বিদেশি ওই ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ ধরে রেস্তোরায় বসে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দেখছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। আমরা বসে ছিলাম নেপালের পোখরার একটি রেস্টুরেন্টে। নাস্তার অর্ডার দিয়ে বসে আছি। নাস্তা হতে সময় লাগবে। এই ফাঁকে টেবিল চাপড়ে, জোর গলায় কোরাস করে আমরা একটার পর একটা দেশের গান গেয়ে যাচ্ছি। আমরা মানে জনা দশেক বাংলাদেশের তরুণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা। অবাক হয়ে সেই গান শুনছিলেন তিনি।
অবাক হওয়ারই কথা। আমাদের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ বেতারের ওই সময়রে সহকারি পরিচালক মামুন ভাই বাদে আর কারোই গানের গলা নেই। আরিফ ভাই, রাসেল, জুয়েলের গানের গলা ভালো না হলেও খারাপ না। কিন্তু আমারটা ভয়াবহ। তবুও আমরা মনের আনন্দে গাইছি। ইউরোপিয় চেহারার ওই ভদ্রমহিলা বিস্মিত। নিজের খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাদের কাছে এলেন। এরপর ইংরেজিতে যা বললেন তার অর্থ, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।
আমরা কিছুটা বিব্রত হয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, তোমরা খুব সুন্দর গান গাইছিলে। প্রাণবন্ত। রেস্টুরেন্টে খেতে বসে এতো জড়তাহীনভাবে কাউকে গান করতে আমি আগে দেখিনি। তোমাদের গানের ভাষাটাও মিষ্টি। এরপরে তার প্রশ্ন-তোমরা কি ইন্ডিয়ান? ইন্ডিয়া থেকে এসেছ? আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, না আমরা বাংলাদেশি। তার প্রশ্ন বাংলাদেশটা কোথায়?
এবার আমার রাগ হলো। বোঝা গেলো তিনি বাংলাদেশের নাম শোনেননি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি বাংলাদেশ চেনো নো? তিনি জানালেন, না। তুমি কোথা থেকে এসেছ? তার জবাব ফ্রান্সে। কী চেন? জানালেন ইন্ডিয়া। সেখান থেকে নেপাল এসেছেন। প্রতিবছরই একটা সময় বেড়ান। গত কয়েকবছর ধরে ভারত নেপালে বেড়াচ্ছেন।
কোন বিদেশি যখন বলে বাংলাদেশ চেনে না, আমার রাগ হয়। আমি তখন তাদের বাংলাদেশ চেনাই। এবারও তাই। সরাসরি বললাম তুমি তো অনেক দেশ ঘুরো? সুমদ্র-সাগর-সৈকত এগুলো তোমার খুব পছন্দ তাই না? সে বললো-হ্যাঁ। তাহলে বলো তো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কোথায়? ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন জানা নেই। আমি বললাম তোমার সারাজীবনের বেড়ানোই অপূর্ণ থেকে যাবে। কারণ তুমি কক্সবাজার যাওনি।
আমি তাকে জানালাম কক্সবাজার পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। টানা ১২০ কিলোমিটারের বিচ। তোমরা যে ব্যাংকক, বালি, ইউরোপে কয়েক কিলোমিটার সৈকত দেখে লাফাও, আর বলো লাইফ ইজ বিউটিফুল, কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকত দেখে কী বলবে? একজীবনে তো হেঁটেই শেষ করতে পারবে না।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি বলে চলছি, সেন্টমার্টিন নামে একটা প্রবাল দ্বীপ আছে আমাদের। যেখানে গেলে মনে হবে এটা প্রকৃতির স্বর্গ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছো? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন কোথায় জানো? সেই সুন্দরবনও বাংলাদেশে। পাহাড় দেখতে চাও? বান্দরবান-রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি নামে আমাদের তিন পাবর্ত্য জেলা আছে। যেখান থেকে সারি সারি মেঘ দেখা যায়। চা বাগান দেখতে চাও? কিংবা ঝর্ণা। সিলেটে চলে যাও। অার শত শত নদী দেখতে চাও। তাহলে যেখানে ইচ্ছে চলে যাও। কতো খরচ পড়বে এগুলো দেখতে জানো? মাত্র পাঁচ থেকে ২০ ডলারে থাকতে পারবে। এক থেকে দুই ডলারে আরাম করে লাঞ্চ-ডিনার করতে পারবে।
