নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আরবের বিরাণ প্রান্তরের এক পান্থনিবাসে নেমে চমকে উঠি। কানে আসে বারী সিদ্দিকীর দরদী সুর: "রজনী হইস না অবসান/আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচান।"
তখন রাত নয়। খা খা দুপুর। মরুর লু হাওয়া বইছে শরীরে তীব্র স্পর্শ জাগিয়ে।
তাকিয়ে দেখি তিনজন পরিচ্ছন্ন-কর্মী গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছেন। তাদের পাশে রাখা মোবাইল থেকে ভেসে আসছে বারী সিদ্দিকীর দরদী কণ্ঠস্বর।
কথা বলে জানলাম তারা প্রবাসে কাজ করতে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। শামীম, রফিক আর মোতাহার। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বাড়ি। "দেশের কথা মনে হলেই বাংলা গান শুনি। বারী সিদ্দিকী, শাহ আবদুল করিম আমাদের প্রিয় শিল্পী," জানালেন একজন।
গত বছরের (২০১৭) ডিসেম্বর মাসের ঘটনা সেটি। কিছুদিন আগেই বারী সিদ্দিকী প্রয়াত হয়েছেন। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তখন তার গানগুলো ব্যাপক শ্রোতার মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে।
একাধিকবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আরবের অতি মসৃণ মহাসড়কে বিলাসবহুল বাস কিছুক্ষণ পর পর থামে। যাত্রীরা বাথরুম সেরে হাল্কা বা ভারি খাবার গ্রহণ করেন। বাসের পেটে নেওয়া হয় জ্বালানি তেল। এটাই নিয়ম।
স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতিতে দুই-একজন বাংলাদেশির দেখা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাদের সাথে কয়েকটি কথা বললে খুবই খুশি হন। সুখ-দুঃখের নানা কাহিনী খুলে বলেন। বিদেশের বিরূপ পরিবেশে দেশের লোকের দেখা পেলে আনন্দে চিকমিক করে প্রবাসীর চোখ।
বিভিন্ন শহরে প্রবাসীদের আবাসস্থলে গিয়ে দেখেছি গাদাগাদি করে ফ্লোরিং করছেন তারা। নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পরেও প্রায়-সবাই ওভারটাইম করেন। তারপর ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘরে আসেন। এক পেট খেয়ে ঘুমুতে যান।
এমন চরম কায়িক পরিশ্রমের জীবনে ইন্টারনেটে দেশের খবর পড়েন। ইউটিউবে বাংলা গান শুনেন। তীব্র গরম আবহাওয়ায় প্রচণ্ড কষ্টের পেশাগত জীবনেও বুকে একখণ্ড সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে জড়িয়ে রাখেন তারা।
পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দেশের জন্য অসীম ভালোবাসা নিয়ে দিন-যাপন করেন লক্ষ লক্ষ প্রবাসী জনশক্তি। কখনো তাদের সাথে দেখা হলে টের পাই ভালোবাসার সুনীল ছোঁয়া। ভিজে আসে দু'চোখ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাদের অতল ভালোবাসায়।