পর্ব-৫
আলাস্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ওয়ান ফোর সিক্স ওয়ান যথাসময়ে এসে দাঁড়ানোয় বোর্ডিং শুরু হয়েছে। আসন নম্বরের সিরিয়াল মেনে ডাকা হচ্ছে। আমাদের আসন বিজনেস ক্লাসের পেছনের সারিতেই। তুসুর আসন পড়েছে পিছনে। স্লিমদেহী এয়ারবাস থ্রি টু জিরোর দু’দিকের জানালাঘেঁষে তিনটি করে আসন, মাঝখান দিয়ে চলাচল। বিমানে উঠে দেখি আমাদের সারির আয়েল আসনে আসন নিয়েছে জলির চোখের যম ‘ওগো বিদেশিনী’। এয়ারক্রাফট স্লিমদেহী হলে আসনগুলো কোসাদা। ইস্তাম্বুল-সানফ্রানসিস্কো ফ্লাইটে ভাগ্যক্রমে জলি স্বামীকে সুরক্ষিত করতে পারলেও এখানে তা অসম্ভব। কারণ আমাদের আগেই নিজ আসনে আসন গেড়েছে। জলি আজকের মনোরম বিকালটি পাখির চোখে পাহাড় বন বনানী আর সমুদ্র দেখতে চায়। চোখে তেরচা নজর জারি রেখে মাঝের আসনটি আমাকে ছেড়ে দেয়। নিজে জানালার কাছে গিয়ে বসে। শেষ ফ্লাইটের এ কাণ্ডে আমি এই ভরশ্রাবণে কবি নজরুলকে স্মরণ করি- ‘পরাণ প্রিয়….কেন এলে অবেলায়’।
‘ওগো বিদেশিনী’র বয়স বোঝার উপায় নেই। এয়ারক্রাফটের মতোই চিকনদেহী। চেহারার কমনীয়তা কবেই উধাও, আহামরি দর্শনধারীও নয়। এটাই জলির সান্ত্বনা। সামনের আসনলগ্ন সকেটে চার্জার ঢুকিয়ে আইপ্যাডে মগ্ন সে। আসন নেওয়ার সময় ‘এক্সিউজিম মি’ বললে শুধু ‘ওহ সিওর’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল চার্জ করতে কোন সকেটে চার্জার ঢুকাবো এ নিয়ে আমার দোনোমোনো দেখে ‘ইউ ক্যান পুট ইট অন টপ অফ মি’ বলে আমাকে ভড়কে দিয়েছে। পরে বুঝতে পারি প্যানেলের দুটি সকেটের নিচেরটিতে সে চার্জ দিচ্ছে, আমাকে ওপরেরটিতে চার্জার লাগাতে বলছে। আমাদের মধ্যে কথা ওই দুই বাক্যই। আর কোন কথা নেই। আসনসঙ্গীর সঙ্গে সচরাচর আলাপ জমাতেই পছন্দ করি আমি। কোন নারী সঙ্গে থাকলে কোন নারী আর তার সঙ্গে আলাপ জমাতে চায়! সে আলাপ বৃথা। আমি বামপাশে নিজ নারী, ডানপাশে পরনারীর মাঝখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছি। থিতু হয়ে জুস কফি খাওয়ার মধ্যেই ল্যান্ডিংয়ের জন্য নিচে নামতে শুরু করেছে বিমান।
ঘণ্টা দুয়েকের উড়ালশেষে সিয়াটল তাকোমা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে আমি দ্রুত এক্সিটের দিকে হাঁটা শুরু দিই। জলি ও তুসুকে দ্রুত পা চালাতে বলি। কাস্টমস ইমিগ্রেশনের ঝামেলা আগেই গুজার গিয়া। বিমানের ভেতরে থাকতেই আলাস্কা এয়ারের কোকিলকণ্ঠি বলে দিয়েছে- থ্রি ফোর সিক্স ওয়ানের লাগেজ পাওয়া যাবে ১৫ ও ১৬ নম্বর বেল্টে। বেল্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই লাগেজ এসে হাজির। সেগুলো নামিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে আমি মোবাইলে রোমিং নম্বরটি সচল করি। সিয়াটলে আমাদের মেজবান মি. পল কে বার্তা দিই-‘ উই হ্যাভ এ্যারাইভড’। পরক্ষণেই ফিরতি বার্তা পাই ‘আই এ্যাম ড্রাইভিং, জাস্ট ফাইভ মিনিটস’। টেনশনপ্রিয় মন আমার প্রশান্ত উপকূলের এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে শান্ত থাকে।
আজকাল ভ্রামণিকদের জন্য হোটেলের ঘড়িবাঁধা জীবন ছাড়াও এয়ার বিএনবি, কাউচ সার্ফিংয়ের মতো অ্যাপসভিত্তিক ব্যবস্থা বিদেশে বসবাসের নানারকম বন্দোবস্ত করেছে। তাতে দিন মাস ক্ষণ সময় বেঁধে থাকা যায়। হোস্টগণ এয়ারপোর্ট থেকে নবাগত ভ্রামণিককে রিসিভও করে থাকেন। আমাদের সম্পর্ক ভিন্নধর্মী, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’র মতো। সময়কেন্দ্রিক বাঁধাধরা নিয়ম সেখানে অচল। এসেছো যখন এ নগরে, থাকো যতোদিন ইচ্ছে- গোছের। কিছুক্ষণ পরই মি. পলের উদয়। দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রধরে বিমানবন্দরের অগুণতি মানুষের ভিড়ের মধ্যেই অনায়াসে চিনতে পারি আমরা। কিছু সময় কাটে শুভেচ্ছা বিনিময়ে, আবেগমথিত মানবীয়বোধে।
