উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে দুইটার সময় সাব-৩৪০ বিমানে করে কঙ্গোর কাভুমু বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। ফ্লাইট টাইম এক ঘণ্টা বিশ মিনিট। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় বিমান মেঘের উপর দিয়ে চলছিল, নিচে তাই সাদা মেঘের সাগর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। মেঘের উপর ঝকঝকে সোনালি আলোতে ডানা মেলে উড়ছিল আমাদের বাহন। কাভুমু বিমানবন্দর সাউথ কিভু প্রদেশে এবং বুকাভু এই বিমানবন্দরের কাছের বড় শহর।ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো সেন্ট্রাল আফ্রিকার গ্রেট লেক রিজিওনের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র। এটা আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং সারা পৃথিবীতে আয়তনে ১১ তম। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশ আফ্রিকার মধ্যে চতুর্থ জনবহুল দেশ।
কঙ্গোর সাথে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি,জাম্বিয়া, এঙ্গোলা, কঙ্গো ব্রাজাভিলের সীমান্ত আছে। লেক টাংগানিকা কঙ্গোকে তাঞ্জানিয়ার থেকে আলাদা করে রেখেছে। পশ্চিমে ৪০ কিলোমিটার করিডোর দিয়ে কঙ্গো আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত। নানা ঘাত প্রতিঘাত, যুদ্ধ বিগ্রহ করে কঙ্গো বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটাতে এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে। এই দেশের মাটির নিচের সম্পদের লোভে হানাহানি আর রক্তপাত লেগেই আছে। এই বিশাল দেশটাতে কবে শান্তি আসবে তা কেউ জানে না। এক অনিশ্চিত জীবন নিয়েই এদেশের মানুষ তাদের দিন কাটাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালেই আমার এদেশে আসা হল।
স্থানীয় সময় দুইটা ত্রিশ মিনিটে আমাদের বিমান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের কাভুমু বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। আকাশ একটু মেঘলা থাকলেও বেশ আলো ছিল চারিদিকে। বিমানবন্দর একটা পাহাড়ের উপর এবং আসেপাশে সব পাহাড়ি এলাকা। ইমিগ্রেশানে একজন অফিসার বসে আছে, পাসপোর্ট নিয়ে এন্ট্রি সিল দিয়ে দিলেন।সব ফরমালিটিজ শেষ করে কাভুমু থেকে বুকাভুর দিকে রওয়ানা হলাম।
কাভুমু বিমানবন্দর বুকাভু থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, প্রায় এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ, এই পথ বুকাভু থেকে লেক কিভুর পাড় ঘেঁসে অনেকদুর গিয়ে পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে। পাহাড়ের উপর এই বিমানবন্দর। এর পাশেই কঙ্গোর সামরিক বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি। অনেক উঁচুতে বলে এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, চারিদিকে পাহাড় হলেও মাঝে বেশ ফাঁকা থাকার কারনে খোলামেলা পরিবেশ ও বাতাস চলাচল স্বাভাবিক।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে রাস্তাগুলো বেশ ভাল। পাহাড়ি পথে আমরা বিমানবন্দর থেকে কাভুমু শহরের দিকে চলছি। ছোট জনপদ, শহরের মাঝে একটা মোড় আছে, সেখানে কিছু দোকানপাট, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এসব দোকানে পাওয়া যায়। মোটর সাইকেল, সাইকেল ও মাইক্রবাসে সাধারণ মানুষ চলাচল করে। ঘরবাড়ি বেশিরভাগ ইটের দালান, টিনের চালা। মানুষজন আছে, মোটামুটি প্রাণচঞ্চল জনপদ। পাহাড়ের উঁচুনিচু পথে চলেছি, পাহাড়ি রোলিং কান্ট্রি সাইড বলা চলে এই এলাকাকে।
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে। এখানে মাঝে মাঝে ঘন বন আছে। রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল আছে, পাহাড় থেকে নিচে এবং দূরে মাঝে মাঝে জনপদ দেখা যায়। অনেক কলার বাগান আছে পাহাড়ের ঢালে। ছোট ছোট জনপদে পাকা ঘরবাড়ীও আছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এখানে পাওয়া যায়। সাউথ কিভু প্রদেশের সিকিউরিটি সিচুয়েসান তুলনামুলক ভাবে ভাল। মানুষের যানমালের কিছুটা নিরাপত্তা এখানে আছে। আলোকিত দিন, চমৎকার আবহাওয়া, আমরা গল্প করতে করতে চলছি। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল আরোহী দেখা যায়। এই পাহাড়ি পথে তারা বেশ কষ্ট করে সাইকেল দিয়ে যাত্রী ও মালপত্র পারাপার করে।
পাহাড়গুলো বেশ উঁচু এবং পাথুরে, চলার পথে অনেক পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে ট্রাকে তোলা হচ্ছে দেখতে পেলাম। আমাদের যাত্রাপথ এক ঘণ্টা, বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা পাহাড়ের নিচে লেক কিভুর অস্তিত্ব টের পেলাম। লেকের পাশ দিয়েই চলছে এই পাহাড়ি রাস্তা। লেক কিভুর শান্ত নীল পানি দেখে বেশ ভাল লাগল। আমরা এই লেক দেখব বলেই এত দূর থেকে এদেশে এসেছি। লেকের একপাশে রুয়ান্ডার জনপদ। দূর থেকে তা দেখা যায়। পথে একটা বেশ বড় চার্চ দেখলাম। অনেক এলাকা নিয়ে এর সীমানা।
পাহাড়ের নিচে কৃত্রিম লেক তার পাশে বাঁশবন, লেকের পানিতে পাহাড়ের উপর থেকে আসা সূর্যের আলো আর বাতাসে বাঁশপাতার মিলিয়ে বেশ সুন্দর আবহ এখানে। আশেপাশের পরিবেশ থেকে এই এলাকার আলাদা পরিবেশ নজরে পড়ে।
লেকের পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমরা বুকাভু শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি। দূর থেকে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠা এই শহর দেখা যাচ্ছে। বিকেলের সূর্যের আলো এখন শহরের উপর পড়ছে। বুকাভু শহরটা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের রাজধানী, সাউথ কিভু প্রদেশের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ। পাশের প্রদেশ নর্থ কিভুর রাজধানী গোমা, লেক কিভু বুকাভু থেকে গোমা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো একটা বিশাল দেশ, দেশটা আয়তনে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল গুণ বড়। ফরাসি এদেশের সরকারি ভাষা এর পাশাপাশি লোকজন স্থানীয় ভাষার ভাবের আদান প্রদান করে। সোহেলি ভাষা এবং রুয়ান্ডার ভাষা এরা বুঝে।
বুকাভু শহরের ভেতর জলপথে লেকে চলাচলের জন্য বন্দর আছে। এই বন্দর থেকে মালপত্র ও যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ও ছোট জাহাজ গোমা ও রুয়ান্ডার কিছু গন্তব্যে চলাচল করে। পুরো লেকটাই পাহাড়ের উপত্যকায়। এই লেকের গভীরতা কোন কোন জায়গাতে চারশত পঞ্চাশ মিটার। বেশ খাড়া পাড় বলে এখানে কোন প্রাকৃতিক বিচ বা বিনোদনের জায়গা নেই।
শহরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই বাড়ছে ভিড় ও ট্রাফিক জ্যাম। রাস্তা একটু খারাপ শহরের মধ্যে। মোটর সাইকেল কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চলে, তাই বেশ সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। আমাদের জেলা কিংবা মফস্বল শহরের মত এই বুকাভু শহর। সাধারনের চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল, সাইকেল আর মাইক্রবাস আছে। ভিড় এবং যাত্রী তোলার ধরন আমাদের দেশের লোকাল বাসের মতই। মানুষ গাদাগাদি করেই চলছে। অনেক নতুন মডেলের গাড়িও আছে এখানে। এই দেশে দুটো শ্রেণীর মানুষ আছে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত প্রায় নেই বললেই চলে।
শহরের শেষ প্রান্তে আমাদের থাকার জায়গা, পুরো শহরটা তাই দেখতে দেখতে চলেছি। কিভু লেকের কোন না কোন অংশ শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যায়। পাহাড়ি চড়াই উতরাই ভেঙ্গে উঁচু নিচু পথ নানা দিকে চলে গেছে। শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল স্বাধীনতা চত্তর। এখানে একটা বিশাল বৃত্তাকার আইল্যান্ড আছে। সেখানে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কঙ্গোর পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। এই জায়গাতেই সব ধরনের মিটিং মিছিল আর গণ্ডগোল শুরু হয় তারপর তা অন্যান্য জায়গাতে ছড়িয়ে যায়। চত্বরটা বেশি বড় হওয়াতে রাস্তা সরু হয়ে গেছে বলে এখানে ট্রাফিক জ্যাম লেগেই আছে, একটা বাসস্ট্যান্ডও এখানকার ভিড় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
শহরে আসতে আসতে প্রায় চারটা বেজে গেল, এই সময় সব অফিস আদালত ছুটি হয় বলে বেশ ভিড় থাকে শহরে। আমরা শহরটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে চললাম। অফিস পাড়ার দিকটা এখন প্রায় খালি হয়ে এসেছে। এখানে রাস্তাগুলো একটু চওড়া এবং তুলনামুলকভাবে ভাল। প্রাদেশিক দপ্তর, আইন মন্ত্রণালয় এবং কিছু প্রাশাসনিক ভবন দেখে আমরা গন্তব্যের পথে যাত্রা করলাম। এখানে উন্নয়নের কাজ চলছে, একটা চত্তরে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ হচ্ছে। এখানকার বাড়ি ঘরগুলোর শেষ তালার ছাদ টিনের চালা কিংবা টালি দিয়ে বানানো এবং উজ্জ্বল রঙ করা।
শহরে কিছু অংশ দেখে লেক কিভুর পেনিনসুলা এলাকায় এলাম। এখানেই আমাদের থাকার জায়গা। এখানে পাহাড়ের উঁচু থেকে লেকের দৃশ্য দেখা যায়, পড়ন্ত বিকেলের আলো শহর ছাড়িয়ে লেক ও তার আশ পাশ আলোকিত করছে। দূরের রুয়ান্ডার জনপদ ও এই আলোর ছটায় আলোকিত। এখানে সন্ধ্যার পর সাধারণত বাহিরে চলাচল কমে যায়। প্রায় বিদ্যুৎ থাকে না, যাদের সাধ্য আছে তারা জেনারেটর চালায়। মাঝে মাঝে পানির ও সমস্যা হয়। নিচে লেকে এত পানি তবুও বিদ্যুতের অভাবে পানি পেতে সমস্যা হয় এখানে।রাতে বিশ্ব কাপের খেলা দেখে ঘুমিয়ে গেলাম।
চলবে......