ঘানি



রেহানা বীথি
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

মসজিদের মিনার ডিঙিয়ে তেরছাভাবে রোদটা এসে পড়েছে একেবারে নুরু মোড়লের খড়ের চাল পেরিয়ে উঠোনটায়। কিছুক্ষণ আগেও ওখানে ছিলো জমজমাট কুয়াশা। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানাতেই শুয়ে থাকে নুরু মোড়ল। বেটার বউরা কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছে, এই শীতে অতো ভোরে বাইরে না বেরোতে। কিন্তু মনটা তাও আঁকুপাঁকু করে। কত আর শুয়ে থাকা যায়! চুপিচুপি বেরিয়ে গেছিলো দিন দশেক আগে। লাঠিতে ভর দিয়ে পায়ে পায়ে ঘর পেরিয়ে উঠোন, উঠোন পেরিয়ে বাঁশের ঝাঁপ টা সরিয়ে একেবারে রাস্তায়। কুয়াশায় সাদা চারপাশ। তারওপর ছানিপড়া চোখ। কিছুই দেখতে পেলো না ঠিকমতো। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। বিকেল হতে না হতেই নাক, গলা সব বুঁজে এলো সর্দিতে, সাথে ধুম জ্বর। বুড়ো হাড়ে পৌষের হিম সইবে কেন? সেই থেকে বৌমারা চোখে চোখে রাখে। হেঁসেল থেকে গলা বাড়িয়ে দেখে নেয়, শ্বশুর ঘরে আছে তো? তারপর থেকে ভোরবেলাটা ঘরেই থাকে নুরু মোড়ল। পেচ্ছাব টেচ্ছাবের বেগ সে ফজরের নামাজের আগেই সেরে নিয়ে, বিছানায় বসে বসে নামাজ পড়ে শুয়ে যায় লেপ গায়ে দিয়ে। সারারাতে গরম হওয়া লেপটার ওমে তখন আরাম লাগে বেশ। আবারও জড়িয়ে আসে চোখ। যেন আধো ঘুম আধো জাগরণ। মৃদু ঝাঁঝালো কিন্তু খুব মিষ্টি একটা সুবাস নাকে ধাক্কা দেয় তার। চোখে ভাসে দিগন্তজোড়া হলুদ। পৌষের হিম হাওয়ায় দুলছে সেই হলুদ..... সেই সর্ষে ক্ষেত।

জেগে ওঠে নাতি নাতনিরা। বেটার বউরা হাঁস-মুরগিগুলো ছেড়ে দেয়। ছড়িয়ে দেয়া দানা খুটে খেয়ে বেরিয়ে যায় ওরা। পৌষেও জেগে ওঠে পাড়া। নুরু মোড়লও জেগে ওঠে পুরোপুরি। বিছানা থেকেই বার বার উঁকি দিয়ে দেখে কুয়াশার হালকা হওয়া। রোদটা যখনই মসজিদের মিনার ডিঙায়, টুক টুক করে এসে বসে সে উঠোনে। সূর্যের ওমে পিঠ পেতে দিয়ে দেখতে থাকে পথচারী চলাচল। টুংটাং সাইকেল রিকশা, দুই একটা অটোও যাওয়া আসা করে হেলেদুলে। মন্থরগতি গরুর গাড়িও দেখা যায়। তবে এখন খুব কমে গেছে সে গাড়ি। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্রলি নামক বিকট শব্দওয়ালা এক বাহন। সামনে বসানো শ্যালো মেশিনই যার ইঞ্জিনের কাজ করে। নুরু মোড়লের খুব রাগ হয় ওগুলো দেখে। কোথায় গরুর গাড়ি আর কোথায় এই ট্রলি! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিজের শূন্য ঘানির ঘরটার দিকে চেয়েও। তিনদিকে মাটির শক্ত দেয়াল, ওপরে খড়ের চাল। অব্যবহৃত ঘানিটাও যেন তাকিয়ে আছে নুরু মোড়লের দিকে। বুকের ভেতরটা কেমন এক অজানা কষ্টে ভরে যায়। মনে পড়ে সেই ভোরবেলার ঘুমঘোর... সেই নাকে ধাক্কা দেয়া সর্ষেফুলের সুবাস!

