নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পায় ইসলামের ছায়াতলে



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুর মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব সম্প্রদায় আইনগত ও সামরিক-বেসামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার আহাজারি থামাতে পারছে না। বরং ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও মুসলিমরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। ‘ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা: পর্ব- ৪

পারস্যের মতো একই মানবিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় আফ্রিকা ও স্পেন বিজয়ের সময়েও। আরিয়ান, পেলাসজিয়ান ও অন্যান্য বিরোধী মতের যে লোকেরা ঐতিহ্যগতভাবে এতকাল ছিল গোঁড়াদের হিংস্রতা ও বিদ্বেষের শিকার, আইনবর্জিত সৈনিকদের তৃপ্তির খোরাক এবং নৈতিকতাবর্জিত পুরোহিত শ্রেণির রসনার বস্তু; সে সব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবগোষ্ঠী শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পায় ইসলামের ছায়াতলে।

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যে ইহুদি সম্প্রদায়ের শত্রুতার ফলে নবগঠিত মদিনার ইসলামী গণরাজ্য সূচনাকালেই প্রায়শ বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে পড়েছিল- সেই ইহুদিরাও মুসলমানদেরকে রক্ষক হিসাবে পেল। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে, খ্রিস্টান কর্তৃক অপমানিত, লাঞ্ছিত, লুণ্ঠিত ও ঘৃণিত হয়ে ইহুদিরা অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে ইসলামের শাসন বিধানের মধ্যে আশ্রয় ও নিরাপত্তা গ্রহণ করায় এক মনুষ্যত্বপূর্ণ, স্বাধীন ও নিরাপদ জীবনের সন্ধান লাভ করে, যা তাদেরকে দিতে নিষ্ঠুরভাবে অস্বীকার করেছিল খ্রিস্টান জগত।

বস্তুত পক্ষে, ইসলাম মানুষকে সামগ্রিক সাম্য ও নিরাপত্তার এমন একটি ঐশ্বরিক বিধান দান করেছে, যা স্পষ্টতা ও সরলতার কারণে যতই পুরাতন হোক-না-কেন, জাগতিক সভ্যতার উন্নয়ন-অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরম উৎকর্ষ লাভের উপযুক্ত। ইসলাম রাষ্ট্রের জন্য দান করেছে একটি মানবিক অধিকার ও কর্তব্যের সঠিক উপলব্ধিভিত্তিক নমনীয় শাসনতন্ত্র, যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হচ্ছে নাগরিক সমাজের জন্য সার্বজনীন সুশাসন নিশ্চিত করা। ইসলাম কর সীমিত করে, সব মানুষকে আইনের দৃষ্টিতে সমান করে দেয়, এবং স্বায়ত্তশাসনকে আদর্শ নীতি বলে গ্রহণ করে। ইসলাম নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে আইনের অধীনস্থ করে দিয়ে সার্বভৌম ক্ষমতার একক বা স্বেচ্ছাচারী অপব্যবহারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে আর সেই নিয়ন্ত্রণকারী আইনটি ঐশ্বরিক নিদের্শ ও ধর্মীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং মানবিক স্খলন, পতনমুক্ত হয়ে একটি উন্নততর মানবিক ও নৈতিকভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফলে বলা যায়, ইসলামের শাসন নীতিসমূহ, বিশেষ করে অমুসলমান ও সংখ্যালঘু সংক্রান্ত বিধানগুলোর প্রতিটিই এর প্রতিষ্ঠাতাকে অমর করেছে এবং এর সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা জীবন বিধান হিসাবে ইসলামের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। অতএব, ঐতিহাসিকভাবে দেখতে পাওয়া যায় যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এর রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে এমন শক্তি ও তেজ দান করেছে, যা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার শক্তি ও তেজের চেয়ে বেশি এবং অন্য যে কোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার চেয়ে গুণগত বিচারে শ্রেষ্ঠ। যে কারণে, এর প্রতিষ্ঠাতার সংক্ষিপ্ত জীবনকালের মধ্যেই ইসলামের এই ব্যবস্থা রোমান সাম্রাজ্যের চেয়েও অধিক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে; ব্যবস্থাটি এর মৌলিক চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে এবং এর অধীনস্থ অঞ্চল ও মানুষের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিপীড়িত মানবতার উদ্ধারের একটি কার্যকরী, সাম্যভিত্তিক, সম্মানজনক, মানবিক ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে মানব সমাজে আদরণীয় হয়।

