মেঘ পাহাড়ের রূপকথার রাজ্যে!

, ট্রাভেল

মানজারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 18:41:38

স্বপ্নের শহর এ দার্জিলিং। মনে হয় যেনো রূপকথার কোনো রাজা দার্জিলিং শহরকে ঢেলে সাজিয়েছে। কখনো মেঘ, কখনো কুয়াশার আস্তরণ আবার যতদূর চোখ যায় বিশালাকার পাহাড় যেনো দূরদূরান্তের দিগন্ত ছুঁয়েছে দার্জিলিংয়ে। স্বপ্নের এ শহরে গেলে মনে হয় যেনো হিমালয়ের দেশে আছি। পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে দার্জিলিংয়ের জুড়ি নেই।

এ ভ্রমণের গল্প গত বছরের। দার্জিলিংয়ে আকাশ মেঘের লুকোচুরি দেখতে খুলনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুপুর ১২ টার কমিউটার ট্রেনে চেপে বসলাম। ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে সাথে যুক্ত হলো ৪ বন্ধু। ট্রেন ছাড়তে দেরি হলো প্রায় ঘণ্টাখানেক। ট্রেনে যেতে যেতে কবি শামসুর রহমানের ট্রেনের কবিতার কথা মনে পড়লো। “ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে ওই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে-ট্রেনের বাড়ি কই ? আমাদের এ যাত্রায় ট্রেনের বাড়ি বেনাপোল স্টেশন। বেনাপোল স্টেশনে ট্রেন থামলো দুপুর সাড়ে ৩টায়। এরপর ইজিবাইক যোগে বেনাপোল বর্ডারে গেলাম। ঝামেলা ছাড়াই বাংলাদেশ ও ভারতের বর্ডার পেরিয়ে গেলাম আমরা।

এরপর ট্যাক্সি করে ভারতের বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে টিকেট কেটে ভারতের দম দম স্টেশনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠে পরলাম সবাই। দম দম স্টেশনে পৌঁছাতে গিয়ে সময় লাগলো রাত ৮টা।

দার্জিলিং

রাত ১০ টায় হাওড়া স্টেশন থেকে “পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস” ট্রেনে উঠলাম সবাই। ট্রেনের টিকেট অনলাইনে আগেই করা ছিলো। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়লো। ট্রেন ছাড়তেই হু হু করে হিমশীতল বাতাস বইতে শুরু করে। শীতের মাত্রা বাড়তে থাকায় শীত পোষাক জড়িয়ে আমরা স্লিপার কোচে ঘুমিয়েই রাত পার করলাম। ঘুম থেকে উঠে শুনলাম শিলিগুড়ি স্টেশন আর মাত্র আধ ঘণ্টার পথ। সকাল ১০ টায় ট্রেন থেকে শিলিগুড়ি স্টেশনে নামলাম আমরা। পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নেই।

চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়

এবার স্বপ্নের দার্জিলিংয়ে শহরে। শিলিগুড়ি থেকে বিখ্যাত টয়ট্রেনে চেপে দার্জিলিং শহরে যাওয়া যায়। তবে সে যাত্রায় সময় লাগে প্রায় ৮ ঘণ্টা। টয়ট্রেন পাহাড়ের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে দার্জিলিং শহরে যায়। মূলত টয়ট্রেনে চড়লে দার্জিলিং শহরের খুটিনাটি দেখা হয়ে যায়। তবে এর জন্য দীর্ঘ সময়ের পাশাপাশি বেশী ভাড়াও গুনতে হয় পর্যটকদের। শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে বেরোতেই ট্রাভেল কোম্পানীর লোকেরা ব্যাগ নিয়ে টানাটানি শুরু করে। সবার লোভনীয় অফার আর চাকচিক্যময় অফিস রুম দেখে যে কেউ তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ঠকতে পারে। আগে থেকে ধারণা থাকায় সময় বাঁচাতে আমরা নিজেরাই জিপ ভাড়া করলাম। দুপুরে আমাদের জিপ শিলিগুড়ি শহরকে পেছনে ফেলে দার্জিলিংয়ের পথে ছুটলো। শিলিগুড়িতে যখন নামি তখন তাপমাত্রা ২৪/২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শিলিগুড়ি পেরুতে না পেরুতেই চোখে পড়লো সবুজে ঘেরা চা বাগান। সবুজের গালিচা বিছানো চা বাগানের অপরূপ দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমী যে কারো মনকে আন্দোলিত করবে। আস্তে আস্তে দূরের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কিছু সময় পর আবিষ্কার করলাম আমাদের জিপ সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ের উপরে শুরু করেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা উঠে গেছে উপরে। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ি সরু রাস্তা দিয়ে জিপ গাড়ি চলছে। এ রাস্তাটি বেশ দুর্গম। সমতল পথ পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের জিপ হঠাৎ বাঁক নিলো। মনে হলো এ বুঝি পাহাড় থেকে পরে যাবার উপক্রম। পাহাড়ি পথে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় ততক্ষণে ভ্রমণ সঙ্গীদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হলো। সবাই মোটামুটি দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। এভাবে চলতে চলতে কিছুটা সয়ে নিলো সবাই।  চারপাশে কুয়াশার মতো আবছা আলো। পেছন থেকে অন্য গাড়িগুলোকে দেখলাম লাইট জ্বালিয়ে চলছে।

