দিগন্ত জোড়া অবারিত সবুজ, যৌবনা পাহাড়ি ঝর্ণা, ছলছল শব্দে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলা পাহাড়ি ছড়া কিংবা উঁচুনিচু পাহাড়ি জঙ্গলী পথে হাঁটা হয় না অনেকদিন। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির আবাসের মধ্যে দিয়ে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে, বুনো ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে, বাঁধন হারা বাতাসে জুম ফসলের উদ্দাম নৃত্য দেখতে দেখতে পদব্রজে ভ্রমণের সেই আনন্দ শহুরে জীবনে কংক্রিটের পথে কই? তাই তো পাহাড়ে যাই, বার বার যেতে হয় পাহাড়ের ভালবাসার আহ্বানকে অগ্রাহ্য না করতে পেরে।
অনেকদিন থেকে পাহাড়যাত্রা হচ্ছিল না বিধায় আমার পাগলপ্রায় অবস্থা। বন্ধুদের বললাম, কোথাও না কোথাও যেতেই হবে! শহরে তো পাগলের অভাব নেই, ভ্রমণবন্ধু মনির ও রাজন এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে জুটলো নন ট্রেকার বন্ধু সোনিয়া। সোনিয়া ও আমার একসঙ্গে অনেক স্মৃতি, ক্লাসে সবসময় পাশাপাশি বসা হতো। ফাজলামো ও খুঁনসুটিতে পার করেছি ইউনিভার্সিটি জীবন। কিন্তু ওর ট্রেকিং-এ তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় খানিকটা শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও টিম ফাইনাল হলো, সদস্য মোট ৪ জন।
পাহাড় বলতে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের কথাই জানি। অনেকবার গিয়েছি এবং আরও অসংখ্যবার যেতে চাই অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে। কিন্তু কিছু বিচ্ছিনতাবাদীর কারণে ওই দিকে যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কয়েকজন ট্রেকার বন্ধুর নিকট খোঁজখবর করলাম কিন্তু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া গেল না। অতঃপর আমার খুব কাছের ক্লাসমেট খাগড়াছড়ির ছেলে তাতু চাকমার সঙ্গে আলোচনা করলাম পরিস্থিতি নিয়ে। সে খোঁজখবর করে পরামর্শ দিল এই সময়ে ওদিকটায় না যেতে।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, মৌলভীবাজারের সর্বোচ্চ স্থান কালাপাহাড়ে যাবো। শুধু মৌলভীবাজার নয়, পুরো সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় এটি, উচ্চতা মাত্র ১০৯৮ ফুট। আসলে সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ের উচ্চতা বেশ কম, পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল। তারপরও আমাদের মতই শখের ট্রেকারের কাছে সেগুলোও পাহাড়। কালাপাহাড়কে স্থানীয়ভাবে লংলা পাহাড় নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে কালাপাহাড়ের নাম 'হারারগঞ্জ পাহাড়' । এই পাহাড়ের বেশিরভাগ অংশ তা প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে পড়েছে এবং বাকি অংশ ভারতের উত্তর ত্রিপুরায় পড়েছে। এক বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে বিয়ানীবাজারমুখী এনা বাসের টিকেট কেটে রওনা হলাম, গন্তব্য কুলাউড়া। যদিও সিলেটগামী ট্রেনে গিয়েও কুলাউড়া নামা যায় তবুও আমরা বাসকেই প্রেফার করলাম। ভোর ৬টা নাগাদ কুলাউড়া নেমেই ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে ৩০০ টাকায় একটা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চললাম আজগড়াবাদ চা বাগানের উদ্দেশ্যে। সিএনজিচালক বাদশা মিয়া বেশ সদালাপী, চলতি পথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। ফোন নম্বর দিয়ে রাখলো, ফিরতি পথে যদি সিএনজি না পাই তাহলে যেন উনাকে ফোন করি। যাত্রা পথে এক জায়গায় খানিক দাঁড়িয়ে কিছু শুকনো খাবার আর পানি নিলাম কারণ ট্রেকিং রুটে কোথাও কিছু পাবার সম্ভাবনা নেই। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টার ট্রেক তাই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সকাল ৮টা নাগাদ আজগড়াবাদ চা বাগানের মধ্য দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো, ততক্ষণে কেউ কেউ বাগানে কাজ শুরু করে দিয়েছে আবার কেউবা দ্রুতপায়ে আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জুম ক্ষেতে কাজ করবে বলে। চা বাগানটা বেশ বড় তবে তেমন সুন্দর নয়, তারপরও অবারিত সবুজে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। চা বাগানের মধ্যেই বিশাল এক বট গাছ, দেখে বাকিরা ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর আমার দায়িত্ব তা তুলে দেওয়ার। চা বাগান শেষ হতেই উঁচু নিচু পথের শুরু হলো, চলতি পথে পার হতে হলো বেশ কয়েকটি পাহাড়ি খাল। খালের ওপর রয়েছে বাঁশের সাঁকো, একটা তো বেশ দুলিয়ে দিলো। তবে রক্ষা যে সাঁকোগুলো এক বাঁশের নয়। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সরকারি সহায়তায় তৈরি বড় একটা কংক্রিটের সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা বেগুনছড়া পুঞ্জিতে পৌঁছলাম। এটা একটা খাসিয়া গ্রাম, গ্রামের প্রায় বাড়িঘরই পাঁকা। আধুনিকতার সকল ছোঁয়াই বিদ্যমান, মোটামুটি বেশিরভাগ বাড়ির ছাদে আকাশ কিংবা টাটা স্কাই দেখতে পেলাম। বোঝা গেল পানের ব্যবসা করে বেশ আছে উনারা। গ্রামে মোট ৩৫টি ঘর রয়েছে, কমবেশি ২৫০ জন লোকের বাস। সবাই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী এবং গ্রাম একটু সুদৃশ্য চার্চও রয়েছে।
বেগুনছড়া পুঞ্জিতে পৌঁছে আমরা গাইডের খোঁজ করতে লাগলাম, বিভিন্ন মারফত জানতে পেরেছিলাম বেগুনছড়া পুঞ্জিতে গাইড পাওয়া যায়। কিন্তু এই গ্রামে কোন গাইডের দেখা পেলাম না, গ্রামের কেউ গাইডের কাজ করে না। অগত্যা অনেক অনুরোধ করে জুমের জমিতে কাজ করে এমন এক শ্রমিককে সঙ্গে নিলাম পথ দেখানোর জন্য। এদিকে যারা আসবেন তারা আজগড়াবাদ নেমেই পথ দেখানোর জন্য কাউকে খুঁজে নিবেন। কমবেশি ৫০০ টাকার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। যাইহোক, আমাদের গাইড বাবুলকে নিয়ে শুরু হলো আমাদের প্রকৃত জঙ্গল যাত্রা। বেগুনছড়া গ্রাম ছাড়াতেই রাস্তা দুই দিকে বেঁকে গেছে, বামেরটা ছড়ায় গিয়ে মিলেছে দেখে আমরা ডানেরটা ধরলাম। ঠিক হলো ফেরার পথে আমরা ছড়ার রাস্তা দিয়ে ফিরবো। শুকনো পাতা মাড়িয়ে সরু পথ ধরে আমরা যাচ্ছি কালাপাহাড়ের চূড়ায়, দুধারে ছাড়িয়ে যাচ্ছি খাসিয়াদের পানের বাগান, ফলজ বাগান কিংবা ঘন জঙ্গল।
