পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তুলে ক্যাপশন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তেমনি আইফেল টাওয়ার, দিল্লি গেট, তাজমহল কিংবা স্ট্যাচু অব লিবার্টির সঙ্গে তোলা ছবি পোস্ট করার সময় ক্যাপশন দেওয়া লোকের সংখ্যা যৎসামান্যই।
এসব স্থাপনা দেশগুলোর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব স্থাপত্য নিয়ে পোস্ট দেওয়া কিংবা এসব স্থাপনা দর্শনের স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে দেশের নাম লেখার প্রয়োজন পড়ে না। কুয়ালালামপুর গেছেন টুইন টাওয়ার দেখতে যাননি, প্যারিস গিয়ে আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন করেননি—এমন লোকের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর যদি পাওয়াও যায় তবে নিশ্চিতভাবে তিনি অভাগা!
‘আইকন’ স্থাপনা একটি দেশকে তার পর্যটন খাতে বাড়তি সুবিধা দেয়। দেখা যাবে এক শ্রেণির পর্যটক আছেন যারা কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করে আইকন স্থাপনা দেখতে ছুটে যান। শুধু গিয়েই ক্ষ্যান্ত হন তা নয়। সেখানে গিয়ে সেল্ফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানাচ্ছেন। সেই সব পোস্টে হামলে পড়ছেন তাদের বন্ধুবান্ধব ও ফলোয়াররা। এভাবেই দিনে দিনে বিশ্বজুড়ে একেকটি দেশকে ব্র্যান্ডিং করছে তাদের আইকন স্থাপনা।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চীনের প্রাচীরে গেছেন কিন্তু ছবি পোস্ট করেননি এমন পর্যটক খুঁজে মেলা ভার। কিন্তু অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের মালিক বাংলাদেশ। যেখানে রয়েছে পাহাড় ও জলরাশির মেলবন্ধন, প্রশস্ত সৈকতের সাদা বালুতে আছড়ে পড়ে উত্তাল জলরাশি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টও বাংলাদেশে। তার অপার সৌন্দর্যের কথাও বলে শেষ করা যাবে না—রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চারণভূমি, বিপুল জীববৈচিত্র্যের আধার অপরূপ সুন্দরবন।
আবার সারা বিশ্বকে যে মানুষটি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নিজের নেতৃত্ব গুণে, ভালোবেসে যাকে বাংলার রাখাল রাজাসহ নানান নামে অভিহিত করা হয়। যিনি তাবত বিশ্বের রাজনীতিবিদের কাছে ছিলেন বিস্ময়, সেই বাঙালি জাতির জনক শায়িত আছেন টুঙ্গিপাড়ায়। রাশিয়া লেনিনের সমাধি, চীন মাও সেতুং-এর সমাধিকে তুলে ধরেছে বিশ্বের কাছে। বাংলাদেশও পারে বঙ্গবন্ধুর সমাধিকে সামনে তুলে আনতে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি রয়েছে গোটা বিশ্ববাসীর আগ্রহ।
যদি স্থাপত্যকলার প্রসঙ্গে আসা যায় তবে সেখানেও ঐতিহ্যের অভাব কী? স্থাপত্যবিদদের কাছে গবেষণার বিষয় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মোঘল আমলের স্থাপনা লালবাগ কেল্লা, পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্থাপিত ষাট গম্বুজ মসজিদ স্বমহিমায় ভাস্মর। এমন আরও শত শত স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি কোনটাকেই বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পেরেছি? উত্তর আসবে নাবোধক। ফ্রান্স শুধু আইফেল টাওয়ারকেই ব্র্যাডিং করছে। কিংবা আমেরিকা স্ট্যাচু অব লিবার্টিকেই তুলে ধরছে তাদের আইকন স্থাপনা হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে এসেও তার আইকন চিহ্নিত করতে পারেনি। কেউ সুন্দরবন, কেউ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কেউ সংসদ ভবন, কেউ লালবাগ কেল্লা, কেউ জাতীয় স্মৃতিসৌধ আবার কেউ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে ব্র্যান্ডিং করতে চাচ্ছেন।
মিশ্র প্রচারণার ফলও হচ্ছে মিশ্র। এককভাবে কোনটাই দেশের আইকন হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছে না। বিদেশিরা বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় প্রায়শই এমন আইকনের বিষয়ে জানতে চান। তখন গাইডরাও পড়েন বিপাকে। একেক গাইড তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেকটি নাম বলছেন। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন পর্যটকরা।
এটাকে পর্যটনের জন্য অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করছেন ট্যুর অপরেটররা। ট্যুর অপরেটরদের সংগঠন টোয়াব’র ডিরেক্টর ও পাটা (প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি জেনারেল তৌফিক রহমান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, বাংলাদেশের একটি আইকন থাকা উচিত। আমরা বহুদিন ধরে এটা বলে আসছি।
তিনি বলেন, আইকন থাকলে বিদেশে গিয়ে কিংবা বিদেশিরা বাংলাদেশ এলে দেশকে প্রমোট করতে সুবিধা হয়। যেমন ধরেন যদি সংসদকে আইকন হিসেবে ধরে নেই তখন সংসদের রেপ্লিকা থাকবে, চাবির রিং, স্যুভেনির নিয়ে যাব ট্যুরিজম মার্কেটিং করতে।
অনেকের অনেক রকম নেশা থাকে। অনেকে পর্যটন আইকন দেখার জন্য সারা দুনিয়া ছুটে বেড়ান। আইকন থাকলে দেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হয়, যোগ করেন তৌফিক রহমান।
ভারতের আইকন তাজমহলে প্রতি বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। আর স্বাভাবিকভাবে তাজমহল ঘুরতে এসে অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন তারা। একইসঙ্গে টুকিটাকি মার্কেটিং করে ডলার রেখে যাচ্ছেন ভারতে।
ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার পর্যটক তাজমহল দেখতে আসেন। ছুটির দিনগুলোয় এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ হাজার পর্যন্ত। এরমধ্যে ১০ শতাংশই বিদেশি পর্যটক। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ৯৩ লাখ ৪২৪ জন বিদেশি পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ তাজমহল ভ্রমণ করেছেন।
ভুটান ‘হ্যাপিনেস ইজ এ প্লেস’, মালয়েশিয়া ‘ট্রুলি এশিয়া’, ভারত ‘ইনক্রিডেবল ইন্ডিয়া’, থাইল্যান্ড ‘অ্যামেজিং থাইল্যান্ড’, নেপাল ‘ভিজিট নেপাল লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স’, ইন্দোনেশিয়া ‘ওয়ান্ডার ফুল ইন্দোনেশিয়া’, ফিলিপাইন ‘ইটস মোর ফান ইন ফিলিপাইন’, অস্ট্রেলিয়া ‘দেয়ার নাথিং লাইক অস্ট্রেলিয়া’, নিউজিল্যান্ড ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট পিওর নিউজিল্যান্ড’, তুরস্ক ‘বি আওয়ার গেস্ট তুরস্ক’, শ্রীলংকা ‘ওয়ান্ডার অব এশিয়া’, সুইজারল্যান্ড ‘গেট ন্যাচারাল’ স্লোগানে নিজ দেশকে ব্র্যান্ডিং করছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবেই তারা স্লোগানগুলোকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। এখানেও ধরাশায়ী ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’। এক পর্যটন মন্ত্রণালয় মিন মিন করে আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে, যে আওয়াজ দেশের ভেতরেই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে ধ্বনিত হতে পারছে না। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রীয়ভাবে তুলে ধরতে অনেকাংশেই ব্যর্থ বাংলাদেশের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
এখানে সমন্বিত স্লোগান নেই, একেক মন্ত্রণালয় একেক স্লোগান নিয়ে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে চাইছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় যখন বিউটিফুল বাংলাদেশ স্লোগান দিচ্ছে তখন হয়তো বিদ্যুৎ বিভাগ আলোকিত বাংলাদেশ স্লোগান তুলে ধরছে পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিলে।
অনেকে মনে করেন পর্যেটন ইকোনমি এখন জ্যামিতিক হারে প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ট্যুরিস্ট বেড়েছে ধারণাতীতভাবে। তবে সেই তুলনায় বিদেশি ট্যুরিস্ট টানতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। ইউরোপের অনেক ট্যুরিস্ট বাংলাদেশের ওপর দিয়ে থাইল্যান্ড-নেপাল ঘোরাঘুরি করছেন কিন্তু বাংলাদেশে পা ফেলছেন না।
এক এভারেস্টকে কেন্দ্র করে নেপাল জিডিপির ৪০ শতাংশ আয় করছে পর্যটন খাত থেকে। কয়েকটি ছোটো ছোটো সমুদ্র সৈকত দিয়ে তাবত দুনিয়ার পর্টযককে টেনে নিচ্ছে থাইল্যান্ড। সেখানে বিশাল সম্ভাবনার বাংলাদেশ মেঘ-পাহাড়ে মিতালি, পাহাড়-সমুদ্রের মেলবন্ধন, বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ সমারোহ, সেন্টমার্টিন-সন্দ্বীপের মতো বিস্ময়কর দ্বীপ, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন নিয়েও পর্যটন খাতে সাড়া জাগাতে পারছে না।
বাংলাদেশে কতজন বিদেশি পর্যটক আসছেন তার হিসেবে নেই কারও কাছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, এমনকি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেও কোনো সঠিক উত্তর মেলেনি। ট্যুরিজম বোর্ড জানিয়েছে তারা ইমিগ্রেশনে অনুরোধ করেছিলেন, এমনকি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তোলা হয়েছিল। মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও আটকে গেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। ইমিগ্রেশন সিক্রেসির ছুতো দিয়ে পর্যটকদের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
আইকন প্রশ্নে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) সিইও ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আমরাও মনে করি আইকন থাকা উচিত। আমরা এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমরা একটি মাস্টারপ্ল্যান করছি সেখানে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধকে আইকন করার বিষয় বিবেচনায় রয়েছে। যেভাবে দিল্লি গেটে শিখা অনির্বাণ রয়েছে তেমনি এখানেও থাকবে।
বাণিজ্যিকভাবে নয়, মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে মন্তব্য করেন বিটিবি’র সিইও।