রাস্তাটি বেশ দুর্গম

হঠাৎই মেঘের ফাঁক দিয়ে রৌদ্রের উঁকি। গাছ-লতাপাতা সমতল থেকে উঁচুতে অনেকটাই ভিন্ন। পুরনো পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পথ। পথের উভয় পাশে পাহাড় কাটা দেয়ালে ফুটে রয়েছে নানা রঙের ফুল। দার্জিলিং শহরে প্রবেশ করেছি অনেকক্ষণ হলো। জিপের পেছন থেকেই দেখলাম ঘুম স্টেশনের গায়ে যেন জমেছে মেঘের আস্তরণ। বাস্তবটাও যেনো স্বপ্নের সাথে মিলেছে এখানে। পুরো স্টেশন জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। তার মাঝ দিয়েই টয়ট্রেন দাড়িয়ে আছে। এ স্টেশনটি বেশ বিখ্যাত। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম রেল স্টেশন। স্টেশনটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮১ সালে। এর উচ্চতা সমতল থেকে ৭৪০৭ ফুট উপরে।

জিপ গাড়িতে ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড়ি দৃশ্য দেখতে দেখতে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম পৃথিবীর অন্যতম শৈল শহর দার্জিলিংয়ে। দার্জিলিংকে শহরের রাণী আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দেশও বলা হয়। জিপ থেকে নেমেই উপলব্ধি করলাম প্রচন্ড রকমের ঠান্ডা এখানে। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আবহাওয়া দেখে চোখ চড়ক গাছ বনে গেলো। এখানে তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হিম বাতাসে শরীর যেনো কুকড়ে আসছে।

দ্রুতই পাশের একটি হোটেলে ভাড়া ঠিক করে উঠে পরলাম। খাওয়া শেষে সন্ধ্যায় মল রোডে হাটাহাটি আর মার্কেট ঘুরে দেখলাম সবাই। ঘুরতে গিয়ে দেখলাম পুরো শহরটাই পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। এখানের অধিকাংশ বাসিন্দাই নেপালি ভাষা ব্যবহার করে। তবে তারা হিন্দী ভাষাও বুঝে।

দার্জিলিং শহর

রাতের দার্জিলিং শহর ঘুরে ফিরে হোটেলে ফিরলাম। আমাদের হোটেল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পরদিন ঘোরার জন্য গাড়ি ঠিক করলাম। তারপর একটু জলদিই শুয়ে পড়লাম সবাই। কারণ পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে।  ভোর ৪ টায় হোটেলের সামনে জীপ এসে হাজির। গন্তব্য টাইগার হিল পয়েন্ট। শত শত গাড়ি সারি ধরে কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে টাইগার হিলে ছুটছে। মূল শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে টাইগার হিল। টাইগার হিলের চূড়ায় উঠে সুর্যোদয় দেখতে হয়। দার্জিলিংয়ে যারা বেড়াতে যায়, কেউ পাহাড় চূড়ায় উঠে সূর্যোদয়ের এ চমৎকার দৃশ্য দেখতে ভুল করেনা। টাইগার হিলের প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে গিয়ে চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। ভোরের আলো ফোটা আগেই টাইগার হিলের চূড়ায় উঠেছি। পূব আকাশের পর্বতশ্রেণি আর মেঘের ফাঁক থেকে সে সূর্যোদয়ের এ অভিনব দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিদিন হাজারো পর্যটক টাইগার হিলে আসে। মেঘের কারণে সূর্যোদয় ভালো ভাবে দেখতে পারেনি। তবে মেঘের ভেতর থেকে সূর্য যখন দ্যুতি ছড়ায়, সে দৃশ্য বেশ মনোরম। এ সময়টাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় টাইগার হিল থেকে। সূর্য পুরোটা ওঠার আগেই দর্শকরা স্থান ত্যাগ করেন। সকালের এ সময়টাতেই দার্জিলিংয়ের অন্য স্পটগুলো ঘুরে দেখায় ট্যুর গাইড আর জিপ চালকেরা। তবে আমি আর বন্ধু তানভীর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম টাইগার হিলে। সবাই চলে যাবার পর এখানে এক মোহনীয় পরিবেশ দেখা যায়। হালকা রোদের মিষ্টি আলোতে চারপাশের পাহাড় আর মেঘগুলো স্পস্ট হয়ে ওঠে। কাঞ্চনজঙ্ঘাও স্পষ্ট দেখা যায় তখন। মুগ্ধ নয়নে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দিকে। অনেক দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছে, তার থেকেও আরও বহুদূরে, অনেক দূরে উঁকি দিয়ে আছে বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। কাঞ্চনজঙ্ঘার বিশালত্ব, সৌন্দর্য কোনো লৌকিক ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভবপর না। দূরের নীল আকাশে বরফে ঢাকা সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। চূড়াটা তার সব সৌন্দর্য নিয়ে আকাশে ভেসে আছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার আশপাশের আরও কয়েকটা চূড়া থাকায় এ পাহাড়ের সৌন্দর্য আর রূপ যেনো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

