দার্জিলিংয়ের নাম শুনলেই মনে হয় ইস্, যদি ঘুরে আসতে পারতাম। স্বপ্নের শহর যেমন হয়, দার্জিলিং যেন ঠিক সেরকমই। হিমালয়ের অপরূপ দৃশ্য, নয়নাভিরাম প্রকৃতি, মিষ্টি শীতের আমেজ, দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়, টয়ো ট্রেন সব আছে এখানে। অাকাশ ও মেঘের অভিরাম লুকোচুরি।
কি নেই এ শহরে? সুন্দর পরিপাটি, শৃঙ্খলিত একটি রাজ্য। দার্জিলিং শহরটি পুরোটায় পাহাড়ের ওপরে। বাংলাদেশে যখন শীত পড়তে শুরু করে তখন দার্জিলিংয়ে বরফ পড়ে, আর বাংলাদেশে যখন প্রচণ্ড গরম তখন দার্জিলিং তখন মিষ্টি শীতের কোমল ছোঁয়া। আকাশের খুব কাছে দার্জিলিং শহর। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে উঠলে মনে হয় মেঘের দেশে চলে এসেছি। মেঘ নিজে এসে ধরা দেয়। ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি রূপ পাল্টায় দার্জিলিং শহরে। তাই দার্জিলিং এর নাম শুনলেই অন্যরকম একটি ভালোলাগা কাজ করে সবার। আমিও এর ব্যতিক্রম হতে পারিনি।
ছোটবেলা থেকে ঘুরতে ভালোবাসি। সময় সুযোগ হলেই ঘুরে বেড়াই দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আর মাঝে মধ্যে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও। সাংবাদিকতা পেশায় থাকার কারণে লম্বা ছুটি পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ছুটিটা ম্যানেজ করে নিয়েছি। ভারতীয় ভিসা আগে থেকে থাকায় আর কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। আমার সাথে যোগ দেন এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রনেতা ইলিয়াছ উদ্দিন ও ছোট ভাই রাকিব হায়দার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সোহাগ বাসে করে সন্ধ্যা ৬ টায় চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিলাম ভারতের উদ্দেশ্যে। পরদিন বেলা ১২টার মধ্যে বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সড়কে যানজটের কারণে পৌঁছতে সময় লেগেছে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত। দ্রুত ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ছয়টার মধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করলাম। সীমান্ত অতিক্রম করে সেখান থেকে আবার সোহাগ বাসে রওনা দিলাম কলকাতার পথে।
শারদীয় দূর্গাপূজার কারণে পথে পথে ছিলো ভিড়। এ ভিড় সামলে কলকাতা পৌঁছাতে সময় লাগল আরও ৬ ঘণ্টা। কলকাতা পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে উঠে পড়লাম হোটেলে। পরদিন সকালে উঠে প্রথমেই করে নিলাম শিলিগুড়ি যাওয়ার বাসের টিকেট। বাস যাত্রা করবে রাত আটটায়। সারাদিন কি করবো? প্ল্যান করলাম কলতাকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নেয়ার। ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিউজিয়াম, পার্কসহ উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নিলাম।
রাতে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। সকাল আটটায় পৌঁছে গেলাম শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়ি থেকে সুমো জিপে করে আড়াই ঘণ্টা পথ শেষে পৌঁছালাম দার্জিলিং শহরে। শিলিগুড়িতে আমাদের দলে যোগ দেন কলকাতার তিনজন। তারা হলেন ব্যবসায়ী সুমন কুমার, তার স্ত্রী টুম্পা ও মেয়ে বৈষ্ণবী (সোনাই)।
পাহাড়ের মাঝে মাঝে বসতি। নিচ থেকে যেমন পাহাড়ের উপরের বাড়ি গুলো খুব ক্ষুদ্র দেখায়। আবার উপর থেকেও নিচের বসতবাড়ি গুলোকে খুব ক্ষুদ্র দেখায়। বিমানের উপর থেকে যেমন সব কিছু ক্ষুদ্র দেখায়, তেমন। অনেক উপরে উঠার পর মেঘের জন্য নিচের কোনকিছু ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলো না। কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছিলো সব। এরপরও উঠতে থাকি। উপরের দিকে। পাহাড়ি রাস্তাগুলোর মোড়গুলো ভয়ঙ্কর। মাঝে মাঝে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন। পাশে তাকালেই পাহাড়ের পাদদেশ। কোনভাবে পড়ে গেলে মৃতদেহও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ মনে হয় না খুঁজতেও আসবে। দার্জিলিং পৌঁছে খোঁজখবর নিয়ে উঠে গেলাম ডলফিন নামে এক বাঙালি হোটেলে। পরদিন বের হলাম দার্জিলিং শহর দেখতে।
টাইগার হিল: আগের দিন রাতেই টাইগার হিলে যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে রাখতে হয়। টাইগার হিলে সবাই যায় সূর্যোদয় দেখতে। আর তা দেখা জন্য বের হতে হয় ভোর চারটায়। টাইগার হিল দার্জিলিং এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা। মূল টাউন থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে। আর জীপে করে পৌছাতে প্রায় ৪০ মিনিটের মত লাগে। সেখানে গিয়ে দেখলাম মানুষের জটলা। কিছুক্ষণ পর পূর্বদিকে আস্তে আস্তে লাল আভা দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে লাল আভার পরিমাণ বাড়তে লাগলো। এক সময় সূর্যিমামা উঁকি দিলো।
বাতাসিয়া লুপ: বাতাসিয়া লুপে কিছু ফুল গাছ সুন্দর করে সাজানো আছে। এটা ছোট রেইল লাইনের একটা রাস্তা বা লুপ। যেটা সুন্দর, তা হচ্ছে বাতাসিয়া লুপ থেকে দার্জিলিং শহরের ভিউ। এখান থেকে দার্জিলিং এর অনেক অংশের অসাধারণ ভিউ দেখা যায়। বাতাসিয়া লুপ দেখার পর বেরিয়ে খেয়ে নিলাম সবজির পিয়াজু। তখন সকাল সাড়ে আটটা মাত্র। তারপর হোটেলে ফিরে গেলাম। সকালের নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম রক গার্ডেন দেখতে।
রক গার্ডেন: রক গার্ডেন দার্জিলিং শহর থেকে অনেক নিচে। যাওয়ার পথে অনেক গুলো চা বাগান চোখে পড়ল। আর নিচ থেকে দার্জিলিং শহর ও চোখে পড়ল। আবহাওয়াটা বেশি ভালো থাকায় সবকিছু অনেক দারুণ লাগতেছিল। চারপাশ দেখতে দেখতে রক গার্ডেন পৌছালাম। রক গার্ডেন একটা ঝর্ণা। খুব বেশি বড় না, কিন্তু সুন্দর। ঝর্ণা থেকে ঝর্ণার চারপাশটা বেশি সুন্দর। পাহাড়, মেঘ আর আকাশের নীল মিলে দারুণ লাগতেছিল।
চৌরাস্তা এবং মল: এটা দার্জিলিং এর মূলকেন্দ্র। চৌরাস্তার পরেই রয়েছে মল। এখানে অনেকটুকু সমতল জায়গা। অনেক মানুষ জড়ো হয়। চারপাশ সুন্দরভাবে দেখা যায়। আর এখানে রয়েছে একটা স্টেজ। কনসার্ট বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। চৌরাস্তার আরো উপরে রয়েছে অবজারভেটরি হিল এবং মহাকাল মন্দির । যেখান থেকে সব কিছু সুন্দর করে দেখার কথা। কিন্তু ঐখানের গাছ গুলো এত বিশাল বিশাল যে, গাছের জন্য চারপাশ কিছুই দেখা যায় না।
কাঞ্চনজঙ্গা: নামটি শুনে মনে করছেন এটি কি? কাঞ্চনজঙ্গা হচ্ছে এভারেস্ট্রের চূড়া। আপনি নেপালে গিয়ে এভারেস্ট দর্শন করতে পারেন বা না পারেন, দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্গা দেখতে পাবেন। আমার হোটেল রুম থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্গা। এ রূপ দেখে আপনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যাবেন। প্রকৃতির রূপ এত সুন্দর কিভাবে হয়।
