প্রবাসেই এক একজন ‘সুপার শেফ’
পবিত্র মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: দিনে প্রচণ্ড তাপ। গায়ে ফোসকা পড়া গরম! নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেই গরমে কেউ বাইরে বের হন না। তবে প্রবাসীদের জীবন ভিন্ন। দিনরাত বলে এখানে কিছু নেই। পেটের তাগিদের তপ্ত আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করেই চলতে হয় তাদের। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে তারাবির নামাজ আদায় করে ঘরে ফেরা মক্কা প্রবাসীদের অনেকের রাতটাও কাটে ভিন্ন এক ব্যস্ততায়।
তখন তারা এক একজন হয়ে ওঠেন ‘সুপার শেফ।’ প্রবাসী সমমনাদের নিয়েই তাই এখানে তাদের বৃহৎ এক ‘ব্যাচেলর পরিবার।’ দেশে যিনি নিজের কখনও চা তৈরি করেননি, তিনিও এখানে মাটন বিরিয়ানি বা গরুর মাংসের সেরা রন্ধনশিল্পী!
কিভাবে?
‘পরিবেশ আর পরিস্থিতির কারণে’- বলছিলেন, চট্রগ্রামের সাতকানিয়ার পশ্চিম ঘাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে জসিম উদ্দিন (৩২)। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী। মসজিদ আল হেরেমের কাছে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের পারিবারিক মুদি ও কাঁচামালের ব্যবসা। বড় ভাই আর ভাগ্নেকে নিয়ে এখানে স্বজনদের এক পরিবার। তার বাইরে আঞ্চলিকতার টানে নিজ জেলার মানুষদের নিয়ে বৃহৎ অন্য এক পরিবারের সদস্য তিনি।
প্রবাসে রীতিটাই এমন। দেশে যে প্রবাদ আছে, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’ তেমনি এখানে যিনি রেমিটেন্স যোদ্ধা, তিনিই আবার নিজ ঘরে সেরা রাঁধুনী। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়েই এখানে তাদের সমাজ। স্ত্রী ছাড়াও দেশে থাকা ছেলো মোহাম্মদ (৪) আর মেয়ে মুসলিমা ইসলামের (৩) উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দিন পেরিয়ে রাত কাটে প্রবাসী জসিমের। ‘আমি বিরিয়ানি আর খিঁচুড়ি বেশ ভালো রাঁধতে পারি’- নিজের রন্ধন শিল্প নিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গেই বলছিলেন জসিম। তবে সব কাজ করে নিজের জামা-কাপড় ধুতে গেলেই লাগে বিরক্তি। তারপরও এখানে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়- বলছিলেন জসিম।
প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সাহরির মূহুর্তের সাক্ষী হতে বার্তা২৪.কম যায় মসজিদ আল হারামের পাশে উপত্যকার জাবাল-এ-সুদান নামের জায়গাটিতে।
পাহাড়ের ওপর তিনতলা পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রবাসীদের অনেকের বাস এখানে।
এক কক্ষে থাকেন গোটা চারেক মানুষ। তার মাঝের জায়গাটি সেজেছে সাহরির আহারে। নাকে ভেসে আসে গরুর মাংসের ভুনা, গরম ভাত আর দেশ থেকে আসা পদ্মার ইলিশের তৈরি কারির সুগন্ধি সৌরভ। কথায় বলে- ঘ্রাণেই অর্ধ ভোজন!
আজকের সাহরির ‘শেফ’ কে?
‘আমি। রাত ১টা থেকেই চলছে রান্না-বান্নার আয়োজন’- বলছিলেন, চট্রগ্রামের সাতকানিয়ার পৌরসভার কালা চাঁদপাড়া মহল্লার মোজাহের মিয়ার ছেলে জসিম উদ্দিন (৩৪)।
ভাগ্য অন্বেষণে ১৩ বছর ধরে প্রবাসী এখানে। খাবার মুখে দিয়েই তৃপ্তি নিয়ে বলতে হলো, ইলিশ আর গরুর ভুনা। রান্নায় দু’টোই অসাধারণ।
একমাত্র নবজাতক সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা পাহাড় চাপা দিয়েই পাহাড়ে ওপর বসবাস জসিম উদ্দিনের। তবে দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের নতুন কাউকে পাশে পেলে আপন করে নেন। ভুলে যান নিজের কষ্ট আর দুঃখগুলোকে।
সাহরিতেই দেখা মিললো মফিজুর রহমানের (২৮)। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার বারদোনা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে।
বছর দেড়েক সৌদিতে। বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন। তার আগে এক দশকের বেশি সময় কেটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এখানকার পাঁচ তারকা হোটেলের হাউস কিপিং শাখার সুপারভাইজার। তার বাইরে কর্মের সূত্রেই প্রবাসীদের অরেকের কাজ জুটিয়ে দিয়ে ভাগ্য গড়ে নিজেকে পরিণত করেছেন অন্যের আপনজনে। যদিও মন পড়ে থাকে দেশে। মাত্র ৫ বছরের কন্যা সিদরাতুল জান্না মারওয়ার কাছে।
‘আমরা পালাবদল করে রান্নার কাজটি করি। ব্যস্ততার বাইরে রান্নাটা বেশ উপভোগ করি। এক একটি দিন নিজেরাই এই কাজটি ভাগাভাগি করে নেই। এতে ক্লান্তি আসে না। বরং প্রবাসে জীবনের এই সংসারে ভ্রাতৃত্ববোধ আর সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার আনন্দ’- যোগ করেন, মফিজুর রহমান।