দূরের নীল আকাশে বরফে ঢাকা সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া

তবে টাইগার হিল থেকে নামার পরে আমাদের জিপ চালকের নেপালি ভাষায় কটু কথা শুনতে হলো। সেই সাথে ভ্রমণসঙ্গীদের চোখ রাঙানিও। অন্য দর্শনার্থীরা নেমে গেলেও আমরা অনেক দেরি করেছি।

টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে দেখলাম গাড়িতে পানির ট্যাংক নিয়ে যাচ্ছে। জানতে পারলাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ লীলাভূমিতে পানির সংকট প্রচুর। বৃষ্টির পানির উপরে ভরসা করতে হয় অনেককে। পানির অভাব মেটানোর জন্য প্রতিদিন শিলিগুড়ি থেকে পানির গাড়ি আসে এখানে।

ফেরার পথে দেখানো হয় বৌদ্ধবিহার। বিহারে গৌতম বুদ্ধের ১৫ ফুট উঁচু একটি বিশাল মূর্তি আছে। সংরক্ষিত আছে বহু বৌদ্ধশাস্ত্র, নেপালি ভাষায় লিখিত তালপাতা আর কাগজের বহু পুঁথি। পুরো দার্জিলিংজুড়ে আরেকটা জিনিস খুব চোখে পড়লো। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ এরকম বিভিন্ন রং-বেরংয়ের টুকরো কাপড় ঝুলানো দেখলাম রাস্তার পাশ দিয়ে। কিছুটা গ্রামাঞ্চলে বিয়েবাড়ি সাজানোর মতো এ কাপড়গুলো। জানতে পারলাম ওগুলো বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন। কাপড়গুলোতে ধর্মীয় বাণী লেখা। দার্জিলিংয়ের মানুষজন ধর্মপ্রাণ। অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পাহাড়ের কোথাও সামান্য একটু গর্ত পেলেই সেখানে বুদ্ধের মূর্তি দিয়ে মন্দির বানিয়ে রাখে। পথচারীদের কারো দৃষ্টিতে ঐ ছোট্ট মন্দির পড়লে তারা তাদের ধর্মীয় নিয়মে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। দার্জিলিংয়ে প্রচুর প্যাগোডা, মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে টাইগার হিলে দর্শনার্থীরা

জিপ থেকে হোটেলের অদূরে টয়ট্রেনের দার্জিলিং স্টেশনে নামলাম আমরা।  পর্বতে চলাচলের উপযোগী দার্জিলিং হিমালয়ান এক্সপ্রেস। দার্জিলিং স্টেশন থেকে এ ট্রেন ছাড়ে। ধীর গতির নীল রঙের এ ট্রেনটি ভারতে খেলনা ট্রেন নামে বেশ পরিচিত। ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে এ স্টেশন থেকে টয়ট্রেনের যাত্রা দেখলাম।

এছাড়াও দার্জিলিংয়ে ঘুরে দেখার অনেক জায়গা আছে। তারমধ্যে বেশ কিছু জু, ঘুম মনাস্ট্রি, বাতাসীয়া লুপ, রক গার্ডেন, টি গার্ডেন, পীচ প্যাগোডা, জাপানীজ টেম্পল, হিমালয়া মাউন্টেন, রোপওয়ে, তেনজিন রক, গঙ্গা মহালয়া অন্যতম। পৃথিবী খ্যাত চা-বাগান, পুরাতন স্কুল এবং অনেক স্থাপত্য, গীর্জা, মন্দির দার্জিলিং শহরে চোখে পড়বে। এখানকার মেঘ এক পরম বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করে পর্যটকদের মুগ্ধ করতে। ঘরে মেঘ, রাস্তায় মেঘ, মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি, ঘন কালো অন্ধকার মেঘ- এ সবই যেনো দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্য। দার্জিলিং না গেলে রহস্যময় পৃথিবীর বিরাট অংশ অধরাই থেকে যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর