টেলিকম খাতের কর ব্যবস্থা ও ইকোসিস্টেম ব্যবসা-বান্ধব করার আহ্বান জানিয়েছে এই খাতের নীতি-নির্ধারক ও প্রতিনিধিরা। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ খাত সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শ দেন তারা।
বুধবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর একটি হোটেলে এমটব (অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের) ও বিআইজিএফ (বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভরনেন্স ফোরাম) আয়োজিত টেলিকম ট্যাক্স পলিসি ও ইকোসিস্টেম নিয়ে এক পলিসি ডায়লগে বক্তারা এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন বিআইজিএফের চেয়ারপারসন ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হাসানুল হক ইনু, এমপি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের তরুণরা এখন ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা করছে। ডিজিটাল কানেক্টিভিটির অনেক সুবিধা রয়েছে। এ বিষয়ে আমি একমত যে উচ্চ কর দীর্ঘদিন ধরে একটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, আমরা এনবিআরের কাছে টেলিযোগাযোগ খাতে উচ্চ করের প্রভাবের বিষয়টি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। আমাদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে চিন্তা করতে হবে, যেখানে যৌক্তিক হারে কর নির্ধারণের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
হাসানুল হক ইনু বলেন, বাংলাদেশে টেলিকম খাতে কর খুব বেশি। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কোষাগারে অনেক অর্থ দিচ্ছে, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কেন? ট্যাক্স কমানো হলে সরকারের কোন ক্ষতি নেই, কারণ এতে পরোক্ষভাবে সরকারের আয় বাড়ে। মোবাইল খাতে করপোরেট ও ন্যূনতম টার্নওভার কর কমিয়ে অন্যান্য শিল্প খাতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা উচিত।
হাসানুল হক ইনু আরও বলেন, তামাক খাতের মতো ক্ষতিকর খাতে টার্নওভার ট্যাক্স যেখানে ১% সেখানে মোবাইল শিল্পে এই ট্যাক্স ২%, যা অবিবেচনাপ্রসূত। এটা ১% এর নিচে নামিয়ে আনা দরকার।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ওপর যে ভ্যাট রয়েছে তা তুলে দেওয়া দরকার। সরকার এ থেকে কতই বা আয় করে? আধুনিক জীবনে তথ্য সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি এবং মোবাইল খাত হলো এই তথ্য আদান প্রদানসহ সকল ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধানতম বাহন। গ্রাহকদের সেবা প্রদানের কথা বিবেচনায় রেখে এই খাতকে আরও কীভাবে জনবান্ধব করা যায় তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান তিনি।
পলিসি ডায়ালগে টেলিকম করনীতি ও টেলিকম ইকোসিস্টেম নিয়ে দুইটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার শাহেদ আলম এবং এরিকসনের মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, শ্রীলংকার হেড অব নেটওয়ার্ক সল্যুশন এবং এরিকসন বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার আবদুস সালাম।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. খলিলুর রহমান বলেন, টেলিকম খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি মনে করি, কিছু কর যৌক্তিক করা দরকার। ট্যাক্স সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে প্রান্তিক গ্রাহকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি এনবিআরের সাথে আলোচনা করব।
বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, দেশ বিদেশের সকল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যেন সঠিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুসরণ করেই তাদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। টেলিকম খাত শুধু সেবা প্রদানই নয়, দেশের প্রবৃদ্ধিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের ইতিবাচক মনোভাব সবসময়ই বজায় থাকবে। তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই আমরা বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।
রবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিএফও এম. রিয়াজ রাশিদ বলেন, মার্কেটে যত বেশি প্লেয়ার থাকবে অপারেটরদের কাজের দক্ষতা তত বেশি কমবে। আর শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়বে গ্রাহকদের উপর, কারণ এতে সেবা প্রদানের ব্যয় বেড়ে যায়। তিনি বিষয়টির উপর নজর দেওয়ার জন্য নীতি নির্ধারকদের মনোযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন।
মূল প্রবন্ধে শাহেদ আলম বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মোবাইল খাতের কর তুলনামূলকভাবে বেশি।তিনি আরও বলেন, অপারেটরদের বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন সন্তোষজনক নয়। একদিকে অপারেটরদের গ্রাহকপ্রতি গড় আয় কম অন্যদিকে মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। আমরা আরও নতুন ধরনের সাশ্রয়ী সেবা প্রদান করতে চাই। কিন্তু সেবাদাতাদের যদি করের ভারে জর্জরিত করা হয় তাহলে তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যায়। আমরা এই খাতে যৌক্তিক হারে করারোপের দাবি জানাই। আমাদের মনে রাখা দরকার যে দেশের ৪৫ শতাংশ লোক নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও এখনও মোবাইল ব্যবহার করতে পারে না।
প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় আবদুস সালাম বলেন, দেশের নেটওয়ার্ক ক্রমশই বিকশিত হচ্ছে, পাশাপাশি নানা রকম সেবাও আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অটোমেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিং ইত্যাদি আমাদের এন্ড-টু-এন্ড সেবা প্রদানকে সহজ করে তুলছে। বাংলাদেশের টেলিকম ইকোসিস্টেমে অনেক বেশি সংখ্যক প্লেয়ার বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন নিয়ন্ত্রক, এমএনও, এনটিটিএন, টাওয়ারকো, গেটওয়ে প্রদানকারী, অ্যাকাডেমিয়া, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি ও আরও অনেকে। এদের যে কোন একটিকেও বাদ দিলে এই খাতের বিকাশ সম্ভব হবে না। ভবিষ্যৎ নেটওয়ার্ক ও সেবার জন্য সরকার এই শিল্পের সবার সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা বাংলাদেশে এই ইকোসিস্টেমের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান, সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' রূপকল্প বাস্তবায়নে টেলিকম অপারেটররা প্রধানতম সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। করের ভার এবং অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জে থাকা সত্ত্বেও আমরা কোটি কোটি গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছি। আমরা সরকারের ভ্যাকসিন এবং বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পেরে গর্বিত। এখনও অনেক পথ যেতে হবে, কিন্তু আমরা জেনে খুশি যে সরকার লং ডিসট্যান্স টেলিকম নীতি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এটি আমাদের আরও উৎকৃষ্ট সেবা দিতে সাহায্য করবে।
এ নিয়ে গ্রামীণফোনের অ্যাক্টিং সিসিএও হোসেন সাদাত বলেন, আমরা উচ্চ কর সমস্যা সমাধানের জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রতি বছর বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আমাদের খুব শিগগিরই টেলিকম খাতের ট্যাক্স ব্যবস্থার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের অযৌক্তিক করের বৈষম্য দূর করতে হবে। ভালো ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে করের পরিমাণ কম হওয়া উচিৎ।তৃণমূল স্তরে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য, আমাদের কর যৌক্তিকীকরণ করতে হবে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জুয়েল, রবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিএফও এম. রিয়াজ রাশিদ, ফাইবার এট হোমের চিফ টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সফলভাবে শেষ করার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.)।