ভদ্রমহিলা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে বললাম তোমার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাই না? না। আচ্ছা তোমার হাতের মোবাইলের ইন্টারনেটে গিয়ে সার্চ দাও।আর যেই ভারতে তুমি ঘুরতে যাচ্ছো সেই ভারত আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গেই ছিল। আমরা এক দেশ ছিলাম। আমরা বাঙ্গালিরাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত থেকে আমাদের আলাদা করে দেয় পাকিস্তানে। এরপর বলি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানো। পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা মায়ের ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি।
আমার কথা শেষে ভদ্রমহিলা বললেন, বাংলাদেশ না ঘুরলে তো জীবন বৃথা। আগামী বছরই আমি তোমাদের বাংলাদেশ যাবো। শুধু তিনি নন, তার বন্ধুদেরও যেতে বলবেন। এরপর তিনি আমাদের সঙ্গে তার ছবি তুললেন তার ক্যামেরায়। সেই ছবি ফেসবুকে আছে। আর ২০০৯ সালের পর ফ্রান্সের ভ্রমণকারী বেড়েছে বাংলাদেশে। জানি না তাতে সামান্য ভূমিকাও আছে আছে কী না আমাদের।
দশ বছর আগের এই গল্পটা বলার কারণ আছে। আজকে ২৭ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব পর্যটন দিবস। আমি পৃথিবীর বহু কিছু দেখিনি। আবার ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, ইউরোপসহ বেশ কয়েকটা দেশ ঘুরেছি। সত্যি বলছি, পৃথিবীর কোন দেশ ঘুরে আমার এই আফসোস হয়নি, যে সৃষ্টিকর্তা বাংলাদেশকে কম দিয়েছেন। বরং আমার মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা দুহাত ভরে বাংলাদেশকে দিয়েছেন। পর্যটন প্রকৃতি আমাদের অসাধারন। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের ব্যাবস্থাপনায়। আর তাই সারা দুনিয়াকে আজো জানাতে পারিনি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশে। জানাতে পারিনি সুন্দরবনের কথা। আমরা আসলে জানি না কীভাবে আমাদের সৌন্দর্যের প্রচার করতে হয়। পৃথিবীর ৭০ টা দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসতে ভিসা লাগে না। কিন্তু সেই দেশগুলোর নাগরিকদেরও আমরা বলতে পারি নাই তোমরা বাংলাদেশে বেড়াতে যাও। সেখানে গেলে এই এই সুবিধা পাবে।
আমরা সবাই জানি, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড, নেপাল, জাপানে ছরে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক যায়। কারণ তারা তাদের পর্যটনের প্রচারণায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু আমরা বিউটিফুল বাংলাদেশ নামে এতো সুন্দর একটা বিজ্ঞাপন বানিয়েও পৃথিবীর কোন দেশের টিভিতে দেখাতে পারলাম না। পৃথিবীকে জানাতে পারলাম না। ফলে বিদেশি পর্যটকরা সব চলে যায় মালেয়শিয়া, বাংকক-নেপাল-ভারতে।
পাশের দেশ ভারত বাংলাদেশি পর্যটক টানতে ভিসা সহজসহ কতো কিছুই না করছে? আর আমরা? ভারতে থাকা আমাদের বন্ধুরা প্রায়ই বলে, বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া কঠিন কাজ। শুধু ভারত কেন আমরা কেন অন্য দেশগুলো থেকে পর্যটক টানতে পারছি না। আমার মনে হয়, প্রতিটি দূতাবাসের বিদেশিদের বাংলাদেশে বেড়াতে আনার ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া উচিত।