অনেক দিন পাহাড়ে যাওয়া হয়না, আমি আর বন্ধু প্রতিম মনির ভাই মিলে মাঝে মাঝেই আলাপ করি কোথায় যাওয়া যায়! শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় সান্দাকফু-ফালুট প্ল্যান, হিমালয়ান রেঞ্জে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার পথ। এর আগে দেশের পাহাড়ে ট্রেক করেছি, এবার একেবারে বিদেশের পাহাড়। ছেলেবেলায় কোন এক বইয়ে সান্দাকফুর বর্ননা পরে মনে গেঁথে গিয়েছিলো, সম্ভবত বইটির নাম গর্ভধারিনী। প্রায় ১২০০০ ফিট উচ্চতার সান্দাকফু ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সবথেকে উঁচু স্থান | দার্জিলিং জেলার সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক এর পাশে পশ্চিমবঙ্গ- কিম বর্ডার এর কাছেই সান্দাকফু। বিগেনার্সদের জন্য এটি একটি স্বীকৃত ট্রেক রুট। এখান থেকে পৃথিবীর সর্বচ্চো কিছু শৃঙ্গ যেমন মাউন্ট এভারেস্ট , কাঞ্চনজঙ্ঘা , লহটসে , মাকালু এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় এবং অপার সৌন্দর্যের লীলাভুমি এই ট্রেক রুট |আমাদের উদ্দেশ্য পায়ে হেঁটে হিমালায়ান রেঞ্জের সৌন্দর্য উপভোগ করা। শুধুমাত্র চোখ ধাঁধানো সৌন্দের্যের জন্যই নয়, হিমালয়ান রেঞ্জের উচ্চতা ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় নিজের যোগ্যতা যাচাই করার জন্যেও এই ট্রেকটি উত্তম। মার্চ থেকে মে মাসের দিকে গেলে আপনাকে স্বাগত জানাবে নানান রঙের রডোডেনড্রন, মনভুলানো ম্যাগ্নোলিয়া আরও কত বাহারি ফুল, যার রঙ ও রুপ দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য হবেন।
বেশ কয়েকবার ডেট চেঞ্জ করে শেষ পর্যন্ত এপ্রিলের ২৯ তারিখ যাবার দিন ঠিক হলো, রুবেল নামের এক ছোট ভাইও সঙ্গী হলো। রুবেল সাত বছর আগে একবার গিয়েছিলো এই ট্রেকে, এরপর থেকে যাবার প্ল্যান করছে কিন্তু যেতে পারেনি তাই আমার ফোন পেয়ে ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে রেডি।
প্ল্যান অনুযায়ী ২৯ এপ্রিল রাতে শ্যামলীর বাসে করে বাংলাবান্ধা বর্ডার দিয়ে শিলিগুরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ২৯ তারিখ রাতে রওনা হয়ে পরদিন সকাল ৯টা নাগাদ বাংলাবান্ধা পৌঁছলাম। বাংলাবান্ধা বর্ডারের অবকাঠামো খারাপ ভালই তবে খারাপ লাগলো ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের লোকেরা সরাসরি ঘুষ দাবী করে বসলো। একই অবস্থা ভারতীয় অংশেও। যাইহোক বর্ডারের ঝামেলা চুকিয়ে একটা অটো নিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেলাম। শিলিগুড়ি পৌঁছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক দাদার হোটেলে মাটনকারি দিয়ে ভাত খেয়ে মানেভাঞ্জন যাবার জন্য ২৫০০ রুপিতে একটা জীপ ঠিক করলাম। শুরু হলো আমাদের স্বপ্নযাত্রা ।
শিলিগুড়ি শহর ছাড়াতেই যাত্রার ক্লান্তি সব উবে যেতে থাকলো, হাইওয়ের পাশ ঘেঁষে চা বাগান আর দিগন্তে পাহাড়সারি চোখে আশ্চর্য প্রশান্তি এনে দিলো। নেপালি ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলাম একটা ভালো চায়ের দোকানে থামাতে, সে নিয়ে থামালো মিরিকের অসম্ভব সুন্দর গোপালধারা চা বাগানে।
