আমার সোনার বাংলা যেভাবে আমাদের জাতীয় সংগীত হলো
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি কেবল দেশের সম্মান, মর্যাদা ও আত্মপরিচিতির প্রতীকই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটিও। আজ থেকে শতবর্ষেরও বেশি আগে এই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি যেমন ছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী জাগরণে প্রেরণার উৎস, ঠিক তেমনি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও সঞ্জীবনী হিসেবে কাজ করেছে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের মুক্তিকামী আপামর জনসাধারণের জন্য।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, এই গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদসভায়। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ভাদ্র) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে ছাপা হয় গানটি। একই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও তা প্রকাশিত হয়।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের ডাক-পিয়ন গগন হরকরা (বাউল গগন চন্দ্র দাস) রচিত ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের অনুষঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন বাউল গানের সহজ সুরে এবং বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে সেই সুরের প্রভাবে। বাউল গানের ছন্দের প্রকৃতি ও তার চলনও মুগ্ধ করেছিল তাঁকে। বাউল বস্তুতান্ত্রিক মতবাদ সম্পর্কে তিনি সাধারণের থেকে বেশি অবহিত হলেও, তা তাঁর ব্যক্তিগত মতবাদ বা ধর্মবিশ্বাসকে অতিক্রম করেনি। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের রসগ্রাহী ছিলেন এবং তার সমাদর করতেন। তৎকালীন বঙ্গসমাজে সেটিকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাই, এই গানের সুরে বাউল-সুরের প্রভাবটা থেকেছে স্বাভাবিকভাবেই।
সরলা দেবী চৌধুরানী ইতঃপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তাঁর ‘শতগান সংকলন’-এ গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশি গানের সুরই গৃহীত হয়েছিল এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে। যদিও পূর্ববঙ্গের বাউল ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি এর আগেই হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা। শিল্পী গোপালচন্দ্র সেনের কণ্ঠে গানটি প্রথম রেকর্ড করা হয়।
এই সংগীত অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশি আন্দোলনের সময়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী (১৯০৫) রাজনীতিক, স্বদেশ আন্দোলনের কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এ গান প্রচার করেন। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ স্তিমিত হয়ে পড়লে কমে যায় এই গানের প্রচলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে পুনরুজ্জীবন ঘটে গানটির। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে গাওয়া হয়েছিল গানটি। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গীত হয়।
এরই মধ্যে, ৩ মার্চ তারিখে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে ঘোষিত ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতিরত স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা ছিল বেশ থমথমে। আগের রাতেই অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল সাবেজাদা মো. ইয়াকুব খান ১১০ নম্বর সামরিক আদেশবলে পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত ও চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন। এই আদেশ লঙ্ঘন করলেই দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
এসব প্রতিকূল পরিস্থির ভেতর ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি নির্বাচন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবসি’ গানটি গাওয়া হয়। এরপর শাহজাহান সিরাজ পল্টন সভায় পতাকা উত্তোলন করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথম জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয় এই গান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন (মোট চরণ সংখ্যা পঁচিশটি)। যন্ত্রসঙ্গীতে ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় প্রথম চারটি লাইন। সাংবিধানিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৪.১ অনুচ্ছেদ অনযায়ী। একই বছর বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে কিছু মানুষ মাঝেমাঝে নেতিবাচক কথা বললেও এই গান সত্যিকারভাবেই প্রথিত রয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে। শ্রোতাদের পছন্দানুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি প্রথম স্থান দখল করে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ২০৫টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনামূলক বিচারে ‘দৈনিক গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মতে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় উরুগুয়ের জাতীয় সংগীত।
গানটি চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয় ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের নিয়মকানুন বা আনুষ্ঠানিকতা
ক. স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলিতে সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
খ. রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী যেসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন সেসব অনুষ্ঠানে তাঁদের আগমনের ও প্রস্থানের সময় সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
গ. রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টোস্ট করার সময় পূর্ণ জাতীয় সংগীত এবং তাঁদের অনুপস্থিতিতে মাত্র প্রথম চার ছত্র পরিবেশিত হবে।
ঘ. কোন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে গার্ড অব অনার প্রদানকালে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন প্রদানের সময় পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রথমে অতিথির দেশের জাতীয় সংগীত এবং পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। কিন্তু অতিথি সরকারপ্রধান হলে কেবল প্রথম চার ছত্র পরিবেশিত হবে।
ঙ. বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলির সরকারি অনুষ্ঠানে কেবল প্রথম চার ছত্র পরিবেশিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রথমে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং পরে সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
চ. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কূটনৈতিক মিশন আয়োজিত অন্যান্য সকল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, বিশেষ অনুষ্ঠান ও জনসভায় অনুমোদিত বিধি অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
ছ. সাধারণ নাগরিক এবং ইউনিফর্ম পরিহিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সম্মান প্রদর্শনের অনুমোদিত বিধি রয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্য সকল প্রকাশ্য স্থানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক জাতীয় সংগীত কণ্ঠে বা বাদ্যযন্ত্রে পরিবেশনের বিস্তারিত নিয়মকানুন রয়েছে।