নুরুল ইসলাম নাম তার। কোনোকালে বংশে হয়তো কেউ মোড়ল ছিলো, সঠিক জানা নেই। তারই রেশ ধরে গাঁয়ের লোকজন মোড়ল ডাকে। পেশা ছিলো যার ঘানি ঘুরিয়ে তেল বানানো। বংশীয় পেশা। এ রূপমতী গাঁয়ে তো বটেই, আশেপাশের দু'তিন গাঁয়েও নুরু মোড়লদের ঘানিই ছিলো একমাত্র ভরসা। সেই ঘানিই কিনা অকেজো এখন। কী যুগ এলো! কারেন্টের আলোতে রাতগুলো দিনের মতো।চারিদিকে শুধু মেশিনের ছড়াছড়ি। জমিতে হাল দেয়া, ধান মাড়ানো, ধান ভাঙানো, আটা ভাঙানো, এমনকি সর্ষেও! সব মেশিন, সবই মেশিন। বড়ছেলেকে বলেছিলো, বংশের ধারাটা বজায় রাখতে। কে শোনে কার কথা? ঘানির বলদদুটোকে বেঁচে দিয়ে মুদিখানার দোকান দিলো । বাড়ির উঠোনটা ঘিরে রেখেছে যে চাটাইয়ের বেড়া,তারসাথে লাগানো সেই দোকান। বেচাবিক্রি ভালোই হয়। তা হোক,তবুও বংশের পেশা ছেড়ে দেয়ায় নুরু মোড়লের রাগ রাগ ভাবটা থেকেই গেছে ছেলের ওপর। ছোট দুই ছেলে যেটুকু জমিজিরাত আছে তাতেই করে কর্মে খায়। দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে পরের ঘরে। বচ্ছরে দুই তিনবার ছেলেপুলে নিয়ে আসে বাপের বাড়িতে। 

থেকে যায় ক'দিন করে। বাড়িটা তখন নাতি নাতনিতে ভরপুর। বড় ভালো লাগে নুরু মোড়লের। ভালোলাগায় চোখ ভিজে যায়। বুড়ির কথাও মনে পড়ে তখন। কেন যে এ ভরা সংসার রেখে ওপারে চলে গেলো বুড়িটা তাকে ফেলে! রোদে পিঠ পেতে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঝিমুনি চলে আসে। সাদা হয়ে যাওয়া পাঁপড়িওলা চোখের পাতা বুঁজে আসতে চায়। দড়ির চৌপায়ায় বসা নুরু মোড়লের বৃদ্ধ শরীরটা গুটিয়ে এতটুকু। ঠিক যেন কাপড়চোপড়ের একটা পুঁটলি।

দাদা, চলো, মা ডাকে। খাবা না?

ধীরে ধীরে মুখ তুলে চায় নুরু মোড়ল। আবছা দৃষ্টিতেও নাতনির মুখটা বড় সুন্দর লাগে তার। যেন দাদির মুখটা কেটে বসানো ওই মুখে। তেমনই সোনার মতো গায়ের রঙ, পিঠে ছড়ানো ঘন কালো চুল। ঝকঝকে মুক্তোদানার মতো দাঁতগুলো মেলে যখন হাসে নাতনি, অবিকল যেন ওর দাদি, সেই যৌবনের জহুরা খাতুন!

-- আব্বারে একটু বুজাইলেও তো পারো। তোমারে খুব মায়া করে।

--  আমি পারুম না। ওই ঘর আব্বার জানের চাইতেই বেশি। শ্বাশুড়ি বুক দিয়া আগলাইয়া রাখছিলেন ওইডা। দুইজনে মিইলা ঘানি ঘুরাইয়াই তো তোমাগো মানুষ করছে।

--  মানুষ করছে না ছাই! লেহাপড়া শেখাই নাই। লেহাপড়া শিখাইলে আইজ....

--  কী কও? চুপ করো। তোমাগো দৌড় জানা আছে। শ্বাশুড়ির মুখে শুনছি, চেষ্টা কিছু কম করে নাই। তোমরা ভাইগুলানই বলদ । ঘানির বলদগুলারও কিছু বুদ্দি থাকে, তোমাগো তাও নাই। থাকলে ঠিকই লেহাপড়া শিখবার পারতা।

বউয়ের ধমক খেয়ে কিছুটা চুপসে যায় মাসুদ আলী। ঠিকই তো। মা মেলা চেষ্টা করছিলো বটে। তয় তাগো মাথায় আসলেই গোবর। নাইলে অন্ততঃ ম্যাট্রিকটা তো পাশ করবার পারতো! যাক, না পারলে কী আছে, দোকান আর জমি দিয়া তো তাগো ভালোই চইলা যায়। তয় এখন খরচ বাড়তাছে। পোলা মাইয়াগুলা লেহাপড়া করে। তাগো বই খাতা পেরাইভেটের খরচ। মাইয়াডা আইএ ক্লাসে পড়ে। দূরে কলেজ, হাঁইটা যাইতে কষ্ট খুব। অটোতে যায়, ভাড়া লাগে। পোলাডা বি এ পাশ কইরা এম এ ভর্তি হইলো। তারও মেলা খরচ। সে অবশ্য সাইকেলেই চলাফেরা করে। দুই ভাইয়ের বাচ্চারাও বড় হইতেছে। খরচও বাইড়া গেছে। জমির ধান খাইয়া আর বেচতে পারে কই? তারওপর ধানের দামও কম। বেইচাও খুব একটা লাভ হয় না।

গাঁয়ের মানুষ এখন খুব সৌখিন হইছে। আগের মতোন দুইখান কাপড়েই বচ্ছর চালায় না। যাগো ট্যাকা আছে তারা সারাবচ্ছরই কিনতে থাকে। ঈদ পরব তো আছেই।

তাই মাসুদ আলীর শখ জেগেছে মনে মনে, একখান গার্মেন্টস এর দোকান দেয়। রেডিমেড জামাকাপড় শহর থেকে এনে বেচে সেই দোকানে। শহরেও ভাড়া নিয়ে দোকান দেয়া যায়, কিন্তু ভাড়া যে মেলা! তারচাইতে নিজের বাড়িতেই যদি ওই অকেজো ঘানির ঘরটা পাওয়া যায়, ঠিকঠাক করে ওখানেই দোকান দেবে বড় করে। গাঁয়ের লোকজনকে আর কষ্ট করে শহরে যেতে হবে না কাপড় কিনতে।বউটাকে মনের সে কথা জানায় সে। বউটাও নিমরাজি, কিন্তু শ্বশুরকে ওই ঘরের কথা বলতে পারবে না কিছুতেই।

চুপসে গেলেও বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে গজ গজ করতে থাকে মাসুদ, কি হইবো ওই ঘর রাইখা। ঘানি তো আর ঘুরবো না কুনুদিন। কে ঘুরাইবো ঘানি?

--  না ঘুরলে কী? শ্বশুর কয়, শ্বাশুড়ির আত্মা ঘোরে ঘরখানায়। দেখো না, লাঠি ঠকঠকাইয়া মাজে মদ্যেই কি যেন খুইজ্যা বেড়ায় ওইখানে। দূর থাইকাও কেমুন উদাস চাইয়া থাকে। বড় মায়া লাগে গো! বুড়া মানুষটার জইন্যে খুব মায়া লাগে। কত বছর হইলো বউ মরছে, তবুও দেহো, কেমুন ভালোবাসে এহনও বউরে!

বলে একটু আদুরে অভিমানী গলায় বলে স্বামীকে, আমারে তো তুমি একটুও ভালোবাসো না। বাসলে বুঝতা বাপের মনডা।

তাছাড়া দোকানের মাল কিনতেও তো ট্যাকা লাগবো, পাইবা কই?

চোখের দৃষ্টিতে কি যেন খেলে গেলো মাসুদের। বউয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো, আব্বারে কইয়া দশ কাঠা জমি বেইচা দিমু!

অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায় শেফালি। এইডা কী কইতাছো, আব্বা রাজি হইবো না। যেটুক জমি আছে, পাঁচ ভাই বইনের। তুমি বেচবার চাও কোন সাহসে? তুমার কি মাথা খারাপ হইয়া গেলো?

--  মাথা খারাপ হইবো ক্যান? দোকানের ইনকাম কি অরা খাইবো না? আর ওই ঘরখান, বুকের মইদ্যে ঘানি লইয়া খাড়ায় আছে, কি দাম আছে তার? খামাখা ফালায়া রাইখা হইবোডা কী? যত্তসব ফালতু!

