রোলার কোস্টারে উড়ে চলা অদ্ভুতুড়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল ২০১৯

বিবিধ, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-13 16:04:29

এই ফাইনালের বর্ণনাটা সবচেয়ে সুন্দর যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে। একবার ঢেউ উঁচু হচ্ছে। ধরে নিন ওটা নিউজিল্যান্ড। পরক্ষণেই ঢেউ নিচু হচ্ছে। ওটা ইংল্যান্ড। খানিকবাদে আবার উল্টো, ইংল্যান্ড উচুঁতে; নিউজিল্যান্ড নিচুতে।

ঠিক রোলার কোস্টারে চড়া ফাইনাল আর কি!

লর্ডসে আজ থেকে ঠিক একবছর আগের বিশ্বকাপ ফাইনালে এমন দৃশ্যই দেখা গিয়েছিল। একবার নিউজিল্যান্ডের মুখে মৃদু হাসি। টেনশনে ইংল্যান্ড। খানিকবাদে নিউজিল্যান্ড চিন্তাক্লিষ্ট। ইংল্যান্ড সাফল্য ছোঁয়ার অপেক্ষার আনন্দে।

ক্ষণে ক্ষণে রং বদলের সেই ফাইনালের সঙ্গে দারুণভাবে মিলে গিয়েছিল লর্ডসের আবহাওয়াও সেদিন। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। পুরোটা সময় এই হালকা বৃষ্টি ভেজার উল্লাস আবার খানিকবাদেই নরম রোদের সুখ; এমন বিলাসিতাকে গায়ে মেখে লর্ডসের উন্মুক্ত প্রেসবক্সে বসে ক্রিকেটীয় উত্তাপ- এর চেয়ে সুখানন্দ আর কি হতে পারে!

কতবার যে এই ফাইনালের ইন্ট্রো এবং সম্ভাব্য শিরোনাম বদলেছি! ফাইনাল কাভার জন্য ৩৬৬ জন সাংবাদিক আবেদন করেছেন। আর প্রেসবক্সে আসন আছে মাত্র ২৩৭টি। আগের দিনের বিকালে আইসিসি নিশ্চিত করল ফাইনালের ম্যাচ টিকেট আমিও পাচ্ছি। দুর্ভাগ্যবশত দু’তিনজন ছাড়া সব সাংবাদিকদের জন্যই ফাইনাল দেখার ব্যবস্থা করে আইসিসি।

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের নাটকীয় ফাইনালে নিয়ে গেলেন এম. এম. কায়সার

ফাইনালের দুই দল ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের সাংবাদিকরাই ম্যাচ টিকিটের জন্য অগ্রাধিকার পাবেন। আয়োজক ইংল্যান্ড। হট ফেভারিটও ছিল তারাই। খেলছেও ফাইনালে। আর তাই ইংলিশ সাংবাদিকদের ভিড়ে লর্ডসের প্রেসবক্সে আর কারোর যেন পা রাখার উপায় নেই! ভিড়ের মাত্রা এতই বেশি যে, ইংল্যান্ডের সব সাংবাদিকও লর্ডসের মূল প্রেসবক্সে বসার জায়গা পেলেন না। তাই বাধ্য হয়ে বাকি সাংবাদিকদের জন্য ফাইনাল ম্যাচ কাভারে বিকল্প ব্যবস্থা নেয় আইসিসি’র মিডিয়া বিভাগ। প্রেসবক্সের নিচে দু’পাশে উন্মুক্ত জায়গায় বাকি সাংবাদিকদের জায়গা করে দেওয়া হলো। এই জায়গার একটা কেতাবি নামও আছে- ‘ওভার ফ্লো জোন’!

