টেলিভিশনগুলোকে কি বাঁচানো যাবে

বিবিধ, টেক

মাজেদুল নয়ন; স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 05:04:22

ধুঁকছে ঢাকার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ব্যয়ের তুলনায় আয় না থাকায় কর্মচারী ছাঁটাই করছে নিয়মিত। অন্যদিকে, মানসম্মত অনুষ্ঠান বা খবর প্রকাশ করতে না পারায় বিজ্ঞাপনদাতারাও আর উৎসাহী হচ্ছে না।

একটি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্ণধার জানান, দেশে টেলিভিশনের মোট দর্শকদের মাত্র ২১ শতাংশ বাংলাদেশি চ্যানেল দেখেন। বাকি ৭৯ শতাংশ বিদেশি চ্যানেলের দর্শক। দেশের যে কোনো চ্যানেলের তুলনায় ভারতের জি নেটওয়ার্কের চ্যানেলগুলোর দর্শক অনেক বেশি।

বাংলাদেশে কিছুদিন আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল দীপ্ত টেলিভিশনের বাংলায় ডাবিং করা তুর্কি সিরিয়াল ‘সুলতান সোলেমান।’ বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনের ইতিহাসে এটি রেকর্ড সংখ্যক দর্শক পেয়েছে। ‘সুলতান সোলেমান’ চলাকালে বিজ্ঞাপনের জন্য কোম্পানিগুলোকে প্রতি মিনিটে লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। তবে সেই অনুষ্ঠানের বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যায় অন্য টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানগুলো এবং প্রযোজকদের সংগঠন। আবার খেলা চলাকালে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলোর মিনিটের মূল্য বেড়ে যায়।

তবে দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মানসম্মত অনুষ্ঠান না বানানো এবং দর্শক টানতে ব্যর্থ হওয়াকেই এই বিজ্ঞাপন সংকটের জন্য দায়ী করছেন বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সুলতান সোলেমান’ এর পর দীপ্ত টিভি নিয়ে আসে ‘কোসেম সুলতান’ এবং ‘এইজেল’। তবে এই সিরিজগুলো কিন্তু আগের মতো দর্শক জনপ্রিয়তা পায়নি। কারণ একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল দর্শক। অন্য চ্যানেলগুলোতেও ডাবিং সিরিয়ালের জোয়ার চলে আসে। তবে সবকয়টিই ব্যর্থ হয়।

ওই প্রতিষ্ঠাটির জরিপ থেকে জানা যায়, বর্তমানে খবরের চ্যানেলের মধ্যে ‘সময়’ টেলিভিশন ছাড়া অন্য চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনের হার সন্তোষজনক নয় মালিকদের জন্য। এক মিনিট সময়ের জন্য ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে রাজি হচ্ছে না বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক বছরে অনেক বেশি সংবাদ চ্যানেল হয়েছে। এমনকি অনুষ্ঠান চালানোর জন্য চ্যানেল খোলা হলেও, পরে সংবাদ চালু করা হয়েছে। ভাবা হয়েছিল, সংবাদ না থাকলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না। তবে ধারণা ভুল হয়েছে তিন বছর না পেরোতেই। মানুষ এখন সংবাদের জন্যে অনলাইন মাধ্যমে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। ফলে সংবাদ চ্যানেলগুলোও ঝুঁকছে অনলাইনে। ঘরে বসে টিভিতে সংবাদ দেখার দর্শকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে প্রতিদিন।

এদিকে, বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে বাঁচাতে এবার সরকারও পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে পহেলা এপ্রিল থেকে ডাউনলিঙ্ক করা বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।

শনিবার (৩০ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, এপ্রিল থেকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তথ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করা হলে দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপনের হার বাড়বে এবং দেশের টেলিভিশন শিল্প আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

তবে বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন দাতারা বলছেন, মানসম্মত অনুষ্ঠান বা খবর না হলে দর্শক যেমন পাবে না টেলিভিশনগুলো, তেমনি বিজ্ঞাপনের বাজারও বাড়বে না। কারণ বিজ্ঞাপন দাতা দেখবে দর্শকের অংশগ্রহণ কেমন এবং অনুষ্ঠানের গুরুত্ব কতটুকু। আর তারা বিদেশি চ্যানেলের জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন, সেই পরিমাণ অর্থ এখন তৃতীয় মাধ্যমে খরচ করবেন। সেটি ডিজিটাল মিডিয়াতেই যাবে বলে মনে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন সংস্থার ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশে এখন ভালো দর্শক পাচ্ছে দূরন্ত টেলিভিশন। কারণ সেখানে শিশুদের অংশগ্রহণ রয়েছে উল্লেখযোগ্য। ভালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে একটি বড় সংখ্যক শিশু দর্শককে তারা চ্যানেলের দর্শক বানাতে পেরেছে। তবে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে সেটি কমে এসেছে। বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে শিশুদের জন্য যে সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠানগুলো করা হচ্ছে সেগুলো দর্শক টানছে।

বর্তমানে দেশে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের যে বাজেট তার মাত্র ১৯ শতাংশ খরচ হচ্ছে দেশি চ্যানেলে। আর ৮১ শতাংশই দেওয়া হচ্ছিল বিদেশি চ্যানেলে।

বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন দাতারা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে যে বিজ্ঞাপনের টাকাটা বিদেশি চ্যানেলে যেতো সেটি এখন অনলাইন বা ডিজিটাল মিডিয়ায় খরচ করবে প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ এখন মানুষ টেলিভিশনের চেয়ে ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন অ্যাপসে বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে সে অনুযায়ী ক্রিয়েটিভ বিজ্ঞাপন তৈরি এবং এসব মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয়ের দিকে মনোযোগ বিজ্ঞাপন দাতাদের। কারণ সেখানেই টার্গেট গ্রুপের উপস্থিতি বেশি।

তিনি বলেন, যাই হোক জোর করে বিজ্ঞাপন আদায় করলেও, দর্শক না থাকলে সেই বিজ্ঞাপন বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ফলে টিভি চ্যানেলগুলো নিজেদের পরিবর্তন না করলে সরকারের এই পদক্ষেপেও কোন পরিবর্তন আসবে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর