অরবিট থেকে বঙ্গবন্ধু-১ এর সংকেত!

, টেক

সাব্বিন হাসান, এডিটর, আইসিটি | 2023-08-26 21:43:07

বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট। গত ১২ মে উৎক্ষেপণের ১০ দিন পর এটি এখন অরবিটাল স্লট বা নিজস্ব অবস্থানে পৌঁছেছে। কৃত্রিম উপগ্রহটি আংশিক সংকেত পাঠাতে শুরু করেছে।

গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন স্টেশনটির ব্যবস্থাপক নাসিরুজ্জামান।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ঠিকমতো তার অবস্থানে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার বেলা দুইটায় নিজস্ব কক্ষপথে জায়গা করে নিয়েছে। আংশিক সংকেত পেতে সমস্যা হচ্ছে না। দ্রুতই পুরোপুরি সংকেত পাওয়া যাবে। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়।

স্যাটেলাইট একটি কৃত্রিম বস্তু। এটি তথ্য সংগ্রহের জন্য বা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পৃথিবী বা চাঁদ বা অন্য কোনো গ্রহের চারপাশের কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। মনুষ্যনির্মিত হাজার হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছে। এদের মধ্যে কোনোটি বিভিন্ন গ্রহের ছবি সংগ্রহ করে, কোনোটা আবহাওয়াবিদদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস দিতেও সাহায্য করছে।

কিছু স্যাটেলাইট অন্যান্য গ্রহ, সূর্য, কৃষ্ণবিবর বা দূরবর্তী ছায়াপথের ছবি নিতে কক্ষপথে ঘুরছে।

এ ছাড়াও এমন কিছু উপগ্রহ আছে যাদের প্রধানত যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন টিভি সিগন্যাল, বিশ্বজুড়ে ফোন কলের সংযোগ স্থাপনের কাজেও ব্যবহার করা হয়। মহাকাশে ২০টিরও বেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয় জিপিএস সিস্টেমের কাজে। জিপিএস সিস্টেম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজেও আসে।

বার্ড আই ভিউ

স্যাটেলাইটের বার্ড আই ভিউয়ের (পাখির মত ভূ-পৃষ্ঠের অনেক ওপর থেকে দেখা) কারণে আমরা উপর থেকে পৃথিবীর একটি বৃহৎ অংশ দেখতে পাই। এ কারণে ভূ-পৃষ্ঠে স্থাপিত কোনো যন্ত্রের চেয়ে অধিক দ্রুত এবং নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে স্যাটেলাইট। এমনকি কোনো বস্তু পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের চেয়ে অধিক কার্যকর।

স্যাটেলাইটকে এত উপরে স্থাপনের প্রধান কারণ হলো যাতে মেঘ, ধুলাবালি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে। স্যাটেলাইট স্থাপনের পূর্বে টিভি সিগন্যাল বেশি দূর যেতে পারতো না। কারণ টিভি সিগন্যাল সরলরেখা বরাবর কাজ করে। এখন টিভি সিগন্যাল, ফোন কল প্রথমে পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটে পাঠানো হয়। স্যাটেলাইট সিগন্যাল গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক সেটি আবার পৃথিবীতে প্রত্যাশিত স্থানে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

স্যাটেলাইট বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। প্রত্যেক স্যাটেলাইটের দুটি সাধারণ অংশ থাকে। প্রথমত অ্যান্টেনা। দ্বিতীয়ত শক্তির উৎস। অ্যান্টেনা তথ্য গ্রহণ ও সংগ্রহের কাজ করে থাকে। সোলার প্যানেল অথবা ব্যাটারি উভয়েই শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে। নাসার স্যাটেলাইটে ক্যামেরা এবং কিছু সেন্সর লাগানো থাকে।

কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করার জন্য আলাদা মহাশূন্য যান থাকে। একে বলা হয় উৎক্ষেপণ যন্ত্র (লঞ্চ ভেহিক্যাল)। কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপনে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হয়, তা হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং মহাশূন্য যানটির গতির সমতা রক্ষা করা। কারণ অভিকর্ষজ ত্বরণ আমাদের উৎক্ষেপণ যন্ত্রকে পৃথিবীর দিকে টানতে থাকে।

উৎক্ষেপণ যন্ত্র দু ধরনের। অপচয়যোগ্য রকেট এবং মহাশূন্য শাটল। অপচয়যোগ্য রকেটগুলো স্যাটেলাইট স্থাপন শেষে ধ্বংস হয়ে যায়। অপরদিকে মহাশূন্য শাটলগুলো স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজে বারবার ব্যবহার করা যায়। উৎক্ষেপণ যন্ত্রের গতিবেগ উচ্চতার উপর অনেকটা নির্ভর করে। কম উচ্চতার কক্ষপথের (লো আর্থ অরবিট-লিও) বেগ ৭.৮ কি.মি./সেকেন্ড। আর বেশি উচ্চতার কক্ষপথের (জিও স্টেশনারি অরবিট-জিও) বেগ ৩.১ কিমি/সেকেন্ড।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে টেলিমেট্রি সংকেত পাওয়া যায়। অচিরেই টেলিকমান্ড পাঠাতে শুরু করবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।

মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার উপরে অবস্থান করছে বঙ্গবন্ধু-১। বর্তমানে স্যাটেলাইটের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছেই এর নিয়ন্ত্রণ আছে। পরে গাজীপুর ও বেতবুনিয়ার প্রকৌশলীদের কাছে এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনের ব্যবস্থাপক (স্যাটেলাইট প্রকৌশলী) মো. নাসিরুজ্জামান জানান, এখন আমরা টেলিমেট্রি সংকেত পাচ্ছি। কিন্তু সরাসরি নয়। ফ্রান্সের কান থেকে বিপিএনার মাধ্যমে। স্যাটেলাইটটি ফ্রান্সের কান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অচিরেই গাজীপুর ও বেতবুনিয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

গাজীপুরের তেলিপাড়া এলাকায় পাঁচ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। নানা কারণে বেশ কয়েকবার পেছানোর পর শুক্রবার (১২ মে) দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিকানা পেলো।

প্রসঙ্গত, গত ১১ মে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মিনিটে এসেই থমকে যায় সেকেন্ডের কাঁটা। রকেটের যাত্রা (স্টার্টআপ মোড) শুরু হওয়ার সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বৃহস্পতিবার রাতে আর উড়েনি বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।

ঘোষণা আসে, শুক্রবার ফের চালু হবে কাউন্টডাউন। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিট থেকে শনিবার ভোররাত ৪টা ২১ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের নতুন সময় নির্ধারণ করা হয় তখন। স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর কাজ করছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্স। তাদের ফ্যালকন-৯ রকেটে করে বঙ্গবন্ধু-১ যাত্রা শুরু করে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো যাবে।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ এই স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর