অবেলায় শুকিয়ে যাওয়া আশার ‘ফুল’, শুভ জন্মদিন!

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 14:51:33

একটু পেছনে ফিরে যাই।

আজ থেকে ১৩ বছর আগে। স্থান-কলম্বোর, তাজসমুদ্র হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিল।

আশরাফুল অমরজ্যোতি ক্লাব, সিদ্ধেশ্বরীর বালুর মাঠের সেই সব দিনগুলো কি মনে আছে?’

আশরাফুল একটু যেন আনমনা হয়ে গেলেন আরে কি বলেন, সেই দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়?’

ঢাকার মৌচাক মোড়ের সিদ্ধেশ্বরীর বালুর মাঠে বলবয় হিসাবে শুরু হয়েছিল আশরাফুলের ক্রিকেট জীবন। চারধারে বাড়ি ঘেরা এই ছোট মাঠটা ছিল দ্বিতীয় বিভাগের দল অমরজ্যোতি ক্লাব প্রাকটিস গ্রাউন্ড। ১৯৯৭ তে অমরজ্যোতি ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে আশরাফুলের অভিষেক। এগিয়ে চলার সেই শুরু। বয়স বারোর কোঠায় আসতেই অনূর্ধ্ব-১৩ জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন নিয়ে ক্যাম্পে নাম লেখালেন।

ক্যাম্পের কোচ ডাকলেন-কি তুমি কি কর? ব্যাটিং নাকি বোলিং?’ কি বলেছিলেন তা এখনো পরিস্কার মনে আছে আশরাফুলের-স্যার আমি লেগস্পিন করি।’
আশরাফুলের হাতে বল তুলে দিলেন কোচ।

-জানেন, আমি সেদিন আমার প্রথম বলেই নেটের ব্যাটসম্যান আউট! বলটা ছিল গুগলি। ব্যাটসম্যান বুঝতেই পারেনি!’

তবে সেদিন নেটে আশরাফুলের সেই সাফল্য পাসমার্ক পায়নি। অনূর্ধ্ব-১৩ দলে তার জায়গা হয়নি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কি সেদিন টের পেয়েছিলেন আশরাফুল। তবে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন কিভাবে ফের জোড়া লাগাতে হয় সেই শিক্ষাটা ক্রিকেট গুরু ওয়াহিদুল গনির কাছ থেকে ভাল শিখেছিলেন আশরাফুল। আর তাই পরের বছর ঠিক অনূর্ধ্ব-১৩ দলে জায়গা করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে কমবয়সী ক্রিকেটার হিসাবে টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলেছেন। দেশের সবচেয়ে কমবয়সী টেস্ট অধিনায়কও হয়েছেন।

২০০১ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে অভিষেক। ওয়ানডেতে তেমন বড় কিছু করার আগেই টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত। সেই বছরই ৮ সেপ্টেম্বর কলম্বোর সিংহলি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসএসসি) জীবনের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আশরাফুল বিশ্বকে চমকে দেন। চামিন্দা ভাস-মুরালিধরনকে বিরুদ্ধে লড়ে ১১৪ রানের ঝলমলো সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কমবয়সী (১৭ বছর ৬১দিন) ক্রিকেটারের সেঞ্চুরির বিশ্বরের্কড ওটা। যে মাঠে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে আশরাফুলের যাত্রা শুরু সেই মাঠেই ২০০৭ সালের ২৫ জুন তার টেস্ট অধিনায়কত্বের শুরু। প্রতিপক্ষও সেই একই।

সিদ্ধেশ্বরীর বালুর মাঠে লেগস্পিন করতে আসা ছেলেটি বাংলাদেশের পঞ্চম টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে টস করতে নামছেন কলম্বোর এসএসসি গ্রাউন্ডে।

-রাজত্ব তো পেলেন, এবার?

আশরাফুল হাসলেন। শব্দহীন সেই হাসি ঠিকই জানান দিল-আমি পারবো। আমাকে পারতেই হবে।’

-আশরাফুল পারেননি!

সত্যটা হলো, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক সময়ের আশার ‘ফুল’ পাপড়ির সুঘ্রাণ ছড়ানোর চেয়ে কাঁটার যন্ত্রণাই দেখলেন বেশি! দোষ অবশ্যই আশরাফুলের। তবে দায় যে আরো অনেকের।

আশরাফুলের কান্না এবং...

২০১৪, জুন মাসের এক বিষন্ন বিকেল।

-আশরাফুলকে আমার অনেক ভালো লাগত। বাবা, ওকি ইচ্ছে করেই এসব করেছে’-টিভি পর্দায় বারবার আশরাফুলের কান্না দেখে আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলের অবাক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই তার সিদ্ধান্ত-বাবা, আমার ওকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না!’

আশরাফুলকে এভাবে কে দেখতে চেয়েছিল? কেউ চায়নি।

কিন্তু জীবন চলার পথে যে লোভের কাঁটা বিছানো অন্ধ গলি থাকে তাতে পথ হারিয়ে সময়ের অনেক আগেই হারিয়ে গেলেন ক্রিকেটার আশরাফুল!

ক্রিকেট মাঠে যে আশরাফুল দেশের মানুষকে আনন্দে ভাসিয়েছিলেন; সেই তিনি এদিন কাঁদলেনও অসীম যন্ত্রণায়। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সব কেলেঙ্কারি কবুল করেন। নিয়ম মেনেই বিসিবি তাকে পাঁচবছর সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করে।

বলা হয়ে থাকে সব দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘবের জন্য সেরা উপায় হলো-সময়। নিষেধাজ্ঞার সেই সময় কাটিয়ে আশরাফুল আবার ক্রিকেট মাঠে ফিরেছেন ২০১৮ সাল থেকে। কিন্তু জাতীয় দলে তার আর ফেরা হলো না।

-ফিরতে পারবেন?

আজ ৩৭ এ পা রাখার প্রথমদিনেও আশরাফুল অবশ্য সেই স্বপ্ন দেখছেন। অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, নির্বাচকদের দূরতম চিন্তায়-পরিকল্পনায়ও আশরাফুলের নাম নেই! ক্রিকেটীয় বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুরভাবেই জানিয়ে দিচ্ছে আশার ‘ফুল’ শুকিয়ে গেছে!

আর শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ পাপড়ি স্মৃতি হিসেবে ডায়েরির পাতায় চলে যায়, টেবিলের ফ্লাওয়ার ভাসে নয়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর