বৃষ্টির মধ্যে সকাল হলো আগ্রায়। কদিন ধরেই উত্তর ভারতে অবিরাম বর্ষণের রেশ থেমে থেমে চলছে। সকালের শুরুতে তাজমহলের দিকে এক চক্কর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা স্থগিত করতে হলো। কিছুক্ষণ হোটেলে অপেক্ষার পর বৃষ্টি সহনীয় হলে চলে এলাম আগ্রা দুর্গে।
আগ্রা দুর্গ নামটি শুনে মনে হতে পারে পারে যে, এটি কোনও সামরিক ছাউনি বিশেষ। আসলে মোটেও তা নয়। আগ্রা দুর্গ হলো একটি আস্ত শহর। মুঘল সচিবালয়, বাসগৃহ, সামরিক স্থাপনা মিলিয়ে দুর্গ-ঘেরা পরিকল্পিত এক রাজধানী।
তাজমহল থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আগ্রা দুর্গের সামনে শাহজাহান গার্ডেন। বিশাল মুঘল উদ্যান আর আগ্রা দুর্গের মাঝখান দিয়ে চলে গেলে বিশাল এভিনিউ। দাঁড়িয়ে দেখলাম সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা দুর্গ-নগরী।
৯৪ একর আয়তন বিশিষ্ট অতিকায় আগ্রা দুর্গে প্রবেশের দুটি প্রধান প্রবেশ তোরণ আছে। একটির নাম অমর সিং গেট, যাকে লাহোর গেটও বলা হয়। আরেকটি দিল্লি গেট, যা দুর্গের পশ্চিমাংশে অবস্থিত। বর্তমানে দিল্লি গেট বন্ধ আর একমাত্র প্রবেশ পথ হলো অমর সিং গেট। তবে দুর্গের আরও দুটি ছোট আকারের প্রবেশ পথ আছে, যাতে প্রয়োজনে চারদিক দিয়েই আসা-যাওয়া, সৈন্য পরিচালনা করা যেতো। বর্তমানে দুর্গের অনেকটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাসুট ব্রিগেডের সদর দফতর আগ্রা দুর্গের উত্তরাংশে অবস্থিত।
আগ্রা দুর্গ হলো একমাত্র স্থান, যেখানের ভারতের সব শাসকরাই কর্তৃত্ব করেছে। আফগান-গজনির শাসকরা আগ্রায় প্রথমে একটি ছোট্ট সামরিক ছাউনি গড়েন এই দুর্গের স্থানে। পরে চৌহান, রাজপুত, জাঠ, শিখরা এখানে কর্তৃত্ব করেন। মুঘল-পূর্ব মুসলিম শাসকরা দিল্লি দখল করে রাজধানী স্থাপন করলেও এক পর্যায়ে সিকান্দার লোদি সেখানে রাজধানী নিয়ে আসেন ষোড়শ শতকে।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ী হয়ে মুঘলরাজ বাবুরও এ দুর্গ থেকেই রাজত্ব করেন। পুত্র হুমায়ূনের রাজ-অভিষেকও আগ্রা দুর্গে সম্পন্ন হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন। তা হলো আগ্রা দুর্গ নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার কারিকরগণ, সঙ্গে ছিলেন গুজরাতের শ্রমিকরা।
হুমায়ূনের শাসনামলে বাংলার শাসক আফগান-সুরি বংশ শের শাহের নেতৃত্বে ভারত দখল করে আগ্রা থেকে শাসন চালায়। পরে মুঘলরা আবার ভারতের ক্ষমতা দখল করলে আগ্রার দুর্গ হয় শাসনের মূল কেন্দ্র। আকবর আগ্রা দুর্গকে বিশাল আকারে নির্মাণ করেন। তিনি কিছুদিনের জন্য রাজধানী পাশের ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে গেলেও পরবর্তী শাসকরা আগ্রাকেই রাজধানী হিসাবে বেছে নেন। পরে রাজধানী কিছু দিনের জন্য লাহোর এবং আরও পরে দিল্লি স্থানান্তরিত হলেও মুঘল শাসনে আগ্রার গৌরব, শক্তি ও ঐতিহ্য সমুন্নত ছিল। ফলে আগ্রা দুর্গের প্রতিটি বালি-কণা ও ইটে-পাথরে ইতিহাসের জানা-অজানা বহু কথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। আগ্রা দুর্গের শরীরে লেপ্টে আছে সুপ্রাচীন ইতিহাসের প্রলেপ।
আগ্রার দুর্গ একজনের হাতে নয়, অনেক মুঘল নৃপতির দ্বারা সংস্কার ও পরিবর্ধন লাভ করে। তবে আকবরের সময় এর সর্বোচ্চ বিকাশ হয়। তিনি রাজস্থানের লাল বেলে পাথর দিয়ে আগ্রা দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে পুরো স্থাপনাকে পরিবেষ্টন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান বেশ কিছু প্রাসাদ, মহল নির্মাণ করেন।
আগ্রার দুর্গস্থ সমগ্র এলাকা অর্ধবৃত্তাকারে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত। প্রবেশ তোরণ থেকে শুরু করে দুর্গের প্রতিটি স্থাপনা অত্যন্ত সুনির্মিত ও কারুকার্যময়। লাল বেলে পাথরের সঙ্গে সাদা মার্বেলের ব্যবহারও দুর্গটির বিশেষ নির্মাণ বৈশিষ্ট। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দুর্গের দিকে তাকালেই গা ছমছম করে। ঝলকায় মুঘলদের সুনিপুণ নির্মাণশৈলী ও আভিজাত্য।
রাজকীয় মুঘলাই ফটক দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করে লালের সঙ্গে সবুজের মিতালিতে চোখ জুড়িয়ে গেল। সাজানো উদ্যান দুর্গের ভেতরে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মুঘলরা যেখানেই গেছে, যে স্থাপনাই গড়েছে, তাতে বাগানের উপস্থিতি আবশ্যিক। বৃষ্টি থাকলেও দর্শনার্থীর ভিড় কম নেই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম মুঘল ঐতিহ্যের অনবদ্য আকর্ষণ আগ্রা দুর্গ।
দুর্গের ভেতরেও একটি গেট আছে, যাকে বলা হয় হাতি গেট। খুবই পরিকল্পিত স্থাপত্য বিন্যাস চারিদিকে। অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে কালের করাল গ্রাস থেকে সামান্যই রক্ষা পেয়েছে। শত শত যুদ্ধ, দাঙ্গা, বিশেষত দখলদার ইংরেজদের হাতে অনেক সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে ভেতরের অনেক ইমারত ও প্রাসাদ। মুঘল সম্রাটের অধিষ্ঠানের ময়ূর সিংহাসন আর কোহিনূর হীরক সম্পদও ইংরেজরা এখান থেকে লুট করে নিয়ে গেছে বিলাতে। সিপাহি বিপ্লবের পর বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা মুঘল ও মুসলমানদের শুধু গণহত্যাই করেনি, হীরা-জহরত, বই-পত্র, তৈজযপত্র, ব্যবহার সামগ্রী লুটে নিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের মিউজিয়াম, বাজার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এসবের কিছু কিছু এখনো রয়েছে।
আগ্রার দুর্গের প্রধান আকর্ষণ দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জাহাঙ্গীর হৌস, যা আকবর নির্মাণ করিয়েছিলেন পুত্রের জন্য। বাবুরের আমলে নির্মিত বাওলি (পানির কূপ) আছে। আছে মসজিদ, আকবর মহল। সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত মহলও আছে, যাতে তার দুই কন্যা রওশান আরা ও জাহান আরা বসবাস করতেন।
আশ্চর্য হলাম, আগ্রার দুর্গে বাংলা মহল দেখে। কথিত আছে, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এটি নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণশৈলীতে বাংলার কুটিরের ছাপ আছে। নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিণত সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ছিলেন বাংলার এক সু্বেদারের স্ত্রী। বাংলার সঙ্গে নূরজাহানের একটি সম্পর্ক ছিল। বাংলার আম গাছ তিনি আগ্রার দুর্গে রোপণ করেছিলেন এবং বাংলার বিশ্বসেরা মসলিন কাপড়ের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।
দুর্গের যমুনা নদীমুখী একটি আবাসে সম্রাট শাহজাহানের বন্দি জীবন কেটেছিল। এর বারান্দা থেকে দূরের তাজমহল দেখা যায়। বন্দি সম্রাটের জীবন কাটে এখান থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাজ দেখে আর তাজে শায়িত প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজমহলের স্মৃতি স্মরণ করে।
আগ্রার দুর্গ নিয়ে প্রচলিত আছে বহু উপকথা ও কাহিনী। দুর্গের নিচে সুরঙ্গপথ নাকি নানা জায়গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ছিল অনেক গোপন কুঠরী, যেখানে সঙ্কটকালে সম্রাট আত্মগোপন করতে পারতেন বা প্রতিপক্ষকে লোকচক্ষুর আড়ালে বন্দি করে রাখতে পারতেন।
মুঘল হেরেম নিয়ে শত শত উপাখ্যানের ভিত্তিভূমিও আগ্রার দুর্গ। যেখানে সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) ও আনারকলির করুণ প্রেম-উপাখ্যান ছাড়াও বহু বাদশাহজাদি ও শাহজাদার নানা ঘটনা মিশে রয়েছে। বলতে গেলে মুঘল ইতিহাসের আখ্যান রচনা করতে গেলেই চলে আসে আগ্রা দুর্গের নাম। শার্লক হোমস পর্যন্ত আগ্রা দুর্গের পটভূমিতে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এমন শত শত গ্রন্থ আছে আগ্রা দুর্গের সামগ্রিক বা বিশেষ বিশেষ ঘটনার আলোকে।
স্থাপত্য ও নির্মাণ প্রকৌশলেও আগ্রা দুর্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। মধ্যযুগে বাগদাদ, দামেস্কো, ইস্পাহান, সিরাজ, কায়রোর মতোই আগ্রা ছিল এক আন্তর্জাতিক শহর, যার প্রাণকেন্দ্র ছিল আগ্রা দুর্গ কেন্দ্রীক রাজপ্রাসাদসমূহ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা। যে আগ্রা মুখরিত ছিল বিশ্বের নানা দেশের পর্যটক, ব্যবসায়ীর পদচারণায়। যেখানে বইতো সুরের নহর, আলোর রোশনাই আর তরবারির বিদ্যুৎচমক।
বৃষ্টি কমে এক সময় হাল্কা রোদ ঝলক দেওয়ায় মনে হলো শত শত বছরের ঘুম ছেড়ে চমকে উঠেছে আগ্রা দুর্গের ভেতরের স্থাপনাগুলো। মেঘের আড়াল ছেড়ে রোদ যেন এসে কড়া নাড়ছে ইতিহাসের উঠানে, দেয়ালে, প্রাসাদ প্রাঙ্গণে।
শুধু দর্শনীয় স্থান হিসাবে দুর্গের নানা স্থাপনা দেখাতেই সময় কেটে যায়না, প্রতিটি স্থানের পেছনের ইতিহাস ও ইতিবৃত্তও সামনে চলে আসে অশ্বধ্বনির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে। বাস্তবতা চলে যায় পেছনের সানাই, নহবতের সুরধ্বনি গুঞ্জরিত মুঘল আমলে।
সুদূর মধ্য এশীয় অঞ্চলের মোঙ্গল-তুর্ক-পারস্য ঐতিহ্য নিয়ে যে মুঘলরা ভারতে এসেছিলেন, তারা শাসন ও সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গনকে করেছিলেন আলোকিত ও সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে আধুনিক জীবনবোধ ও যাপন প্রণালী মিলে আছে অর্ধ-সহস্র বছরের মুঘল শাসনের পরতে পরতে। তাদের প্রাসাদ, হর্ম্য, স্থাপনা, প্রশাসনিক রীতি, খাদ্য, পোষাক, লোকাচার, কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই শুধু ভারত নয়, বিশ্ব সভ্যতা ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল রত্নস্বরূপ।
সেই মুঘলদের নাভিমূল আগ্রার দুর্গে প্রতিটি পদক্ষেপে কানে বাজে ইতিহাসের শব্দ-ঝঙ্কার। ছায়ায় ছায়ায় সঙ্গে চলে অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোও। অতীত পুরনো হলেও যে দীপ্তি হারায় না, মুঘল রাজধানী আগ্রা দুর্গের প্রসারিত স্থাপত্যের লালিত্য যেন সে সত্যটিই মনে করিয়ে দিল।
আরও পড়ুন: রাতের আগ্রায়