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা উদাহরনভাবে দেওয়ার পরেও আমরা অভাগা জাতি বলে সব কাজে লাগাতে পারছি না। মরুর শহর দুবাইতে দেখলাম ওরা কা দিয়ে সাগরপাড়ে কী সুন্দর করে রেস্টরুন্টে বানাচ্ছে। সাজাচ্ছে। ইউরোপেও তাই দেখলাম। আর আমরা ককক্সবাজারটাকে নষ্ট করে পারলে সৈকতের মধ্যওে হোটেল তুলি। আমরা জানি না কীভাবে নিজের দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হয়। আর আমাদের কোন সত্যিকারের পরিকল্পনাও নেই। আচ্ছা বিদেশিরা কক্সবাজারে কী জন্য যাবে? আমাদের কী বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে? মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সব থাকলে সমস্যা হয় না। এমনকি সৌদ আরবও যেখানে তার দরজা উম্মুক্ত করছে বিদেশিদের জন্য সেখানে আমরা এখনো বসে আছি মান্ধাতা আমলে। আমার মনে হয় শুধুমাত্র ব্যাবস্থাগত ত্রুটির কারণে আমরা আমাদের পর্যটনকে বিপনন করতে পারলাম না।
বিদেশির কথা বাদ দিলাম। দেশে শান্তিতে ঘোরার জন্য আমরা কতোটা করতে পারছি? সিলেটে বেড়াতে যাবেন। ভয়াবহ সব রাস্তাঘাট। কক্সবাজারে যাবেন? সড়কপথে ১৮ ঘণ্টা। এতোকিছুর মধ্যও আমাদের তরুণরা নতুন নতুন জায়গা বের করছে। লোকজন দলবল নিয়ে সেখানে ঘুরতে যাচ্ছে। কিন্তু ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাট আর একটু শান্তিতে ঘুরতে না পারার কারণে আমাদের স্বচ্ছল মানুষগুলো কিন্তু চলে যাচ্ছে বিদেশে। অথচ একটু আরামদায়ক, স্বস্তির পরিবেশ থাকলেই কিন্তু মানুষজন দেশেই বেড়াত। আচ্ছা এই ঢাকা শহরের মানুষ যদি ঘুরতে চায় কোথায় যাবে? শুক্র শনিবারে কোথায় যাবে? অথচ ঢাকার চারপাশে নদী ছিল। দেশে শত শত নদী। আমরা নদীর তীরে সুন্দর করে সাজাতে পারতাম। নিয়মিত নদীতে ভ্রমণ প্যাকেজ থাকতে পোরতো। নৌপথে সারাদেশে ঘোরা কিংবা গভীর সাগরে সাতদিন থাকার নানা ধরনের অয়োজন থাকতে পারতো। আরও কতো কী সম্ভব।
এতো কথা বরার কারণ আমার সাংবাদিকতার আরেকটা জায়গা ছিল পর্যটন। শুনলে হাসবেন। ১৯৯২ সালে আমরা একটা জাতীয় পপর্যটন নীতিমঅলা করেচিলাম। নীতিমলায় যা ছিল আমরা কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারিনি। পরে ২০১০ সালে নতুন নীতিমালা করলাম। আগের যা ছিল সব এখানে আনা হয়েছে। ভালো ভালো কথা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। সরকার নানা কিছু করছে ভাবছে কিন্তু আমার বারবার মনে হয়, আমাদের সবকিছু সমন্বয়হীনভাবে চলছে।
আমি আশাবাদী মানুষ। আমি মনে করি এখনো সময় আছে। এই খাতে একটু নজর দিলেই পাল্টে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আমরা যদি কক্সবাজারে শুধু ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল না তুলে প্রকৃতি ঠিক রেখে পরকল্পিতভাবে পর্যটনের সব ব্যাবস্থা করি তাহলে দেশি পর্যটক অনেক বাড়বে। সেজন্য সবার আগে ব্যবস্থাপনাগুলো ঠিক করতে হবে। ঠিক করতে হবে মানসিকতা। নিরাপদ, শান্তি ও স্বস্তি দিতে হবে।
আমি নিশ্চিত ঠিকমতো দুনিয়াকে জানাতে পারলে পর্যটকরা আসবেই। কারণ সাগর সৈকত নদী আর সবুজের এমন সমারোহ আর কোথাও যে নেই। কিন্তু কথা হলো, বাংলাদেশ প্রস্তুত তো?একবার ভাবুন, আমরা কেন বিদেশে বেড়াতে যাই। এবার ভাবুন একজন বিদেশি এসে কী কী চায়? সুন্দর যোগাযোগ, স্বস্তি, নিরাপত্তা। সব আছে কী আমাদের? বহু বছর আগে পর্যটন নিয়ে একটা নিউজ করেছিলাম। সম্ভাবনা বিশাল, প্রস্ত্রতি সামান্য। নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন, অবস্থাটা বদলেছে কী?
আমি নিশ্চিত আমরা যদি ব্যবস্থাপনাগুলো ঠিক করে সারা দুনিয়াকে বলি হে বিশ্ববাসী! আসো-পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সুমুদ্র সৈকতের দেশে, রয়েল বেঙ্গলের দেশে। ঘুরে যাও সবচেয়ে কম খরচে, নিয়ে যাও সবচেয়ে বেশি আন্তিরকতা। এসো আমার বাংলাদেশে। আমি জানি মানুষ আসবেই। আমি অপেক্ষায় সেই সুদিনের। আমাদের শুধু দরকার এখন যথাযথ প্রস্তুতি।