বিছানা থেকে নেমে মাটি কাঁপিয়ে হেঁটে বাতিটা নিভিয়ে দিলো মাসুদ আলী। বিছানায় এসে জোরের সাথে লেপটা টেনে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো বউয়ের দিকে উল্টো হয়ে।

এশার নামাজ পড়ে বিছানাতেই গুটিসুটি শুয়েছিলো নুরু মোড়ল। তসবি গুনতে গুনতে কানে এলো আবছা, ছাড়া ছাড়া কিছু কথা। খুবই আবছা, তবুও বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো কথাগুলো শুনে। এ কী বলছে ছেলে! নাকি ভুল শুনছে সে? ভুলও হতে পারে। ছেলে তার এমন কথা ভাবতেই পারে না। ঘানি চালাতে রাজি হয়নি বটে, তবে ঘরটা তো এতদিন যেমন ছিলো তেমনই রয়েছে। একদিনও তো ছেলেরা ভেঙে ফেলতে চায়নি তা! একদিনও তো বলেনি কেউ, ওটার কোনো দরকার নেই, মুছে ফেলি ওই স্মৃতি! তাহলে আজ কেন পাশের ঘরের আওয়াজ ভেসে এলো মাটির দেয়াল ভেদ করে? ভুল ভুল, নিশ্চয়ই ভুল! 

কোনটা ভুল, ছেলের কথাগুলো নাকি নুরু মোড়লের ভাবনা? হতেও পারে। পুরোনো স্মৃতিকে এভাবে আঁকড়ে থাকাটা ভুল হতেও পারে। সত্যিই তো! সংসার বেড়েছে, বেড়েছে খরচও। ওই ঘরটা যদি কাজে লাগায় ছেলে নিজের মতো করে, ক্ষতি কী? গাঁয়ের অনেক মাটির বাড়ি এখন পাকা। তার ছেলেরাও তো চাইতে পারে উন্নতি হোক। মাটির দেয়াল ভেঙে ইট সিমেন্টের ভিত উঠুক ভিটেতে তাদের। খারাপ তো কিছু চাইছে না ছেলে। না না, ভুল তারই। ওই ঘর, ওই ঘানি তার বংশের ইতিহাস। সে ইতিহাস পাল্টাতেও তো পারে। শুরু হতে পারে নতুন গল্প, নতুন ইতিহাস। জহুরার বাস তো তার অন্তরে। অন্তরেই থাকবে। ছেলেরাও তো তাকে কখনও অযত্ন করেনি। ছেলের বউরাও যেন নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছে তাকে। মৃত শ্বাশুড়ির কথাও তো তারা স্মরণ করে সম্মানের সাথে। ওদের মনে কষ্ট লাগে এমন কিছু হোক চায় না তা নুরু মোড়ল। ওরা ভালো থাক, নাতি নাতনিরা মানুষ হোক, এর বাইরে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে তার? সকালে উঠেই ছেলেকে বলতে হবে, আপত্তি নেই, সাজিয়ে তুলুক দোকান সে নিজের মতো করে। ভবিষ্যত গড়ে তুলুক তাদের সন্তানদের।

রাত বাড়ে, পৌষের হিমে ঘন হয়ে আসে আঁধার। শান্ত হয়ে আসে নুরু মোড়লের বুকের উথাল পাথাল। মনটা তার হালকা লাগছে অনেক। যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত লাগে নিজেকে। ছেলেরা তাদের নিজেদের জীবন বুঝে নিতে শিখেছে, এর চেয়ে বড় সুখের আর কী হতে পারে? এবার সে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারে ওপারে। ওখানে যে জহুরা তার অপেক্ষায় আছে! ওই তো ডাকছে তাকে জহুরা। ডেকে ডেকে মিলিয়ে গেলো যেন কোথায়! কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো ঘানির জোয়ালের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। মিলিয়ে গেলো যেন ফোটায় ফোটায় তেল পড়ার শব্দ । সর্ষের তেলের ঝাঁঝও যেন মিলিয়ে গেলো বাতাসে, নতুন কোনো গল্প হয়ে।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;