মোবাইল ফোন ব্যবহারে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছেই না। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। এতে গ্রাহকরা যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন । কথা বলার সময় গত ১২ মাসে ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল কেটে যাওয়ার (কল ড্রপ) শিকার হয়েছেন দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকেরা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এতে মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের প্রায় ১৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কল ড্রপ তখনই ঘটে যখন কোনও মোবাইল ফোন অপারেটরের সিগন্যাল দুর্বল থাকে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক টেলিকম পরিষেবার গুণমান মূল্যায়নের জন্য গঠিত কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্রাহকরা ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল ড্রপের শিকার হয়েছেন। কল ড্রপ হলে গ্রাহককে ফ্রি টকটাইম দেওয়ার কথা মোবাইল ফোন অপারেটরদের। কিন্তু টেলিকম কোম্পানিগুলো তা দিচ্ছে না। এর মাধ্যমে তারা কমিশনের ২০১৬ সালের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপারেটররা প্রতি তিন থেকে সাত মিনিটের কল ড্রপের জন্য গ্রাহককে এক মিনিট ফ্রি টকটাইম দিচ্ছেন। সে হিসেবে গ্রাহকের টাকার মাত্র ২২ শতাংশ পরিশোধ করেছে মোবাইল ফোন অপারেটররা। এর মানে হল ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল ড্রপের জন্য মাত্র ১১ দশমিক ৬৬ কোটি মিনিট গ্রাহককে ফ্রি টকটাইম দিয়েছেন তারা। এতে গ্রাহকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। যদি প্রতি মিনিটের সর্বনিম্ন কলচার্জ ০.৪৫ পয়সা ধরা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গ্রাহকরা একই নেটওয়ার্কে ৩৭ দশমিক ৬ কোটি মিনিট কল ড্রপের শিকার হয়েছেন, যা অন-নেট কল নামে পরিচিত। এবং অন্যান্য নেটওয়ার্কে ১৪ দশমিক ৯৯ কোটি মিনিট, যা অফ-নেট কল নামে পরিচিত। প্রতিবেদন অনুসারে, অপারেটররা গ্রাহকদের অন-নেট কলের জন্য শুধুমাত্র কল ড্রপের অর্থ পরিশোধ করেছেন।
বিটিআরসি কল ড্রপের প্রধান কারণ হিসেবে মোবাইল অপারেটরদের ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে তাদের টাওয়ার সংযোগ করার ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে।
শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন প্রযুক্তিগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করে বিটিআরসিকে গত অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসের অফ-নেট কল ড্রপের ডেটা সরবরাহ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবের কারণে কোনও তথ্য দিতে পারেনি।
গ্রামীণফোন এখনও পর্যন্ত তার বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনের (বিটিএস) মাত্র ১২ শতাংশ ফাইবার অপটিক ক্যাবলে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। রবি ১৮ শতাংশ এবং বাংলালিংক ১৩ শতাংশ করতে সক্ষম হয়েছে।
টেলিটক কমিটিকে জানিয়েছে, তাদের ৬০ শতাংশ টাওয়ার ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে গ্রাহকদের তাদের প্রাপ্য মিনিটের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অপারেটরদের। এর জন্য মিনিটের কোনও উচ্চসীমা নির্ধারণ করা যাবে না। কল ড্রপের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহকদের টক-টাইম ফেরত দিতে হবে এবং তাদের এসএমএসের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। সভায় গ্রাহকরা এই টকটাইম ব্যবহার করার জন্য ৩০ দিন সময় পাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় আরও বলা হয়, টেলিটক তিন মাসের মধ্যে কল ড্রপের ডেটা সংগ্রহের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম সম্প্রতি বলেছেন, আমাদের আন্তরিক এবং নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কল ড্রপের ঘটনা ঘটেছে। যা টেলিযোগাযোগ খাতের একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য। তবে, আমরা গ্রাহকদের কল ড্রপের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করি।
বিটিআরসির কোয়ালিটি অব সার্ভিস প্যারামিটার অনুসারে, ২ শতাংশ কল ড্রপ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে গ্রহণযোগ্য, যা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের মানদণ্ডের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলমের মতে, গত এক বছরে রবির কল ড্রপ মোট কলের ০.৭ শতাংশ থেকে ০.৮ শতাংশ।
বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটির প্রধান অঙ্কিত সুরেকা বলেন, বিটিআরসি কল ড্রপের জন্য ফ্রি টকটাইম চালুর আগেই আমরা গ্রাহকদের টকটাইম দিয়েছি। আমাদের এ ব্যবস্থা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কমিটিকে নিয়মিত রিপোর্ট করছি।
তবে গ্রামীণফোন এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
মোবাইল অপারেটরদের ন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ বলেছেন, লিফট, উঁচু ভবন, ভ্রমণের সময় বা আবহাওয়া খারাপ থাকলে কল ড্রপ হতে পারে।
তিনি জানান, এখন থেকে মোবাইল অপারেটররা সম্প্রতি কেনা স্পেকট্রাম ব্যবহার করবে। এর ফলে কল ড্রপের সমস্যা দূর হবে বলে তিনি মনে করছেন।