ইসলামী জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থ ব্যবস্থায় ভারসাম্য, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ভিত্তিতে নাগরিক সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে ভারসাম্য সৃজনের পেছনে প্রাথমিক শাসকের আদর্শিক দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, দায়িত্বশীলতা, ত্যাগ, মহত্ত্ব আর স্বচ্ছতার অনুভূতিজাত আচরণ ও কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী উজ্জ্বলতম উদাহরণ হয়ে রয়েছে। শিবিরে, নগরে, মসজিদে, গৃহে, যে কোনো স্থানে তাদের সঙ্গে জনসংশ্লি¬ষ্ট বিষয়ে যে কোনো লোকই, যে কোনো সময়ে দেখা, সাক্ষাৎ ও যোগদান করতে পারতেন। প্রত্যেক শুক্রবার জুমার নামাজের পর শাসক বা আমীর উল-মোমিনীন প্রকাশ্য জনসমক্ষে ওিই দিনের উল্লেখযোগ্য মনোনয়ন ও ঘটনাবলীর বিবরণ দিতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা এই উদাহরণ অনুসারে কাজ করতেন।

এ হল সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি; সর্বোৎকৃষ্ট জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। ইসলামের খলিফা, যিনি একই সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ও ধর্মীয় নেতা, তিনি কোনো ঐশ্বরিক আবরণ বা পুরোহিততান্ত্রিকতার আড়ালে অবস্থান করতেন না। রাষ্ট্রের প্রশাসনের ব্যাপারে তিনি তার প্রজাদের কাছে দায়ী থাকতেন। বিশেষ করে, প্রাথমিক খলিফাদের মধ্যে নাগরিক সমনাধিকার ও জনকল্যাণের প্রতি কঠোর নিষ্ঠা আর জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে অনাড়ম্বর-সরলতা ছিল আল্লাহর ভয় আর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঠিক অনুসরণ থেকে উদ্ভূত। তারা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতই মসজিদে প্রচার ও প্রার্থনা করতে; বাড়িতে গরীব ও দুঃখী মানুষকে নিজের সঙ্গে একত্রে বসিয়ে আপ্যায়িত করতেন; সকলকে সমান চোখে দেখতেন; অতি সামান্য অভিযোগ শুনতেও ক্রুটি করতেন না। অনুচরবর্গ নেই, জাঁকজমক বা উৎসবানুষ্ঠান নেই, তারা শাসন করতেন মানবিক হৃদয়বৃত্তি আর নিজেদের উন্নত-নৈতিক চরিত্রের বলে।

মানুষের জন্য নিজের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যেভাবে জীবন-যাপন করেছেন, তার অনুসারীগণও (রা.) একই সরল আর সাদাসিদা পন্থা অনুসরণ করেন। হজরত আবু বকর (রা.) মৃত্যু শয্যায় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান শুধু এক প্রস্ত পোষাক, একটি উট আর একজন খাদেম। জেরুজালেমের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে হজরত ওমর (রা.) সেখানে গিয়েছিলেন মাত্র একজন খাদেম সঙ্গে নিয়ে এবং তাকে সমান সুযোগ ও আরাম দিয়ে। হজরত ওসমান (রা.) মুক্ত হস্তে তার সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন। হজরত আলী (রা.) জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভাণ্ডার থেকে মানুষকে অকাতরে দান করে তাদেরকে নৈতিকভাবে আলোকিত করার পাশাপাশি সরকারী অর্থকোষ থেকে প্রাপ্ত ভাতা দুস্থ ও পীড়িতদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। তারা সকলেই ছিলেন কোরআন-সুন্নাহর আলোকে রচিত নীতি ও আচরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত ‘মানবতার মহত্ত হেফাজতকারী’; মুসলমান-অমুসলমান-সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সকল মানুষের শান্তি, সম্মান, মর্যাদা, নিরাপত্তা, আমানত আর সুখ-সুবিধার রক্ষাকারী।

ইসলামের মহান প্রতিষ্ঠাতার প্রথম প্রতিনিধি হজরত আবু বকর (রা.)-এর স্বল্পকালীন সময়ের কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় মরুউপজাতিগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কাজে। দ্বিতীয় প্রতিনিধি হজরত ওমর (রা.) অধীনস্থ অঞ্চল ও এর মানবমণ্ডলীর সামগ্রিক বিকাশ, উন্নয়ন ও কল্যাণের প্রচেষ্টাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন। তৎপরবর্তী হজরত ওসমান (রা.) এবং হজরত আলী (রা.) অন্তর্ঘাত ও বিভেদের মধ্যে শান্তি ও কল্যাণের প্রশ্নে আপোসহীন থেকে সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-মানবিক স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থ, ক্ষমতা ও সুখ বিসর্জন দেওয়ার অনুপম নজির রেখে গেছেন।

এই চার জন মহতী প্রতিনিধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা খোলাফায়ে রাশেদীনের সামষ্টিক শাসনামলে মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সীমিত ক্ষমতার অধিকারী একজন নির্বাচিত নেতা কর্তৃক শাসিত একটি ন্যায়ভিত্তিক, নৈতিকতা ও সমানাধিকারের মূর্ত প্রতীক একটি জনপ্রিয় সরকারের প্রতিচ্ছবি। সরকার প্রধানের বিশেষ ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল বিভিন্ন প্রশাসনিক ও নির্বাহী বিষয়ের মধ্যে যেমন: পুলিশের ব্যবস্থাপনা, সৈন্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বিষয়ের পরিচালনা, অর্থ সম্পর্কীয় আয়-ব্যয় ইত্যাদির মধ্যে। কিন্তু বিধিবদ্ধ আইনের কাঠামো, তথা কোরআন ও সুন্নাহর বিপরীতে কোনো কাজ করার অধিকার তার ছিল না। স্বাধীন বিচারালয়গুলো সরকারের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। আদালতের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। আইন-আদালত কর্তৃক দণ্ডিত অপরাধীদের ক্ষমা করার ক্ষমতা প্রাথমিক খলিফাদের ছিল না। আইন দরিদ্রের জন্য আর ধনীর জন্য, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির জন্য আর মাঠের কাজে নিযুক্ত মজুরের জন্য, মুসলমান আর অমুসলমানের জন্য, সংখ্যাগুরু আর সংখ্যলঘুর জন্য, স্থায়ী বাসিন্দা আর মুসাফিরের জন্য সমান ছিল। যদিও সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থার আদি ও অকৃত্রিমতা শিথিল হয়ে যায়, তথাপি বহু পরেও, বংশানুক্রমিক শাসকদের আমলে, যে আমলে ক্ষমতা অনেক সময় সীমাহীন আর স্বৈরতান্ত্রিক হত, শাসকগণ আইনের সীমা লঙ্ঘন করলে আইনশাস্ত্রবিদদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ঘোষণা দ্বারা তাদেরকে সংযত ও নিবৃত্ত করা হত।

আরও পড়ুন: পর্ব-৩: ইসলামী রাষ্ট্র সব নাগরিকের জানমাল ও সম্মানের নিরাপত্তা দেয়

   

মসজিদের নগরী এখন মসজিদের দেশে পরিণত হয়েছে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের অনাচার দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে দুর্নীতি, মাদকাসক্তিসহ সব সমস্যা দূরীকরণে সামাজিক সংঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিষ্ঠার সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা আরও বলেন, উগ্রবাদীদের টার্গেটে যখন বাংলাদেশ, তখন এগিয়ে এসেছেন আলেম-উলামা এবং সংগঠনসমূহ। একসময় ঢাকা শহরকে মসজিদের নগরী বলা হতো। এখন সেটা ছাপিয়ে পুরো বাংলাদেশ মসজিদের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর কারণে।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান উপদেষ্টা ধর্মবিষক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপিকে পূর্ণ মন্ত্রী, প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মূখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপিকে পরপর তিনবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় সংগঠনের বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি মাওলানা ওমর ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুফতি আবুল বাশার নুমানি, মাওলানা মুজিবুর রহমান, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল হামিদ জমাদ্দার, ডি আইজি নাফিউর রহমান, মুফতি মুনিরুল ইসলাম এবং মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে এটি আলোচনায় আসে।

২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজদের সংবর্ধনা ও জাতীয় হিফজুল কুরআন প্রতিযোগীতা’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফাউন্ডেশনটি ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে।

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দেশসেরা হাফেজদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।

কাজের ধারাবাহিকতায় ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা প্রদান, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সচেতনতামূলক সেমিনার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘এডিস মশা ও ডেঙ্গু বিস্তাররোধে করণীয়’ সম্পর্কে ইমাম-খতিবদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন ছাড়াও সারাদেশে ধর্মীয় ও সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

;

