রাজশাহীতে আত্মীয়-স্বজন থাকলে দেশের অন্য স্থানের স্বজনরা আম পাঠানোর বায়না ধরেন। আবার না চাইলেও বাগান থেকে আম নামানোর পর রাজশাহীর বাসিন্দারা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আম পাঠান। কিন্তু রাজশাহীতে যাঁদের আত্মীয়-স্বজন নেই, তাঁদের জন্য অনলাইনই হয়ে উঠেছে ভরসা। অনলাইনে অর্ডার দিলেই কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে যায় রাজশাহীর আম। কিছু আম যাচ্ছে ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনেও।
কৃষি বিভাগ বলছে, ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর থেকেই অনলাইনের মাধ্যমে রাজশাহীর আম বিক্রি শুরু হয়েছে। আমের মৌসুমে গত পাঁচবছর থেকে এটি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণরাই মাস তিনেকের জন্য এই পেশা বেছে নেন। কেউ কেউ ওয়েবসাইট খুলে আবার কেউ শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার চালিয়েই আমের বাজার তৈরি করেছেন। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫০০ জন ব্যক্তি অনলাইনে আমের অর্ডার নিচ্ছেন। সময়মত তাঁরা আমও পাঠাচ্ছেন। আমের মান কিংবা অন্য কোনভাবে ক্রেতারা প্রতারিত হয়েছেন বলে কোন অভিযোগ পায়নি কৃষি বিভাগ।
‘রাজশাহী এক্সপ্রেস’ নামের একটি ওয়েবসাইটে ঢুকলেই আম বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। গোপালভোগ, হিমসাগর আর লক্ষণভোগ আমে ঠাসা ওয়েবসাইটটি। ফেসবুকেও দেখা যাচ্ছে অসংখ্য আম বিক্রির পেজ।
রাজশাহী মহানগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা সারোয়ার হোসেনও একটি পেজ পরিচালনা করেন। তিনি জানান, দু’বছর ধরে তিনি আমের মৌসুমে অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে আম পাঠাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫০ মণ আম পাঠিয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি পাঠিয়েছেন গোপালভোগ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের নানা প্রান্তে গেছে এসব আম।
রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম (৩০) ‘অনলাইন ম্যাঙ্গো শপ’ নামে ফেসবুকে পেজ খুলেছেন। তাঁর ব্যস্ততা এখন চরমে। প্রতিনিয়ত আমের অর্ডার আসছে। বাগান থেকে আম সংগ্রহ, ক্যারেটে ভরা, কুরিয়ার সার্ভিসে পৌঁছে দেয়াসহ সকল কাজই করছেন নিজে উপস্থিত থেকে। একের পর এক অর্ডার নিতে সব সময় কাছেই থাকছে ল্যাপটপ। বাগান মালিক আম নামান, রাশেদুল বাগানে বসেই ক্রেতাদের আম পাড়ার ছবি দেখান। ল্যাপটপে চোখ রেখে অর্ডার নেন। ২০১২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করা রাশেদুলের কাছে ক্রেতার সন্তুষ্টির মাধ্যমে নিজের সুনাম অর্জনটাই বড় কথা।
রাশেদুল জানান, এবার জেলা প্রশাসন গোপালভোগ আম নামানোর তারিখ নির্ধারণ করে দেয় ২০ মে। কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ- তখনও গোপালভোগ গাছে পরিপক্ক হয়নি। তাই তিনি অর্ডার নিলেও একটি আমও পাঠাননি। যাঁরা আম নেয়ার জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠান, সবাইকেই ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের একটি গ্রুপে যুক্ত করেন। গাছের পরিপক্ক আম পেতে অপেক্ষা করতে বলেন। রাশেদুল গত ১ জুন প্রথম ক্রেতাদের কাছে গোপালভোগ আম পাঠান।
রাশেদুল বলেন, ‘যাঁরা নতুন নতুন এ ব্যবসায় আসছেন তাঁরা কোনকিছু না বুঝেই আম পাঠাচ্ছেন। অনেক সময় অপরিপক্ক আম পাঠাচ্ছেন। ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর পরই আমে পচন ধরছে। এতে দুর্নাম হচ্ছে। তাই আমি গাছে পাকা আমই পাঠাচ্ছি। এ জন্য অপেক্ষা করেছি। আর ক্রেতারাও বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তাঁরা ভাল আম পেয়েছেন। তাঁরা আগামী বছরও আমার কাছ থেকে আম নেবেন। এটাই আমার প্রাপ্তি।’
তিনি বলেন, ‘আমি কিছুটা দেরি করেই আম নেব। শুরুতে বাজারে যে দাম থাকবে, তার চেয়ে মণপ্রতি ২০০ টাকা বেশিই দেব। কিন্তু পরিপক্ক আম নামিয়ে পাঠাবো। বাগান মালিকেরাও এতে আপত্তি করেননি। ফলে আমি ভাল আম পাঠাতে পারছি।’
সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষ করে রাশেদুল গত সাত বছর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। কিন্তু চাকরির পাশাপাশি প্রতিবছর আমের মৌসুমে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে আম পাঠাতেন। গতবছর এক চালানেই তিনি ৩ হাজার ৬০০ কেজি আম পাঠান। কিন্তু শ্রমিকেরা ভুল ভাবে প্যাকেজিং করেছিলেন বলে ১ হাজার ৩৬০ কেজি আম নষ্ট হয়ে যায়। এবার আমের ব্যবসা ভালোভাবে করতে গত এপ্রিলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সর্বশেষ তিনি একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
রাশেদুল বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আমাকে বলল যে কোন একদিক করতে হবে। আমি ব্যবসাটাকেই বেছে নিলাম। কারণ, আমি উদ্যোক্তা হতে চাই। খুব ভাল সাড়াও পেয়েছি। আর কয়দিন পর প্রতিদিন আমি অন্তত দুই টন করে আম পাঠাব। এখন সব আম পাঠাচ্ছি ইউএসবি এক্সপ্রেস কুরিয়ার ও পার্সেল সার্ভিসের মাধ্যমে। ইউএসবি কম খরচে একদিনেই ঢাকায় আম পৌঁছে দিচ্ছে।’
এদিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বলিহার গ্রামের সৌমেন মণ্ডল অনলাইনে বড় একটি বাজার তৈরি করেছেন টানা ১০ বছরের পরিশ্রমে। অনলাইনে তাঁর ফেসবুক পেজের নাম ‘অনিমা আম বাজার’। সৌমেনের ক্রেতাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা। প্রতিবছরই তাঁর ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে।
সৌমেন জানান, প্রথম কয়েকবছর তিনি গাছে আম আসার পরই ঢাকায় গিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়গুলোতে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন, অর্ডার দিলেই তিনি নিজের বাগানের আম পাঠাবেন। তখন দিয়ে আসেন তাঁর কার্ড। এরপর থেকে তাঁর আমের অর্ডার আসতে থাকে। একজনের কাছে জেনে এখন আরও অনেকে মানুষ সৌমেনের মোবাইল নম্বর নেন। আমের অর্ডার দেন।
সৌমেন আরও জানান, তাঁদের আট বিঘার আমবাগান আছে। ক্রেতাদের কাছে মোবাইল নম্বর আছে বলে গাছে মুকুল আসার পরই তাঁরা হটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেন। গাছে কেমন মুকুল এসেছে তা দেখেন। আমে গুটি ধরা থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝেই তাঁরা দেখেন। আমে কোন কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে কিনা, দিলে সেটা কোন পর্যায়ে সবই তাঁরা খোঁজ নেন। তাঁরা নিশ্চিত হন, এই আম নিরাপদ। তারপর যখন আম নামানোর সময় হয় সৌমেন এসএমএস দিয়ে জানিয়ে দেন। তারপরই অর্ডার আসতে থাকে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চলে আসে আগাম টাকাও।
তিনি বলেন, অনলাইনে আমের ব্যবসার জন্য প্রয়োজন সততার মাধ্যমে ক্রেতার আস্থা অর্জন। টানা ১০ বছরের পরিশ্রমে তিনি সেটি অর্জন করেছেন। এখন ব্যবসা ভাল চলছে। চলতি মৌসুমে তিনি ১২০ ক্যারেট আম পাঠিয়েছেন। প্রতি ক্যারেটে ছিল ২০ কেজি আম। গোপালভোগ আমের দাম মণপ্রতি ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। তিনি ইউএসবি এক্সপ্রেস পার্সেল ও কুরিয়ার সার্ভিস এবং জননী কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম পাঠান। মণপ্রতি আম পাঠানোর খরচ ৪০০ টাকা। এই খরচও ক্রেতাদের। অনলাইনে আম পাঠালে মণপ্রতি তাঁর ২০০ টাকা বেশি লাভ থাকে।
রাজশাহী জেলা কৃষি কর্মকর্তা কে জে এম আবদুল আউয়াল জানান, জেলায় এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। এ বছর হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। আমের উৎপাদনও ভাল হয়েছে। এ পর্যন্ত নানা জাতের গুটি ছাড়াও খিরসাপাত বা হিমসাগর, গোপালভোগ ও লক্ষণভোগ বা লখনা আম উঠেছে। আরও কিছু আম উঠতে বাকি।
তিনি বলেন, করোনাকালেও দূর-দূরান্তে আম পাঠানোর জন্য গাড়ি চলছে। কিন্তু খুচরা বাজারে করোনার প্রভাব আছে। অনেকে হাটে-বাজারে এখন যেতে চাচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে রাজশাহী থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে আম পাঠানোটা একটা ভালো দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনে আম পাঠানোর সুযোগ হওয়ায় ভাল হয়েছে।