লাগেজসহ পলের সঙ্গে চৌদ্দ নম্বর এক্সিট দিয়ে বের হয়ে ড্রাইভওয়ের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। পলের বন্ধু সিনা ও রকিও এসেছে আমাদের রিসিভে সহায়তা করতে।পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে এয়ারপোর্টের ভেতরে এসেছে সে আমাদের অভ্যর্থনায়। তার বন্ধুরা বাইরে চক্কর দিচ্ছিলো,, ফোন পেয়ে বিশালবপু গাড়ি নিয়ে হাজির চোখের পলকে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সিনা-রকির গাড়ির পেছনে ছোট বড় নয়টি লাগেজ তোলা হয়। রকি আর পলই ধরাধরি করে লাগেজগুলো তোলে, আমাদের হাত লাগাতে হয়নি। ভাবটা এমন যে, সব ভার, চাপ আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। বিশালবপু গাড়ি আপত্তি ছাড়াই ঢাউস লাগেজগুলো পেটে ভরে নেয় পরম যত্নে। সঙ্গের হাতব্যাগগুলো নিয়ে আমরা পলের সঙ্গে পার্কিংলটের দিকে হেঁটে চলি। অপেক্ষমান তার ব্রান্ডনিউ হুন্ডা। বাড়িতে স্বাগত জানাতে অপেক্ষমান গৃহবন্ধু মিসেস জেরিন। এ নগরে দম্পতির প্রার্থিত মেহমান আমরা। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি-উবার আমাদের জন্য নয়, সিয়াটলে পৌঁছেই পেতে শুরু করি রাজকীয় আতিথ্য।
তাকোমা থেকে সিয়াটল ডাউনটাউনকে বাইপাস করা ফ্রিওয়ে ফোর ও ফাইভ ধরে ড্রাইভ করে পল ১৮ নম্বর এক্সিট নেয়। আগে জানি তার বাসা স্নোহোমিশ কাউন্টির লিনউড নেইবারহুডে। পৌনে একঘণ্টর ড্রাইভে বাসায় পৌঁছে দেখি সিনা-রকি দম্পতি লাগেজ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ল্যান্ডিংয়ের সময় আকাশ মেঘলা দেখেছি। আসার সময় গাড়ির গ্লাসেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দেখেছি। লিনউডে সেই গুঁড়ি একটু বড় ও ঘন হয়েছে। ভাবি, প্রশান্ত মহাসাগরসংলগ্ন ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটল শহরে বৃষ্টিপ্রবণ বলে শুনেছি, আজ সেই বৃষ্টি কি আমাদের স্বাগত জানাতে এলো?
ভ্রমণক্লান্ত শরীরকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে সিনা ও রকি আর অপেক্ষা করলো না। ডুপ্লেক্স বাড়ির গ্যারেজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গাড়ি পার্ক করে পল। লাগেজগুলো প্রশস্ত গ্যারেজে ঢুকিয়ে বামপাশে দরজা দিয়ে আমরা তার সঙ্গে বাড়িতে ঢুকি। নিচতলায় কাউকেই দেখতে পাই না। কয়েক মিনিটের মধ্যে দোতলা থেকে ত্রস্তপায়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে গৃহকর্ত্রী জেরিন। জলিকে জরিয়ে ধরে। পল, তুসু আর আমি থ’ হয়ে যাই। যেন এ আবেগ জন্মজন্মান্তেরের সম্পর্কের।
ভ্রমণক্লান্ত শরীর, বাইরের বৃষ্টি আর রাতের আঁধারের কারণে মার্কিন মুলুকের এই অচেনা শহরে আমাদের নয়া অতিথিশালাটি পুরো দেখতে পারি না। ভ্রমণঘোরের মধ্যেই টেবিলে পরিবেশিত পাঁচপদের তরকারি দিয়ে রাতের খাবার খাই। গৃহকর্ত্রী জেরিন জলি আমার শয়ন কক্ষটি দেখিয়ে দেয়। দোতলার শয়ন কক্ষ আর বাথরুম দেখে আমাদের আশ্চর্য হওয়ার পালা। পেশাগত জীবনে পাঁচতারকা মানের হোটেল স্যুটের অতিথি হয়েছি অগুণতিবার। কিন্তু এই প্রশস্ত নতুন খাট, মোটা গদির পরিপাটি শুভ্র বিছানা, দুই আসনের সোফা, জানালা লাগোয়া রিডিং টেবিল, সবুজরঙা ভেলভেটে মোড়ানো চেয়ার, রিডিং লাইট, দেয়ালঘড়ি, এ্যালার্ম ক্লক, সবুজ ইনডোর প্ল্যান্ট, বড়সড় ক্লজেটে গোটা বিশেক হ্যাঙ্গার, লাইফসাইজ মিরর, খাটের দুই পাশে সাইডটেবিলে নতুন থার্মোফ্লাস্কে খাবার পানি, সবার জন্য আলাদা আলাদা ছোট ও বড় তোয়ালে, বাথরুমে সোপ, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, স্ক্রাব, ফেসওয়াস, লোশন, মাউথওয়াশ, সেন্ট, বডিস্প্রে, শেভিং ক্রিম, হ্যান্ডওয়াশের বিপুল সম্ভার কোন পাঁচতারকায় মেলে? উপর্যুপরি এখানে নেই ঘড়ি ধরে চেক ইন চেক আউটের তাড়া।
পল-জেরিনের অতিথিসেবার বিপুল আয়োজন দেখে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। মেজবান দম্পতির বাড়ি ও মেহমানদারির আরও এন্তেজাম আগামীকালের জন্য তুলে রাখি। পঞ্চাশঘণ্টার পরিভ্রমণক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেই কোমল বিছানায়।