চা বাগানের সাথেই একটি টি স্টল আছে, সেখান থেকে চা নিয়ে বাগানে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে চা পান করে কিছু ছবিটবি তুলে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। সবমিলিয়ে সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময়ে বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ আমরা মানেভাঞ্জন পৌঁছলাম। মানেভাঞ্জন পৌঁছে প্রয়োজনীয় পারমিট এবং গাইড এ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রতিদিন ১ হাজার রুপি হারে গাইড নিয়ে নিই। পরদিন সকাল সকাল আমাদের যাত্রা শুরু করার উত্তেজনা নিয়েই ঘুমুতে যাই জীবন ছেত্রির মালিকানাধীন হোটেল এক্সটীকার বিছানায়। জীবন ছেত্রি একসময় হিমালায়ান মাউন্টেনিয়ারিং এসোসিয়েশনের টিচার ছিলেন বলে সবাই উনাকে মাস্টারজি বলে থাকেন।
সমুদ্রতল থেকে মানেভাঞ্জনের উচ্চতা ৭০৫৪ ফুট, ঠান্ডাও বেশ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে চেক আউট করে একটা রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট সেরে চলে গেলাম সিঙ্গালিলা ফরেস্ট ভিজিটর সেন্টারে। সেখানে বিস্তারিত পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হলো। প্রত্যেকের জন্য ফি দিতে হলো ১০০ রুপি৷ স্টিল ক্যামেরার ফি ১০০ রুপি। আপনার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা থাকলে তার জন্য দিতে হবে ৪০০ রুপি৷ বনবিভাগের ফর্মালিটিজ সেরে সকাল ৯ টা ৩০ মি. নাগাদ যাত্রা শুরু করলাম পাইন বনের মধ্য দিয়ে। জানিনা কেন জানি পাইন বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে আমার বেশ লাগে। প্রথম দিন আমাদের টার্গেট মানেভঞ্জন টু তুমলিং (১৩ কিলোমিটার) যার মধ্যে প্রথম ৩ কিমি পুরোটাই খাড়া বাকি পথ চড়াই-উতড়াই মিলিয়ে। আমাদের সবারই এই ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি ছিলো। ট্রেক-এ আসলে মানসিক প্রস্তুতিটাই আসল, আর এটা থাকলে যত কষ্টই হোক না কেন আপনি লক্ষ্যে পৌঁছবেনই। যাইহোক যাত্রার প্রথম ৩ কিমি পেরিয়ে চিত্রে তে পৌঁছাতে প্রায় জিহ্বা বেরিয়ে যাবার জোগার হলেও আমরা বেশ কম সময় প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম চিত্রে-তে। এই পথটুকু আসতে অনেকের ৩ ঘন্টা সময় লাগে, তাই আমাদের পারফর্মেন্সে আমরা বেশ সন্তুষ্ট হলাম। নরম সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত ছোট ছোট টিলায় পরিপূর্ণ, অসাধারণ সুন্দর জায়গা এই চিত্রে।
চিত্রে পৌঁছেই হক’স নেস্ট ক্যাফেতে ঢুঁকে কফি অর্ডার করলাম, কফি তৈরি হবার ফাঁকে ক্যাফের জানালায় চোখ রেখে প্রাণ ভরে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। আর ভাবতে থাকলাম এই সবুজ পাহাড়ে যদি আমার বাড়ি হতো তাহলে বেশ হতো।
ক্যাফের মালিক সুস্মিতা দিদি আমাকে আর বেশি ভাবতে দিলনা বাগড়া দিয়ে বলল “দাদা আপনাদের কফি রেডি”। আয়েশ করে কফি পাণ করে দিদির সাথে ছবি উঠিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পরলাম। বেরিয়ে বেশ খানিক ছবি তোলা হলো, জোর হাওয়া বইছিল তাই শরীরটাও জুড়িয়ে গেলো। চোখ ভরে সবুজ ভ্যালী দেখে মেঘমার পথে পা বারালাম। চিত্রে থেকে মেঘমার দূরত্ব ৬ কিমি আর মেঘমার উচ্চতা ৯৫১৪ ফুট। কেউ ইচ্ছে করলে পাকা সড়ক দিয়েও ট্রেক করতে পারে, কিন্তু ট্রেকারদের রুটে না হাটলে চরম মিস।
এই পথে যেতে আপনার চিত্ত চঞ্চল হয়ে বাধ্য, একটু ভাবুক হয়ে দু-এক লাইন কবিতাও লিখে ফেলতে পারেন। পায়ের নিচে সবুজ গালিচা, মাথার উপর চঞ্চলা মেঘ দিগন্তজোড়া পাহাড়সারি আপনাকে পাগল করে দিবে। যারা গাড়িতে করে যায় তারা এই সৌন্দর্যের কথা চিন্তাও করতে পারবে না কারণ ট্রেক রুটগুলো একটু বেশি সুন্দর, একটু এডভেঞ্চারাস। কখনও সবুজ মখমলে পা রেখে, কখনও মেঘের ভেলায় ভেসে আবার কখও রুক্ষ পাথর পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম মেঘমার পথে।