মানুষের তেমন চলাচল নেই বিধায় পথটা বেশ সরু এবং লতা-গুল্মোয় ভরা। তবে পাহাড়ের প্রায় সকল বড় গাছেই পান গাছের সহাবস্থান দেখে বুঝা যায় পাহাড়ের পুরোটাই খাসিয়াদের শস্যভূমি। জুলাই-আগস্টের দিকে ওদিকটায় গেলে সাথে পথ দেখানোর কেউ না থাকলে পথ খুঁজে চূড়ায় যাওয়া মুশকিল। যত উপরের দিকে উঠতে থাকবেন তত মনুষ্য চিহ্ন কমতে থাকবে, চলতি পথে সুনসান নিরবতার ব্যাঘাত ঘটাবে পাখি কিংবা পোকামাকড়ের ডাক। পথিমধ্যে অবশ্য দু-চার জন মানুষেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে। কাউকে হয়তো কাঁধে করে কাঠ, কাউকে বাঁশ আবার কেউকে মাথায় জুমের ফসল নিয়ে ফিরতে দেখতে পারেন।
বেগুনছড়া থেকে যাত্রা শুরুর পর বেশ কিছু পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আনুমানিক ঘণ্টা দেড়েক পর আমরা মূল পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছলাম। সেথায় দাঁড়িয়ে গাছ-গছালির ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের চূড়া চিহ্নিত করার চেষ্টা করলাম। চূড়া বলতে আলাদা করে ঠাওর করার উপায় নাই কারণ পুরোটাই ঘন জঙ্গল, বাঁশ আর গাছে ভরা। আজ ভীষণ গরম পড়েছে, সূর্যও যেন মাথার কয়েক হাত উপরে অবস্থান করছে। উচ্চতা বেশি না হলেও সবার অবস্থা মোটামুটি কাহিল। মাঝে মাঝে বাতাসের শব্দ পাওয়া গেলেও গাছপালা পার করে আমাদের শরীর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেনা বলে কষ্টটা বেশি হচ্ছিল। তাছাড় আলসে বনে যাওয়া শরীর হঠাৎ এমন চাপ সইতে চাইছেনা। বন্ধু সোনিয়ার অস্বস্তি কিছুটা বেশি হওয়ায় গাইডসহ ওকে বসিয়ে রেখে গাইডের থেকে পথ নির্দেশনা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো চূড়ার পথে। খানিকটা এগোতেই দেখলাম রাস্তা দুই দিকে বেঁকে গেছে, রাস্তা বলতে তেমন করে আলাদা করা যায় না কষ্ট করে বুঝে নিতে হয়।
প্রথমেই গাইডের নির্দেশমতো ডানের রুটে চলা শুরু করলাম, আধা ঘণ্টা চলার পর পথ শেষ হয়ে গেল। চিপস আর জুসের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলাম জায়গাটায় আমাদের আগেও অনেকে এসেছে। জায়গাটার একটা ভিউ পয়েন্ট আছে বটে তবে তেমন কিছু নয়। গাইডের মতে এটাই চূড়া কিন্তু চূড়া হিসেবে স্থানটিকে আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। অগত্যা ফিরতি পথ ধরে ফিরে এসে ফেলে যাওয়া বামের রুটটা ধরলাম। আমাদের গাইড বামের পথটায় যেতে বারণ করেছিল, বলেছিল এই পথ অনেক ভিতরে নিয়ে যাবে আর সময়ও লাগবে অনেক বেশি। মাথায় তখন চূড়ায় যাবার নেশা, হাতরে-পাতরে জঙ্গল সরিয়ে আমাদের এডভেঞ্চার চলতে থাকলো। পথিমধ্যে রাজন তার মোবাইলে ডাউনলোডকৃত ম্যাপে চূড়া খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে। আমি আর বন্ধু মনির হাঁটু সমান জঙ্গল পেরিয়ে চলা শুরু করে দিয়েছি। পিছন থেকে রাজন আমাদের গাইড করছে। খানিকক্ষণ চলার পর খুব সুন্দর একটা বাঁশবাগান পড়লো, বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলে আবার যাত্রা উঠতে লাগলাম, জায়গাটা কিছুটা অন্ধকার এবং সুনসান। এবার রাজন আমাদের আগে আগে চলতে লাগলো, বাঁশবাগান পেরিয়ে খানিক উঠতেই খোলা আকাশের দেখা পেলাম। রাজনের ম্যাপ অনুযায়ী এটাই চূড়া। চারিদিকে তাকিয়ে আর কোন পাহাড়ের উঁচু দেখতে পেলাম না। জায়গাটা একেবারে জঙ্গলে ভর্তি, মোটামুটি কোমর সমান জঙ্গল। পুরো এলাকাটা হাতি তছনছ করে রেখেছে, হাতির মল চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাঁশের ঝাঁড় পর্যন্ত মুচড়ে রেখেছে, ধ্বংসের চিহ্ন দেখে হাতির বিশালতার ধারণা পেলাম। ডানে-বামে কিছুটা ঘুরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিচে সোনিয়াকে বসিয়ে রেখে এসেছি প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হলো। রাজন আরও খানিকা এলাকা ঘুরে দেখতে চাইলেও বারণ করলাম পাছে আবার বুনো হাতির পাল্লায় পড়ি। ফিরতি পথে লক্ষ্য করলাম জোঁক আমার পায়ে চুম্বন এঁকেছে আর সেই খুশিতে আমার পা থেকে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা। পাহাড়ে আসি প্রকৃতির ভালবাসায় আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারি না বলে আর পাহাড়ে আসলে এরকম দু-একটা ভালবাসার নিদর্শন একেবারে অযাচিত নয়।
মাথায় করে গনগনে সূর্য নিয়ে নিচের দিকে নামছি। গাছপালার থাকলে তো সমস্যা নেই, তবে ন্যাড়া অংশে পৌঁছলে চামড়া পুরিয়ে দিচ্ছে সুর্যি মামা। ইতিমধ্যে পানিও শেষ। তড়িঘড়ি করে নেমে এসে গাইডকে বললাম পানির ব্যবস্থা করতে। গাইড বোতল হাতে নিয়ে লাফিয়ে চলে গেল ছড়ার দিকে পানি আনতে। নিকটস্থ ছড়া থেকে পানি নিয়ে আসার পর সেই পানিতে তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিরবো ছড়ার পথ দিয়ে। গাইড দা দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে আমাদের নিয়ে চললো। পথ একেবারে খাড়া নিচের দিকে, পথ বলতে তো কিছু নেই। গাইড যেদিক দিয়ে নামাচ্ছে আমরা সে পথেই নামছি। কিছু কিছু জায়গার তো মাটি বেশ আলগা আবার কোথাও খানিক পিচ্ছিল, বেশ সাবধানে নামতে হচ্ছে আমাদের। বেশ অনেকক্ষণ খাড়া উঠা-নামার পর আমরা পাহাড়ি ঝিরি বা ছড়াতে এসে পরলাম। তৃষ্ণার্ত আমরা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার এবং চলমান পানির ধারা থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করলাম। অতঃপর খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ছড়ার ঠান্ডা পানির মধ্য দিয়ে ফিরতে থাকলাম। পথে অনেক মানুষ দেখতে পেলাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাজ থেকে ফিরছে। কয়েকজনের সাথে কথাও হলো, অনেকেই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞসা করলো আমরা কালাপাহাড়ে গিয়েছিলাম কি না!
বৃষ্টি তেমন না হওয়াতে ছড়ায় তেমন পানি নেই। ছড়ার পানিতে গোসল করতে চাই যেনে গাইড একটা অপেক্ষাকৃত গভীর অংশে নিয়ে গেল যেখানে বেগুনছড়া পুঞ্জির লোকজন গোসল করে। খুব বেশি গভীর নয়, কোন রকম গা ভেজানো যায় আর কি, তাতেই আধা ঘণ্টার উপরে শুয়ে থাকলাম। সবার গাত্রদাহ কমলে কাপড় পাল্টিয়ে দ্রুত পা চালাতে থাকলাম। ততক্ষণে আকাশ নিকষ কালো হয়ে এসেছে, নির্ঘাত ঝাপিয়ে বৃষ্টি নামবে……