়। জাদুঘরে লেখা কচ্ছপ কর্নার থেকে নামগুলো টুকে নিলাম- লগারহেড কচ্ছপ। গ্রীন কচ্ছপ। লেদারব্যাক কচ্ছপ। ওলিভ কচ্ছপ। হকবিল কচ্ছপ।

বিশাল আকৃতির একটা গ্রিন কচ্ছপের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেই সুরং এগিয়ে বলল- তোমাকে আরও বড় কিছু দেখাই, এদিকে এসো। ছাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মোটা মোটা হুক দিয়ে আটকানো একটা কঙ্কালের দিকে ঈশারা দিল সুরং।

নারিকেল গাছের খোলসের নৌকা বিস্ময় ছড়াচ্ছে সামুদ্রিক জাদুঘরে

-কিসের কঙ্কাল এটা?

-ব্লু ব্রাইডস হোয়েল।

তিমি! তিমি মাছ!! বিস্ময়ে সরছিল না।

বছর কয়েক আগে কলম্বোর সমুদ্র তীরে এই নীল তিমির মৃতদেহ জোয়ারে ভেসে এসেছিল। প্রাণীবিদ্যা বিভাগের লোকজন তীরের ধারে সেই মাছটিকে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। পরে সেই মাছের কঙ্কাল আলাদা করে গলের জাদুঘরে এনে সংরক্ষিত হয়।

জাদুঘরের কোনো জিনিসে হাত দেওয়া নিষেধ। কিন্তু সুরংয়ের কাছে অনুরোধ করে নির্দেশটা ভাঙ্গলাম। জ্যান্ত তিমিতে হাত ছোঁয়ানোর সৌভাগ্য হয়তো হবে না-অন্তত তিমির কঙ্কাল তো ছুঁয়ে এলাম!

মাথা থেকে লেজের শেষ ভাগের দৈর্ঘ্য ১৩.২ মিটার। মুখে মুখে হিসেব করলাম- ৪৩ ফুটেরও বেশি। হিসেব মেলালাম, আমার উচ্চতার আট জনকে লম্বালম্বি করে রাখলে এই তিমি মাছের সমান হতো! বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি।

হোক না সেটা কঙ্কাল! তিমি তো!

শিপনের ডিজিটাল ক্যামেরা দারুণ কাজে লেগেছিল সেদিন!

 

পরের গল্প : চলন্ত ট্রেনে বিশ্বকাপ আনন্দ!

এ সম্পর্কিত আরও খবর