পৃথিবীতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে নতুন শক্তির উৎসের গবেষণায় পারমাণবিক প্রযুক্তির পর যুক্ত হচ্ছে যাচ্ছে নকল সূর্য।
অ্যামাজনের উদ্যোক্তা জেফ বেজোসের হাত ধরে আসতে যাচ্ছে এই প্রযুক্তি বলে জানিয়েছে বিবিসি।সংবাদ সংস্থাটি জানায় বিদ্যুতের অসীম উৎস ফিউশন নিয়ে এমন গবেষণার আশা করছেন তারা।
ফিউশন পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি আহরণের ধারনা অনেক পুরোনো। তেল নির্ভর অর্থনীতি এই উদ্যোগে ঢিলেমি আনলেও গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে অনেকে চেষ্টা করছেন অসীম শক্তির এ উৎসের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে।
জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যহারের নেশা পুরো মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এটিও সত্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শক্তির এ নোংরা উৎসকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়ার মতো উপায় ও ইচ্ছার কোনওটিই মানুষের নেই।
সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুকল থেকে শুরু করে বিদ্যুতের নানান সবুজ উৎস হাতে থাকলেও গ্রাহক পর্যায়ে অভ্যস্ততা পৌঁছাতে এখনও অনেক সময় লাগছে। এর মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী প্রস্তাব দিয়েছেন সূর্যের ফিউশন প্রক্রিয়া নকল করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তাদের যুক্তি একবার নিউক্লিয়ার ফিউশন থেকে শক্তি উৎপাদন শুরু হলে আর চিন্তা নেই। হাইড্রোজেনের তো আর ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আর ফিউশনে কোনও প্রকার কার্বন নির্গমনের সমস্যা নেই। পুরোটাই পরিবেশবান্ধব যাকে ক্লিনা বা পরিচ্ছন্ন শক্তি বলা চলে।
সম্ভাবনা অনেক হলেও নিউক্লিয়ার ফিউশন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি সবসময়েই ৩০ বছর পিছিয়ে ছিল। এর প্রধান কারণ উন্নত দেশগুলোর অনিচ্ছা ও প্রযুক্তির অভাব।
যে প্রক্রিয়ায় ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে কাগজে কলমে এমন পদ্ধতিতে ‘আয় থেকে ব্যয় বেশি’। অর্থাৎ যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে তা ব্যয় করা শক্তির চেয়ে কম।
তবে আশার বিষয় হচ্ছে বেসরকারি খাতে নতুন কয়েকটি পদ্ধতি সম্ভাবনা দেখিয়েছে। অনেকেই আশাবাদী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো সম্ভব হবে।
নিউক্লিয়ার ফিউশন হচ্ছে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসকে এক করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে জ্বালানি হিসেবে সাধারণত হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম।
ডিউটেরিয়ামে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন থাকে, ট্রিটিয়ামে একটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন থাকে। এ দুই আইসোটোপকে প্রবল চাপে একীভূত করা হলে হিলিয়াম তৈরি হয় এবং প্রচুর শক্তি নির্গত হয়।
এ পদ্ধতিকে নিউক্লিয়ার ফিউশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য হিসেবে নিউট্রন তৈরি হয় যা পরে ট্রিটিয়াম গঠনে সহায়তা করে। এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত নিরাপদ।
তবে এই মূহুর্তে বাঁধাটা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় সূর্যের মতো অতি উচ্চ তাপমাত্রার প্লাজমা উচ্চ চাপে ধরে রাখতে হয়। তাপমাত্রাটা কত জানেন?গত জুনে প্লাজমার তাপমাত্রা অর্জন করা গেছে দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস, নিকট ভবিষ্যতে প্লাজমার তাপমাত্রা ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী বৈজ্ঞানিকরা। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা থেকেও ঢের বেশি!
চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এ জন্য এমন একটি স্ট্রাকচার তৈরি করা, যেটি এতো উচ্চ তাপমাত্রার প্লাজমাকে উচ্চ চাপে ধরে রাখতে পারবে।
প্লাজমাকে ধরে রাখার জন্য যে চৌম্বক স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হয় সেটিকে তুকামাক ফিউশন টেস্ট রিঅ্যাক্টর বলা হয়।
নিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়ে ভবিষ্যতে আলো দেখার কারণ হচ্ছে বেসরকারি খাতে অনেকেই এ খাতে বিনিয়োগ করছে। এ তালিকায় আছেন বিল গেটস, জেফ বেজোসের নামও।
একটি অতি সম্ভাবনাময় প্রকল্পের কাজ করছে অক্সফোর্ডশয়ারভিত্তিক ‘তুকামাক এনার্জি’ নামে একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি উচ্চ তাপমাত্রার সুপারকনডাকটর বা এইচটিএস প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করেছে, যা অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চৌম্বকশক্তিতে প্লাজমাকে উচ্চ চাপে আটকে রাখতে সক্ষম।
এ ধরনের রিঅ্যাক্টর আকারে ছোট হয়, তাই নির্মাণ খরচ কম। ইতিমধ্যে এমন তিনটি রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো একেকটি ছোট ছোট সূর্যের মতো কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে এমআইটি কাজ করছে ডোনাট আকৃতির একটি তুকামাক নির্মাণের লক্ষ্যে। তাদের সঙ্গে রয়েছে কমনওয়েলথ ফিউশন সিস্টেম। অর্থায়ন করছে বিল গেটস, জেফ বেজোস, মাইকেল ব্লুমবার্গসহ অন্যান্য বিলিয়নিয়াররা।
বেসরকারি এসব উদ্যোগ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ফল আসবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিডে ফিউশন শক্তি যুক্ত করার কথাও বলছেন তারা। অনেকেই বলছেন এটি নিউক্লিয়ার ফিউশনের ‘স্পেস এক্স’ মুহূর্ত।