ভারত ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এলাকাগুলো ত্রিভুজের তিনটি বাহুর মতো তিনটি ঐতিহাসিক জনপদে বিস্তৃত। উত্তর ভারতের দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর-আজমির, এই তিনটি অঞ্চল নিয়ে যে ত্রিভুজ গড়ে উঠেছে, তাকে 'গোল্ডেন ট্রায়াংগেল' বা 'সোনালি ত্রিভুজ' নামে ডাকা হয়। পর্যটনের স্বর্গরাজ্য বলা হয় এ অঞ্চলকে।
বিশাল ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকদের সিংহভাগ আবর্তিত হন উত্তর ভারতের এই এলাকাগুলোতে। রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি অঞ্চল নিয়ে যে টুরিস্ট সার্কিট, তাতে মুঘল আমলের প্রত্নস্থাপনাই অধিক। আরও আছে মুঘল-পূর্ব প্রথম মুসলিম শাসকদের কীর্তি, রাজপুত স্থাপনা। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্বঐতিহ্যের অনেকগুলো নিদর্শন রয়েছে এখানে।
বিচিত্র ভারতের বহুবিচিত্র পাহাড়, সমতল, মরুভূমি, উট, ময়ূর ইত্যাদির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী জীবনাচার, বর্ণিল পোশাক, লোকগান, খাদ্য ও লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধ উপস্থিতি ভ্রমণের সোনালি ত্রিভুজের অন্যতম সম্পদ। জনপদ ও ভূগোলের মতোই সংস্কৃতি ও লোকজীবনের বর্ণচ্ছটার অপূর্ব বিভা ছড়িয়ে রয়েছে এখানে। বহুবর্ণা ভারতের আত্মার সন্ধান পাওয়া যায় এখানে, যে জায়গার আরেক নাম ‘আর্যাবর্ত’, মানে প্রাচীনকালে আর্য জাতি এসে যে জায়গাটুকুতে আবর্তিত হয়েছিলেন।
দিল্লি-আগ্রা-জয়পুরের এই প্রসিদ্ধ ভ্রমণ ক্ষেত্রকে ঘিরে রয়েছে ভারতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ও শহর। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, পাঞ্জাব-হরিয়ানা এবং গুজরাত ছাড়াও এই সোনালি ত্রিভুজের মরুময় জয়সলমীরের পাশে পশ্চিম দিক দিয়ে মিশেছে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ। বিখ্যাত থর মরুভূমির কিছুটাও পড়েছে এই ত্রিভুজে। রয়েছে মরুময়-পার্বত্য রাজস্থানের একমাত্র শৈলশহর মাউন্ট আবু। আরও উল্লেখযোগ্য দিক হলো, রাজপুত ছাড়াও এখানে বসবাস করেন মাড়োয়ারি, জৈন, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধরা।
জৈন সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও অনেক ধর্মীয় নিদর্শন রাজস্থান ও গুজরাত সীমান্তবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে আছে। বাংলায়, বিশেষত কলকাতায় যে মাড়োয়ারি সম্প্রদায় বেশ ভালো করে ব্যবসা গুছিয়ে বসেছে এবং যাদের পূর্ব-পুরুষ ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা জগৎশেঠ, সেই মাড়োয়ারিদের আদিবাসও এখানে। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় যেসব দেশিয় রাজ্য নিয়ে সমস্যা হয়েছিলো, তার মধ্যে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ ও জুনাগড় ছিল অন্যতম। জুনাগড় রাজ্যটিও বর্তমানের রাজস্থানের মধ্যে পড়েছে আর কিছুটা পড়েছে গুজরাতে।
ফলে কেবলমাত্র ভ্রমণ বা প্রত্নসম্পদই নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসের অগ্নিস্মৃতিময় অনেকগুলো জনপদও রয়েছে এই সোনালি ত্রিভুজে। বিশেষত সুবিশাল ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রধান প্রধান বাঁকগুলোও এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। আর্য, কুশাণ, শক, হুন, গ্রিক, মুসলিম, আফগান, তুর্কি, পাঠান, মুঘল, রাজপুতরাও এসব এলাকাকে কেন্দ্র করেই ইতিহাসের নানা পর্যায়ে ভারতে শাসন বিস্তার করেছিলেন। ফলে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নঅতীত এ জনপদের স্তরে স্তরে মিশে রয়েছে। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ভূগোল ও রাজনীতির এই নাভীমূলে গুঞ্জরিত হয় হারানো ইতিহাসের ধ্বনিপুঞ্জ।
বাংলাদেশ থেকে উত্তর ভারত ভ্রমণের সোনালি ত্রিভুজে যেতে তিনটি পথ আছে। ঢাকা থেকে সরাসরি দিল্লি হয়ে, নয়ত কলকাতা হয়ে কিংবা বাংলাদেশের আখাউড়া সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা হয়ে। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের জন্য কলকাতা বা আগরতলা ছাড়া সরাসরি যাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। কম সময়ে ঘুরে আসার পরিকল্পনা নেওয়ার ফলে আমরা চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় ফ্লাইট নিয়ে যাত্রা শুরু করি।
কলকাতা থেকে দিল্লি বা জয়পুর দিয়ে ভ্রমণের সূচনা করা যায়। তারপর একে একে অন্য জায়গাগুলো ঘুরে আসা সহজ। হাতে সময় থাকলে দিল্লি-আগ্রা-জয়পুর-আজমির ট্রেনে বা বাসে যাতায়াত করা যায়। নইলে কার রিজার্ভ করে স্বল্প সময়ে ভ্রমণ সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রায় ৭০০ মাইল দীর্ঘ সোনালি ত্রিভুজকে ট্রেনে সংযুক্ত করেছে অত্যাধুনিক শতাব্দী এক্সপ্রেস। তাছাড়া ভারতের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও দামি কয়েকটি টুরিস্ট ট্রেন চলে এই তিন জায়গাকে ঘিরে। এসব ট্রেনে পাঁচ তারকা হোটেলের মতো থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সাত দিনে ট্রেনে করেই দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, আজমির, যোধপুর, উদয়পুর, জয়সালমীর, পুষ্কর ইত্যাদি ভ্রমণের জন্য খরচ হয় প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি। ট্রেনগুলোর নামও চমৎকার এবং রাজসিক: ‘লাক্সারি অন দ্য হুইল’, ‘মহারাজা এক্সপ্রেস’, ‘রয়েল চ্যারিয়েট’ ইত্যাদি।
কলকাতা থেকে আমাদের সামনে ভ্রমণ শুরুর দুটি পথ খোলা ছিল। একটি দিল্লি থেকে আরেকটি জয়পুর থেকে। জয়পুরে আমার একটি আমন্ত্রণ ছিল। ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক’ নিয়ে একটি সেমিনারে আমাকে মূল প্রবন্ধ পাঠের জন্য আগেই নিমন্ত্রণ জানানো ছিল। আমি এই সুযোগকে সোনালি ত্রিভুজ ভ্রমণের সঙ্গে সমন্বয় করে নিলাম। ফলে আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো জয়পুর থেকে। তারপর আজমির, আগ্রা, দিল্লি ভ্রমণের ছক তৈরি করা হলো।
ভ্রমণে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি না হয়ে হলো ‘পিংক সিটি অব ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারতের গোলাপি শহর’ নামে খ্যাত জয়পুর থেকে। তবে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় ভ্রমণের শুরুতেই একটি বিকেল থেকে সন্ধ্যা কাটানোর সুযোগ হলো কলকাতায়। আমরা ট্রানজিটের ক্ষেত্রে ৬/৭ ঘণ্টার বিরতি বেছে নিলাম, যাতে সেই ফাঁকে এয়ারপোর্টে বিরক্তিকর অপেক্ষার বদলে কলকাতাতেও একটি চক্কর দেওয়া সম্ভব হয়।