হাওর ও গ্রামপর্যটন বিস্তারে জালালপুর ইকো রিসোর্ট

বিবিধ, ট্রাভেল

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 21:04:52

‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার মাধ্যমে শহুরে বন্ধুকে গ্রামে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। যন্ত্রনির্ভর এযুগে গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা নেওয়ার হাতছানি দিচ্ছেন কিশোরগঞ্জনিবাসী এক ভ্রমণপ্রিয় উদ্যোক্তা, নাম তার কিমওয়া সাদ্দাত। নিজে ব্যাংকিং পেশাদার এবং শহুরে হলেও পৈত্রিকবাস ও গ্রামজীবনকে ভোলেননি। শহরের পর্যটনপ্রিয় মানুষকে গ্রাম দেখাতে পিতৃভিটায় গড়ে তুলেছেন জালালপুর ইকো রিসোর্ট। রিসোর্টকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর ও গ্রামপর্যটন বিকশিত হচ্ছে। সম্প্রতি এ প্রতিবেদক কিশোরগঞ্জের নিকলি হাওর, বাংলার মসনদে আলা ঈসা খাঁর দুর্গ জঙ্গলবাড়িসহ জেলাশহরের পর্যটন স্পটগুলো সরজমিন ঘুরতে গিয়ে চমৎকার এই রিসোর্টের সন্ধান পান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঢাকাসহ নানা জেলার ভ্রামণিকরা গ্রাম পর্যটনে উৎসাহিত হয়ে এখানে যেমন আসছেন, স্থানীয়রাও তেমনি দিন দিন ভ্রমণের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন।

ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী একশো কিলোমটার। খিলক্ষেত থেকে তিন থেকে সাড়ে তিনঘণ্টায় কটিয়াদী পৌঁছানো যায়। উপজেলা থেকে জালালপুর ইউনিয়ন সদর সাড়ে তিন কিলোমিটার। ইউনিয়ন পরিষদ ও হাইস্কুলের পাশেই ইকো রিসোর্ট। বিস্তীর্ণ মাঠ, প্রবহমান নদী আর সবুজসুন্দর গ্রামের মধ্যে শহুরে আধুনিক স্থাপত্য আর সুবিধাদিতে নির্মিত রিসোর্ট যেন দৃষ্টিনন্দন গ্রামের মুকুটে একখণ্ড খচিত মুক্তা। গ্রাম্য রাস্তাটি খুব ভালো না হলেও ইজিবাইক কিংবা গাড়িতে পৌঁছানো যায়। জালালপুর সড়কটিতে মেরামতের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

সবুজঘেরা সুইমিং পুল

 

রিসোর্টের মূল ভবন, কটেজ, মাড হাউজ বা তাবুতে থাকা, তিনবেলা খাওয়াসহ ইজিবাইকে গ্রামপর্যটনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শহুরে মানুষকে শহুরে আয়েশের সঙ্গে গ্রামীণজীবনের মিশেলে এক ফিউশান ট্যুরিজমের উদ্যোগ অনুভব করা যায় এখানে এলে। গ্রাম্য পুকুরে মাছ ধরা, লাঙল চালানো, গ্রামে হাঁটাহাঁটির গাইডেড ট্যুরসহ গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার নানা রকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

শনিবার দুপুরে রিসোর্টটির কাছে পৌঁছতেই গেটমুখে নজর কাড়ে কাঠের ওপর খোদাই করে বানানো রিসোর্টের সাইনবোর্ড। তখনও এর আসল রূপটি ধরতে পারিনি। গ্রামে বেড়াতে এলে যেরকম গ্রাম্য জীবনের হাতছানি থাকে, প্রথমে সেটাই মনে করেছিলাম। ভেতরে গাড়ি ঢোকার পর সবুজ চত্বর পেরিয়ে মূল ভবনে ঢুকতেই কর্মীরা নিয়ে আসে ওয়েলকাম ড্রিংকস। গ্রামের নারকেল গাছের কচিডাবের রস লোগোওলা গ্লাসে পরিবেশন করা হয়েছে। কৃত্রিম পানীয়ের বদলে প্রাকৃতিক গ্লাসভর্তি ডাবের রসে তৃপ্ত হয়ে ক্রমশ বুঝতে শুরু করি রিসোর্টের নামে ‘ইকো’ শব্দ যোগ করার মাহাত্ম্য। আসল চমক অপেক্ষা করছিল মধ্যাহ্ন আহারে। গ্রুপ ট্রিপটির আয়োজন করেছিলেন ট্যুর কোম্পানি হলিডেয়ার-এর স্বত্বাধিকারী ডালিয়া হোসেন। আগে থেকেই রিসোর্ট সম্পর্কে তিনি সম্যক জানেন। বললেন, ‘পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়’।

ভর্তা পঞ্চদশ

 

ইকো রিসোর্টের আসল রূপটি ধরা পড়তে থাকে মধ্যাহ্ন আহারের সময়। গ্রামীণ সবুজ আর বিস্তীর্ণ মাঠের কোলঘেঁষে নির্মিত সুইমিং পুলে গোসল শেষ করলেই ডাক পড়ে মধ্যাহ্ন আহারের। মূল ভবনের নিচতলায় ‘জালালপুর কিচেনে’ ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় পর্যটকদলের। গোলাকৃতি তিনটি পাত্রের পনেরটি খোপে পনের রকমের ভর্তা। কয়েক রকমের আঁচার, ফ্রুট সালাদ আলাদা আলাদা পাত্রে। ভর্তা তালিকায় লইট্টা, তেলাপিয়া, ঢেড়শ, ঝিঙা, ডাল, ধনেপাতা, ডিম, পেঁপে, কাঁচকলা, বেগুন, আলু, টেপা শুটকি, টমেটো ইত্যাদি। চিনিগুঁড়া চালের ভাতের সঙ্গে আরো রয়েছে রুইমাছের ভুনা, দেশি মুরগির ঝোল আর পাতলা ডাল। প্লেটে সাদাভাতের চারপাশে চা চামচের এক চামচ করে ভর্তা নিয়ে যে দৃশ্য তৈরি হলো, তা খাওয়ার আগে দেখাও একটা কাজ হয়ে দাঁড়াল। মুখে দেওয়ার পর বোঝা গেল অমৃতের স্বাদ। যারা পাতে একবার ভাত নিয়ে কিছুটা রেখে দেয়, তারাও আজ দু তিনবার করে ভাত তরকারি নিয়ে উদরপূর্তি করল। রিসোর্টকর্মীরা জানাল, গ্রামীণ মাটির চুলায়, গ্রাম্য লাকড়িতে এই রান্না হয় বলে এর স্বাদ শহুরে খাবারের চেয়ে আলাদা।

ভাত খাব না ভর্তা?

 

উদরপূর্তি করে বিশ্রাম নিতে কক্ষ খুলতে গিয়ে দেখি, যে চাবি দিয়ে রুমের তালা খুলছি, তার সঙ্গে লাগানো কাঠের টুকরোয় খোদাই করে রিসোর্টের লোগো বসানো। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল টুথব্রাশ, পেস্ট, শ্যাম্পু, মিনিসোপ দিয়ে সাজানো বাঁশের তৈরি গোলাকার ডালা। সবকিছুতে জালালপুর ইকো রিসোর্ট লেখা লোগো। যে লোগোতে, গ্রামীণ ঘরকে ঘিরে আছে এক নারেকলবীথি আর লতাগুল্মের সবুজ দুটি পাতা, যার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে উদীয়মান সূর্য-আবহমান গ্রামবাংলার এক চিরচেনা রূপ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর