পর্ব ৭
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ নীবিড় বন ও পর্বতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তা বোঝা যায়। ম্যাপল গল্পকোর্সকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলে ম্যাপল ভ্যালি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পরিচিত বৃক্ষ ম্যাপল এর নামে গড়ে উঠা উপত্যাকাটি দিগন্তজোড়া। রাস্তা ফুরিয়ে ম্যাপল নামের উপত্যাকাটি শেষ হতে চায় না। এই রাস্তায় এগিয়ে যেতে থাকলে চোখে পড়ে ছোট পর্বত পাদদেশের শান্ত নিরিবিলি ছোট ছোট শহর। ক্রমশ বনের নীবিড়তা বাড়ে, লোকালয় কমতে থাকে। ম্যাপল উপত্যকার পর ব্লাক ডায়মন্ড নামে একটি ছোট শহর পাই। ঘনবনের ভেতরে প্রবেশের আগে শেষ শহর বলতে গেলে এনামক্ল। এ শহরে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও পেট্রাল পাম্প দেখি। শহরের অদূরে ১৬৯ সড়ক মিলিত হয়েছে ৪১০ নম্বরে। দৃষ্টিগ্রাহ্য সেতু না থাকলেও একটি ছোট নদী পেরিয়ে যাচ্ছি বলে মনে হয়। শহর ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই নদীটি আমাদের সঙ্গী হয়। নাম তার শ্বেত নদী, হোয়াইট রিভার।
শহুরে কোলাহলের পর বনানীময় নির্জন নীরবতা আর ছুটে চলার দুলুনিতে গাড়ির ভেতরেইও স্তব্ধতা নেমে এসেছে। আমি ছাড়া সবাই ঝিমুনিভাবে চুপচাপ। আকস্মিক তুসুর ‘ওয়াও’ বলে চীৎকারে অন্যরা আড়মোড়া ভেঙে বসে। ক্যামেরা বাগিয়ে সে ভিডিও করতে শুরু করেছে। গাড়ির সোজাসুজি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাউন্ট রেইনিয়ার- পশ্চিমপ্রশান্ত স্টেট ওয়াশিংটনের পাহাড়পুঞ্জের সম্রাজ্ঞী। আকাশমুখো নীরবে মাথা তুলে দাঁড়ানো পর্বত অনায়াসে নজরে আসায় সবাই খুশি। পর্বতকে নজরের সামনে রেখে গাড়ি ছুটতে থাকে। আঁকাবাঁকা রাস্তার জন্য মাঝে মাঝে দৃষ্টিসীমার ডানে বাঁয়ে চলে যায়, কখনো লুকোচুরি খেলৈ গাছে পেছনে। পরক্ষণেই উদ্ভাসিত হয় উচ্চতার স্বমহিমায়।
পল বলে, ‘উই আর গোয়িং টু সী হার ফ্রম হার আর্মস। বাট আই এ্যাম এ্যাফ্রেইড
গন্ডোলা অব ক্রিস্টাল মাউন্টেন ইজ ক্লোজ আর ওপেন।‘
আমি বলি, বহু ভ্রামণিক মনে করে গন্তব্য পৌঁছাই আসল ভ্রমণ। আমার কথা হচ্ছে, এই যে ড্রাইভ করে যাচ্ছি ঘনবনের নীবিড় নির্জনমুখো, সামনে আপাদমস্তক মাউন্ট রেইনিয়ার, এটাও তো এক সফল ভ্রমণ। ভ্রমণের প্রতিটি মূহুর্তই থাই বৃথা নয়।
দেখি আমার এ বক্তব্যে কারও কোন উচ্চবাচ্য নেই। তার মানে, যতোটুকু উপভোগ্য হয়েছে এই ভ্রমণ তাতেই সবাই তৃপ্ত।