এমন উন্মুক্ত জায়গায় বসে ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করার যেমন আনন্দ আছে, ঠিক আবার তেমন সমস্যাও আছে। পাশেই বসে থাকা দর্শক-সমর্থক প্রতিটি মুহূর্তে চিৎকারে ফেটে পড়ছেন। ইন্টারনেটের গতিও এখানে খানিকটা স্লো।

আমার আসন পড়ল একেবারে নিচ সারিতে। মাঠের সবচেয়ে কাছে। হাত বাড়ালেই বাউন্ডারির দড়ি! লম্বা বেঞ্চ একটি। চারটি চেয়ারে চার জন বসলাম। আমার সিট একেবারে শেষ কর্নারে। শুরুর চেয়ারে পাকিস্তানি এক সাংবাদিক। ভদ্রলোক ফাইনাল দেখলেন। কিন্তু কিছুই লিখলেন না। ল্যাপটপ কাঁধ থেকেই নামালেন না। তবে একটা কাজ বেশ দক্ষতার সঙ্গে করে গেলেন- খাওয়া দাওয়া! দ্বিতীয় চেয়ারে নিউজিল্যান্ডের সাংবাদিক। আর আমার ঠিক পাশেই বসলেন ইংল্যান্ডের রেডিও সাংবাদিক স্টিভ।

নিউজিল্যান্ডের সাফল্যে হাততালি দিচ্ছেন নিউজিল্যান্ড সাংবাদিক। আবার খানিকবাদে ইংল্যান্ড যখন ভালো অবস্থানে তখন স্টিভ হাতে ধরা মোবাইলে অফিসে ধারা বর্ণনার স্টাইলে খবর পাঠাচ্ছেন। আর সেই সঙ্গে মাঠের দর্শকদের ত্রাহি চিৎকারে কানে আঙ্গুল দেওয়ার অবস্থা। এদিকে আবার ইন্টারনেট এই আসে, এই যায়! এমনিতেই এই চতুর্মুখী চাপ, তারওপর মাঠের অদ্ভুতুড়ে নাগরদোলার ক্রিকেট শরীরের রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে তুলল!

লেখকের সেলফিবন্দী ভিন দেশী ক্রীড়া সাংবাদিকরা

বৃষ্টির কারণে টস খানিকটা দেরিতে হলো। নিউজিল্যান্ড জিতল। ব্যাটিং নিল। ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৪১ রান তুলল। জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ড একশ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলল শুরুর চার উইকেট। সঙ্কট কাটিয়ে ইংল্যান্ডকে ফাইনালে ফেরাল বেন স্টোকস ও জস বাটলারের হাফসেঞ্চুরি।

শেষের দিকে এসে আবার নাটক জমল। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের চাই ১৫ রান। ট্রেন্ট বোল্ট বোলার। স্ট্রাইকে বেন স্টোকস। প্রথম দুই বলে কোনো রান হলো না। ৪ বলে চাই ১৫ রান। জয়ের পাল্লা নিউজিল্যান্ডের দিকেই হেলে।

তৃতীয় বল স্লোয়ার দিলেন বোল্ট। হাঁটু গেড়ে মিডউইকেট দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন বেন স্টোকস। জয়ের টার্গেট কমে দাঁড়াল ৩ বলে ৯ রান। চতুর্থ বলে আরও বড় নাটক। মিডউইকেটে শট খেলে দ্বিতীয় রানের জন্য ছুটলেন স্টোকস। বাউন্ডারি লাইন থেকে বল কুঁড়িয়ে উইকেটকিপারের এন্ডে থ্রো ছুঁড়লেন মার্টিন গাপটিল। দূর থেকে একটিপে উইকেট ভাঙ্গতে দারুণ পারঙ্গম নিউজিল্যান্ডের এই ওপেনার। রান পুরো করতে অনেক দূর থেকেই স্বাভাবিক নিয়মেই ডাইভ দেন বেন স্টোকস। বল তার বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাটের কানায় লেগে গতিপথ বদলে ফেলে। উইকেটকিপারের পেছনে থার্ডম্যান অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারির দড়ি পার করে।

- কি হবে এই সিদ্ধান্ত?

দুই আম্পায়ার নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করেন। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে বেন স্টোকস ইচ্ছে করে বল তার ব্যাটে লাগাননি। যা ঘটেছে তার পুরোটাই ক্রিকেটীয় সম্পর্কযুক্ত। বল ব্যাটে লাগার পর বেন স্টোকসও দু’হাত উঁচু করে জানান, এটা অনিচ্ছাকৃত। আম্পায়ার শেষমেষ তাদের সিদ্ধান্তে জানান- এটি ছয় রান হবে। দৌড়ে দুই রান এবং ওভার থ্রোতে বল বাউন্ডারি, সব মিলিয়ে ছয় রান।

আকস্মিক এই ঘটনায় ফাইনালের মোড় সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল ইংল্যান্ডের দিকে। ২ বলে চাই ৩ রান। খুবই সম্ভব ঘটনা!