রমজানে উমরাকারীর সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

  • Font increase
  • Font Decrease

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনায় এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। দৃষ্টি যতদূর যায় শুধুই মানুষের ভিড়। তাদের কেউ ইহরাম পরিহিত, কেউ স্বাভাবিক পোষাকে। তবে সবার লক্ষ্য এক জায়গা- মসজিদে হারাম।

সোমবার (২৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া জানিয়েছে, সৌদি আরবের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পবিত্র এই মাস শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৮০ জন মুসল্লি উমরা পালন করেছেন।

সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, এর আগে এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এভাবে ভিড় করেননি। তাদের আশা আগামী ১৫ দিনে এই সংখ্যা ২ কোটি পার হয়ে যাবে।

প্রতিবেদন অনুসারে রমজান মাস শুরুর পর থেকে ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ জন উমরা সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ জন অবস্থান করছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, স্থলপথে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উমরাযাত্রী সৌদি আরব এসেছেন। এরপর যথাক্রমে আকাশপথ ও সমুদ্রপথে এসেছেন। স্থলপথে ৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৬ জন আগমন করেছেন। আর আকাশপথে সাত লাখ ৯৮৩ জন এবং সমুদ্রপথে ৫৪ হাজার ১৪১ জন এসেছেন। রমজান মাসে পবিত্র মসজিদে হারামে ভিড় নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে উমরা পালন নিশ্চিত করতে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সৌদি আরব।

বিশেষ করে নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে চলতি রমজানে উমরা পালনের কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বারের মতো অনুমতি পাননি। অ্যাপে আবেদন করলে একটি বার্তা ভেসে ওঠে। তাতে লেখা থাকে, ‘অনুমতি প্রদান ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে সুযোগ দিতে রমজানে দ্বিতীয়বার কেউ উমরা করতে পারবেন না।’

অন্য আরেক নির্দেশনায় পবিত্র কাবাঘরের প্রাঙ্গণ তথা মাতাফে নামাজ না পড়ে মসজিদে হারামে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে। যেন ওই সময় উমরাযাত্রীরা তওয়াফ করতে পারেন। এ ছাড়া রমজান মাসে একবারের বেশি উমরা পালনে বারণ করাসহ মক্কার বাসিন্দাদের মসজিদে হারামে ভিড় না করে আশপাশের মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মুসলিম উমরা পালন করেছে, যা ছিল সৌদি আরবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যা।

;

শিক্ষাদানের শর্তে যে যুদ্ধের বন্দিরা মুক্তি পায়



মাওলানা সাইফুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বদর যুদ্ধে বিপুলবৈভব কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়। এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েত দেবেন এবং তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এ ছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা হজরত ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আজাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। -তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬

তবে আল্লাহতায়ালা ফিদইয়া গ্রহণের সিদ্ধান্তের বৈধতা দেন এবং প্রদেয় মুক্তিপণকে মুসলিমদের জন্য হালাল ঘোষণা করেন। তবে আল্লাহতায়ালা এ জন্য করেছেন যে তারা শুধু যুদ্ধবন্দি ছিল না; বরং তারা ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার বিরোধী অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন- মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়। তারা ছিল মোত্তালিব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া ও আবু আযযা জুমাহি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নবীনন্দিনী হজরত জয়নব (রা.)-র পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

এর কারণ ছিল যে হজরত জয়নব (রা.) আবুল ইবনে আসের ফিদইয়া হিসেবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিল। হারটি হজরত খাদিজা (রা.) হজরত জয়নব (রা.)-কে আবুল আসের ঘরে পাঠানোর সময় উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তা দেখে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন এবং আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে তিনি হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় আসার সুযোগ করে দেবেন। স্বামীর অনুমতি পেয়ে জয়নব (রা.) মদিনায় হিজরত করেন।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারি সাহাবিকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয়, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জাজ নামক জায়গায় থাকবে। হজরত জয়নব (রা.) তোমাদের কাছ দিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুজন সাহাবি মক্কায় গিয়ে হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন। হজরত জয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।

;

ইতিহাস বদলে দেওয়া বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট



মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বদর যুদ্ধে আল্লাহতায়ালা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দ তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত হয়েছিল ইসলামে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় বদর যুদ্ধ। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ, ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এই বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিব নিরস্ত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীদের বিজয়ী করেছিলেন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায়।

ঘটনার সূত্রপাত
মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের হাওয়া মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলমানরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য অহি লাভ ও মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামি রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

আরবের অমুসলিমদের ওপরও বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এ ছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল- যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

;