এখনও চোখের সামনে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। পাহাড়ের পাদদেশের তৃণলগ্ন বিস্তীর্ণ ক্ষেতে গরু বা ভেড়া চড়ছে। বহুদূর পেরিয়ে যাওয়ার পর দুয়েকটি ফার্ম হাউজ। আমাদের আজকের ক্যাপ্টেন পল বললো-
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নীবিড় বনানীতে ঢুকে যাবো। সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান। সেখানে বনপাহাড়ি কটেজ, কেবিন আর ক্যাম্পগ্রাউন্ড ছাড়া কোন লোকালয় নেই।‘
বলতে না বলতে গাড়ি এক নীবিড় জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। আশ্চর্য গাড়ির ভার্চুয়াল প্লেয়ার তার প্লেলিস্ট থেকে বাজিয়ে দিয়েছে মেঘদল ব্যান্ডের গান-
‘চেনা অচেনা আলো আধারে/ চলতি পথে কোন বাসের ভিড়ে/কালো ধোঁয়া ধোঁয়ার এই শহরে/হাঁটচি আমি একা রোদ্দুরে/ আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক/হারাই্ শুধু হারাই তোমার অরণ্যে’…।
হারাই শুধু হারাই অরণ্যে, হারাই শুধু হারাই অরণ্যে রিদমের মধ্যে গাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি অরণ্যে, বনের নির্জন পথ ধরে শহর থেকে দূরে। পরের গান-
‘ভীষণ গন্ধ ডুমুর ফুলে,মাকালের লাল মেখে/ শুকনো নদী বুকে,রাতের রোদ্দুরে’।
আশ্চর্য টেলিপ্যাথি, আশপাশে বুনোফুলের গন্ধ। আমাদের চলার সঙ্গী হোয়াইট রিভার বরফগলা নদী বলে এই শরতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বুকে জেগে আছে কেবল পাহাড়ি নুড়ি ও পাথর।
প্লেয়ারে বাজতেই থাকে- ‘শহরবন্দী মেঘ, ঘুরে ঘুরে একা/ আমাদের এই সুবর্ন নগরে/ আমিও পেতেছি কান, শুনি বৃক্ষের ক্রন্দন/ ধূসর রাজপথের প্রান্তরে’….।
বৃক্ষবৃন্দের মধ্য দিয়ে ছুটছি নি:সঙ্গ মৃসণ সড়কে। কর্ণকুহরে ‘মেঘদল’ এর এই শহর, মেঘ, বৃক্ষের গান।
দু’ধারে পাইনবনের সারি, ট্রেকারদের কেবিন, আরভি স্টেশন, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড,,পাহাড়ি বাঁক। বন ঘন হয়ে আসে কোথাও, কোথাও আবার ফাঁকা ফাঁকা। পাহাড়ের পাদদেশে কোথাও সবুজক্ষেত ও বুনোফুল উপত্যকা। পাহাড়ি সড়কটি এতোটাই বনানীময়, একটি সরলরেখায় আকাশটিই শুধু দেখা যায়। কোথাও কোথাও ভিউপয়েন্ট। নদী ও ঝর্ণা দেখা আড়ম্বর। গ্রিনওয়াটার পেরিয়ে আমরা আরও ঘনবনে ঢুকে যাই। রেইনারকে কেন্দ্র করে অজস্র পাহাড় নিয়ে গঠিত এই্ ক্যাসেকেড অরণ্যে অজস্র বৃক্ষ। শুনেছি পাইন ও স্প্রূস ফ্যামিলির বৃক্ষই আছে ১৩ প্রজাতির। এগুলো চিরসবুজ, কখনো পাতা ঝরে না। মাপল, ডগউড, বার্চ, রোজ ও উইলো ফ্যামিলির বৃক্ষের প্রজাতিও সমসংখ্যক। এগুলো ঋতুভেদে রঙ বদলায় ও পাতা ফেলে ও নতুন পাতা ধারণ করে।