কিন্তু সেটাই যে সম্ভব হলো না।

লর্ডসের নাটকীয় ফাইনালের মঞ্চে বার্তা২৪.কম

পঞ্চম বলে সিঙ্গেলস নেওয়ার পর প্রায় অসম্ভব দ্বিতীয় রানের জন্যও ছুটলেন আদিল রশিদ। শেষ বলে স্ট্রাইক যাতে বেন স্ট্রোকসের হাতে থাকে, তাই এই ঝুঁকি। কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে গিয়ে আদিল রশিদ সহজেই রান আউট।

শেষ বলে ইংল্যান্ডের জিততে চাই ২ রান।

বোল্টের ফুল টস লংঅনের দিকে হাঁকালেন স্টোকস। প্রথম রান হলো ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয় রান পুরো হলো না। বোলিং এন্ডে উড়ে আসা থ্রোতে মার্ক উড রান আউট।

৫০ ওভারের ম্যাচ টাই!

ট্রফি কার- সেই হিসেব মেটানোর জন্য চাই সুপার ওভার। কে জানত- রোলার কোস্টারে চড়ে বসা এই বিশ্বকাপ ফাইনালের সুপার ওভারেও যে আরো বড় নাটক অপেক্ষা করছে!

বেন স্টোকস ও জস বাটলার সুপার ওভারে ১৫ রান করেন। ট্রফি জিততে হলে নিউজিল্যান্ডকে করতে হবে ১৬ রান। সুপার ওভারে জয়ের পথেই ছিল নিউজিল্যান্ড। মার্টিন গাপটিলের সঙ্গে নামলেন জিমি নিশাম। বোলার জোফরা আর্চার।

প্রথম বল ওয়াইড। ১ রান যোগ। বৈধ প্রথম বলে জিমি নিশাম দুই রান নিলেন। দ্বিতীয় বলেই ছক্কা! তৃতীয় বলে মিডউইকেটে ঠেলে আবারও দুই রান। চতুর্থ বলেও দুই রান যোগ। পঞ্চম বলে পুল শট খেললেন, কিন্তু এক রানের বেশি নিতে পারলেন না। সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের রান তখন ১৪।

উন্মুক্ত প্রেসবক্সে ফাইনাল ম্যাচের আনন্দ উপভোগ - ছবি তুলেছেন তারেক মাহমুদ (প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক)

শেষ বলে ২ রান নিলেই বিশ্বকাপ ট্রফি নিউজিল্যান্ডের। স্ট্রাইকে মারটিন গাপটিল। অনেকক্ষণ পরামর্শ করে জোফরা আর্চার শেষ বলটা করলেন। গাপটিল মিডউইকেটে বল হাঁকালেন। প্রথম রান নিলেন। দ্বিতীয় রানের জন্যও ছুটলেন। কিন্তু থ্রো’টা হলো দুর্দান্ত। উইকেটকিপার জস বাটলার বল ধরেই স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দিলেন। গাপটিল ডাইভ দিলেন। কিন্তু তখনো পপিং ক্রিজ থেকে তার ব্যাট বেশ দূরে। পরিষ্কার আউট!

ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা তখন নাচানাচি করছে। আর হাঁটু গেড়ে স্থবির হয়ে বসে আছেন গাপটিল।

স্কোরবোর্ডে সুপার ওভারেও উভয় দলের রান সমান, ১৫। ৫০ ওভারের পর সুপার ওভারেও ম্যাচ টাই। কিন্তু ম্যাচে বাউন্ডারি বেশি হাঁকানোর নিয়মের সূত্রে বিশ্বকাপ ট্রফি ইংল্যান্ডের।

স্কোরকার্ডে লেখা ম্যাচ টাই। কিন্তু আইন জানাচ্ছে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন!

এ সম্পর্কিত আরও খবর