চিত্রে থেকে রওনা হয়ে নেপালি গ্রাম লামেধুরা হয়ে হয়ে আগাতে থাকলাম মেঘমার পথে। কিছুদূর আগাতেই ঘন মেঘ আমাদের ছেয়ে ফেললো, মেঘমার কাছাকাছি আসতেই দৃষ্টিসীমা কয়েক মিটার হয়ে গেল। অনেক লেখায় পরেছি মেঘমাতে ঘন মেঘ আলিঙ্গন করে, আমরাও তাই পেলাম। আসলে মেঘমা নামটাই এসেছে মেঘ থেকে তাই মেঘের আলিঙ্গন খুবই স্বাভাবিক। মেঘমা পৌঁছেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারলাম পেটে কিছু দানাপানি দিবো বলে, রেস্টুরেন্ট মালিক নুডুলস অফার করলো কারণ এটাই সবথেকে কম সময় তৈরি করা যার। রেসেটুরেন্টে বসে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকলাম যদিও ঘন মেঘের কারণে দৃষ্টিসীমা মাত্র কয়েক হাত। বেশ দ্রুততায় আমাদের নুডুলস সার্ভ হলো, ধোঁয়া ওঠা সুপি নুডুলস। খেতে বেশ লাগলো, খেয়ে আর সময় নষ্ট করলাম না রওনা হয়ে গেলাম তুমলিং এর পথে। ঘন মেঘের কারণে ল্যান্ডস্কেপ কিছুই উপভোগ করতে পারলাম না।
যাইহোক কখনও ভারত আবার কখনও নেপাল করতে করতে হেঁটে চললাম মেঘমার পথে। পথে পরিচয় হলো এক ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ জুটির সাথে, ওরাও আমাদের রুটেই ট্রেক করবে। গল্প করতে করতে এগোতে থাকলাম আমরা একসাথে, ওরা যখন আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গেল তখন শুধু তাকিয়েই থাকলাম কারণ পাহাড় বাওয়াতে ওদের গতি অনেক বেশি। হেলতে দুলতে বিকেল নাগাদ আমারা তুমলিং এসে পৌঁছলাম।
রাতে থাকার জন্য ঠিক হলো সিদ্ধার্থ লজ নামের একটি নেপালি হোটেল। তুমলিং এর পাকা সড়কটি পরেছে ভারত অংশে আর সড়ক লাগোয়া হোটেলগুলো পরেছে নেপাল অংশে। মানেভভাঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত বেশ খানিকটা পথ আমাদেরকে নেপালের ভিতর দিয়েই ট্রেক করতে হবে। এখানে নেই কোনো কাঁটাতার, নেই কোনো সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি। হোটেল চেক ইন করে ব্যাগপ্যাক রেখে ফ্রেশ হয়ে একটু হাঁটতে বের হলাম। পথে পরিচিত হলাম কোলকাতার এক দম্পতির সাথে। ভদ্রলোক বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণাই রাখেন, বাংলার প্রফেসর তো তাই আমাদের সাহিত্যের অনেক খবরই রাখেন। আমাদের দেশের হুমায়ুন আহমেদের বিরাট ফ্যান তিনি। ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষ নাকি বাংলাদেশের আর এখনও এদেশে উনার অনেক বন্ধু রয়েছে শান্তিনিকেতনে পড়াশুনার সুবাদে। ভদ্রলোক বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতেই বললেন ভারত বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা হলে নাকি উনি বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করেন আর এনিয়ে নাকি উনাকে অনেক কথাও শুনতে হয়। এসব কথা যখন বলছিলেন তখন পাশে দাঁড়িয়ে উনার স্ত্রী মুচকি মুচকি হাসছিলেন, ভদ্রমহিলাও শান্তিনিকেতনে পড়ালেখা করেছেন। দেশের বাহিরে দেশের এরকম ভক্ত পেলে হাজারও হতাশার মাঝে সম্ভাবনার আলো দেখতে পাই। সন্ধ্যা শুরু হতেই জোর হাওয়া শুরু হয়ে গেল, আর ঠান্ডায় আমাদের কাপাকাপি শুরু হয়ে গেল। রাত ৮টা আন্ডাকারি দিয়ে ডিনার সেরে বিছানায় গেলাম, একটা কম্বল ২টা ভারী লেপ গায়ে দিয়েও শীত লাগতে লাগলো। ভোরের আলোয় কাঞ্চঞ্জঙ্গা দেখবার আশাবাদ দিয়ে ঘুমুতে গেলাম।
পরের পর্বেঃ তুমলিং-সান্দাকফু ট্রেক অংশ