মাউন্ট রেইনিয়ার ন্যাশনাল পার্কের দিকে না গিয়ে বামে ক্রিস্টাল মাউন্টেন বুলুভার্ডের শেষপ্রান্তে ক্রিস্টাল মাউন্টেন রিসোর্টে গিয়ে গাড়ি পার্ক করি। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রিসোর্ট ও বিনোদনকেন্দ্র। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে টিকে টঘর, গন্ডোলা স্টেশন, স্যুভেনির শপ, রেস্তোরা, বাথরুম। বরফের মৌসুমে তা দিবারাত্রি ভরে থাকে স্কিইআর তুষার স্পোর্টসম্যানদের ভিড়ে। এখন শরৎ পার্কিং লটগুলো ঝিমু্চ্ছে অলস অপরাহ্নে। আমাদের মতো মৌসুমী পর্যটকদের আনাগোনার অবশ্য বিরাম নেই।
কয়েকটি ছোট পাহাড় ও পাহাড়ি উপত্যকা পেরিয়ে ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চূড়ায় উঠতে গন্ডোলায় চড়ি। লাল ও সবুজ রঙের ৩০টি গন্ডোলা ঘূর্ণায়মান। ২৮ নম্বরটিতে চেপে মিনিট দশেকে সাতহাজার ফুট উঁচুতে উঠে যাই। গন্ডোলাগামী পর্যটক ও পাহাড়পুঞ্জের দূর্গম ট্রেইলে হাইকিংশেষে সামিটজয়ী পর্বতপ্রীতদের খাবার পাণীয় সেবায় উন্মুখ সামিট হাউজ রেস্তোরা। এই সামিটে চড়েছি ওয়াশিংটন স্টেটের প্রকৃতিসম্ভারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুকুট মাউন্ট রেইনিয়ারের অপরূপ শোভার আকর্ষণে। জীবন্ত আগ্নেয়িগিরিময় মাউন্ট রেঞ্জে স্কিইং,হাইকিং, ফিশিং, স্নোবোর্ডিং, হর্স রাইডিং, ক্যাম্পিংয়ের মতো নানা ট্যুরিস্ট এ্যাক্টিভিটি করা যায়। ১৪ হাজার ৪১১ ফুট উচ্চতার পর্বতটির কোমর সমান্তরাল থেকে পুরোটা দৃষ্টিগোচরে আনতে হলে স্ফটিক পর্বতে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। ক্রিস্টাল পর্বতের চূড়ায় উঠে কেউ রেস্তোরা চত্ত্বরের টেবিলে বসে পাহাড়টি উপভোগ করে, কেউ সামনের ইজিচেয়ার বা বেঞ্চে অদূরের মাউন্ট রেইনেয়ারে দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, কেউ আরেকটু নিচে নেমে হাইকিং করে। গন্ডোলার ল্যান্ডিং স্টেশনের দু’দিকে চেয়ারলিফটও আছে। তা খোলা হয় অন্য মৌসুমে।
আমরা ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চুড়া থেকে নিচে স্নোর্টিং এল্ক বোওল এর দিকে ও উল্টো দিকে পাউডার পাসের দিকে সামান্য হাইকিং করে আবার সামিট হাউসের সম্মুখে গন্ডোলা লোডিং স্টেশনে ফিরে এসে গন্ডোলায়।
আকস্মিক আবার দেখা হয় সেই শ্রশ্মগুম্ফমন্ডিত রেস্তোরাকর্মীর সঙ্গে। সে তখন আবর্জনার ব্যাগ ফিতেয় বেঁধে একাই এক গন্ডোলায় চেপে নিম্নগামী হচ্ছে। আমার মনে হয়, সে এ জগতে বসে এক ভিন্নজগতের বাসিন্দা। জীবনের কোন একটি লগ্নে পাহাড়প্রেমে মত্ত মানুষটি এসে উঠেছে এই সাতহাজার ফুট্ উচ্চতায়।