ভারত ভ্রমণে আসা পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান নয়াদিল্লি। বহু সংরক্ষিত পুরাকীর্তি, মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক সব স্থাপনা এবং নানান জাতি-ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় ব্যাপক সমৃদ্ধ ভারতের রাজধানী শহরটি। বিশেষত দিল্লি শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব পর্যকটদের আকৃষ্ট করে সবচেয়ে বেশি।
দিল্লির সবকিছুই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে টানবে। শহরের পরিচ্ছন্নতা, সুলভ যাতায়াত ব্যবস্থায় মুগ্ধ হন পর্যটকরা। এখানে কম খরচেই মেট্রোতে ঘোরাফেরা করা যায়, আবার ট্রেনে চেপে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া যায় অনায়াসেই।
রাজধানী দিল্লির এন্ট্রি গেটের বিপরীত পাশে পাহাড়গঞ্জ। সেখানে রয়েছে অসংখ্য হোটেল। পর্যটকরা হোটেলে আগে থেকে বুকিং দিলেও চলে, এসে দরদাম করেও বুকিং দিতে পারেন। ৭০০-৮০০ রুপি থেকে শুরু করে মানভেদে বিভিন্ন দামে হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়।
পাহাড়গঞ্জ থেকে নয়াদিল্লি এন্ট্রি গেটের ফ্লাইওভার পার হয়ে খানিকটা হেঁটে বাসে চেপে বসলে আপনি নামতে পারবেন ঐতিহাসিক লালকেল্লায় (রেড ফোর্টে)। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে মাত্র ১০ রুপি।
পাহাড়গঞ্জ থেকে অটো বা ট্যাক্সি নিলে সে ক্ষেত্রে দরদাম করে যাওয়াটাই শ্রেয়। কারণ, এখানে ১০০ রুপির ভাড়া অনেক সময় চালকেরা ৩০০ বা ৪০০ রুপিও চেয়ে বসেন। তাই যাচাই করে নিলে ঠকার সম্ভাবনা কম থাকে।
লালকেল্লায় সকাল সকাল যাওয়াটাই শ্রেয়। কারণ হাতে সময় নিয়ে গেলে বিশাল কেল্লার পুরোটাই ঘুরে দেখা যায়। কেল্লার ভেতের প্রবেশ করতে হলে টিকিট কাটতে হয়। দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দু’টি টিকিট কাউন্টার।
এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফি’র ব্যবস্থা। ভারত, সার্কভুক্ত ও বিসমেটকভুক্ত দেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের জন্য কেল্লায় প্রবেশ ফি ৫০ রুপি। তবে ক্রেডিট কার্ডে টিকিট কিনলে খরচ হবে মাত্র ৩৫ রুপি। কেল্লা ও জাদুঘর দু’টাই দেখতে চাইলে টিকিটের দাম পড়বে ৮০ রুপি, ক্রেডিট কার্ডে ৫৬ রুপি। অন্যান্য দেশের পর্যটকদের ক্ষেত্রে প্রবেশমূল্য শুধু কেল্লা ৬০০ রুপি, ক্রেডিট কার্ডে ৫৫০ রুপি। কেল্লা ও জাদুঘর দেখতে চাইলে ৯৫০ রুপি, ক্রেডিট কার্ডে ৮৭০ রুপি। যাদের হাঁটতে সমস্যা তাদের জন্য রয়েছে টেম্পু সার্ভিস।
ভারত সফরে এসে বুধবার (২ অক্টোবর) সকালে লালকেল্লা দেখতে যাই। লাল কেল্লার বিশালত্বে সত্যি মুগ্ধ। কেল্লাটি যে এত সুন্দর না দেখলে জানতামই না! কেল্লাজুড়ে অসংখ্য কবুতরের ওড়া-উড়ি, লাল বেলে পাথরে দুর্গটি যেন তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছে।
প্রতিদিনের মতো আজো সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত ছিল গোটা এলাকা। কেল্লার ভেতরে-বাইরে দাঁড়িয়ে অনেক দর্শনার্থীই স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলে রাখছেন। আমিও কেল্লার সামনে মোবাইল বের করে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এরপর টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ি। শুরু হয় কেল্লার অন্দরমহলে ইতিহাস খুঁড়ে দেখা।
দিল্লির সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৮ সালে সুবৃহৎ এই কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৪৮ সালে। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই কেল্লার আদি নাম ছিল কিলা-ই-মুবারক। কেল্লায় তখন সম্রাটের পরিবারবর্গ বাস করতেন। যমুনা নদীর জলেই পুষ্ট হতো কেল্লার পরিখাগুলো।
কেল্লার উত্তর-পূর্ব কোণের প্রাচীর সালিমগড় কেল্লা নামে আরেটি প্রাচীন দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৫৪৬ সালে ইসলাম শাহ সুরি এই প্রতিরক্ষা কেল্লাটি নির্মাণ করেছিলেন। লালকেল্লার পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা শাহজাহানের শাসনকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
প্রকৃতপক্ষে লালকেল্লা ছিল শাহজাহানের নতুন রাজধানী শাহজাহানাবাদের রাজপ্রাসাদ। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি দিল্লি থেকে আগ্রা শহরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।
লালকেল্লায় বসবাসকারী শেষ মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ১৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর লালকেল্লা পরিত্যাগ করেন। পরে অবশ্য তিনি ব্রিটিশ বন্দী হিসেবে এই কেল্লায় ফিরে এসেছিলেন।
এখানেই ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি তার বিচার শুরু হয় এবং ৭ অক্টোবর তাকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর লালকেল্লার কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা এটিকে একটি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয়ের পর লালকেল্লাতেই যুদ্ধবন্দীদের বিচার হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কেল্লাটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
প্রতি বছর ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লার লাহোরি গেটসংলগ্ন একটি স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকেন। ২০০৭ সালে লালকেল্লা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়।