আশেপাশের শহর ও দেশ: দার্জিলিং শহর ভ্রমণের মাধ্যমে আপনি দুটি বাড়তি সুবিধা পাবেন। তা হচ্ছে নেপাল ও ভুটান ভ্রমণের সুযোগ। ভারতীয় ভিসা গ্রহণের সময় যদি আপনি নেপাল ও ভুটান ভ্রমণের অনুমতি নিয়ে যান তবে আপনার ভ্রমণ হবে বাম্পার। এছাড়া মিরিখও ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে রয়েছে দার্জিলিং এর বিখ্যাত চায়ের বাগানগুলো।
কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে শ্যামলী, সোহাগ ও গ্রীনলাইন বাসে করে বেনাপোল বা বুড়িমাড়ি সীমান্ত দিয়ে আপনি দার্জিলিং ভ্রমণ করতে পারবেন। আর বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে যেতে হলে গরীবউল্লাহ শাহ মাজার প্রাঙ্গন থেকে সোহাগ, গ্রীনলাইন বা শ্যামলী বাসে করে কলকাতা হয়ে দার্জিলিং যাওয়া যায়। আরেকটি সুবিধাজনক পথ হচ্ছে রংপুরের বুড়িমাড়ি সীমান্ত দিয়ে। কারণ বুড়িমারি অতিক্রম করে সরকারী বাসে করে ৬০ টাকায় আপনি পৌঁছে যেতে পারেন শিলিগুড়িতে। এর ফলে বেনাপোল সীমান্ত থেকে সময় ও অর্থ দুটিই সাশ্রয় হবে। মনে রাখবেন ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা দিতে হবে, সেটা রওনা দেয়ার আগে সোনালী ব্যাংক থেকে দিয়ে যাওয়াই ভালো। তবে খুশির খবর এখন ভারতীয় ভিসা দিয়ে যেকোন সীমান্ত দিয়ে যাওয়া ও আসা যায়।
ভিসা: ভারতের ভিসার সব ডকুমেন্টই (ন্যাশনাল আইডি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট/ডলার এনডোর্স/ক্রেডিট কার্ডের ফটোকপি, লেটার অব ইন্ট্রুডাকশন, ইত্যাদি) লাগবে। আর পোর্ট অব এন্ট্রি এক্সিট ডাউকি সিলেক্ট করুন।
কখন যাবেন: দার্জিলিং সারাবছরই যেতে পারেন। নভেম্বর ডিসেম্বরে খুব বেশি ভিড় থাকে। কারণ ওই সময় দার্জিলিং এ বরফ পড়ে। আর দার্জিলিং যাবার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে যান। পর্যাপ্ত শীতের কাপড় নিয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন: পুরো দার্জিলিং শহরে হাজারো হোটেল ও কটেজ আছে। ১,৫০০ রুপি থেকে শুরু করে ৫০ হাজার রুপির রুমও রয়েছে। এক রুমে ৩/৪ জন থাকতে পারবেন। তবে হোটেল ঠিক করতে দালালের পাল্লায় পড়বেন না। সময় নিয়ে নিজেই যাচাই করে হোটেল ঠিক করবেন।
টিপস: ১. দার্জিলিং এ ডলার ভাঙ্গানো খুব সমস্যা। ব্যাংকিং আওয়ারের মধ্যে আসতে পারলে ব্যাংক থেকে ভাঙ্গান, আর না পারলে মলে কিছু নেপালি বা বাঙালি দোকানে ডলার ভাঙ্গাতে পারেন।
২. ড্রাইভারদের সাথে কথা বলার সময় সাবধান। এরা আপনার সাথে বিভিন্ন ধরণের প্রতারণা করতে পারে। ভালো দেখে হিসেব নিকেশ করে গাড়ি ঠিক করবেন।
৩. সন্ধ্যার সাথে সাথে মোটামুটি লোক চলাচল কমে যায়। আটটার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তখন পুরো দার্জিলিং নীরব হয়ে যায়। তখন বের হয়ে নিরব দার্জিলিং একটু দেখে নিবেন। ঘুরে বেড়াবেন শহরের এদিক ওদিক। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন সমস্যা নেই।
৪. রবিবার মোটামুটি সবকিছুই বন্ধ থাকে, কথাটা মাথায় রাখবেন।
লেখক: স্টাফ রির্পোটার, বাংলা টিভি, চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিস।