দনিয়া আরমানদোর পর্ণকুটির



মঈনুস সুলতান

  • Font increase
  • Font Decrease

মাস দুয়েক ধরে আমি নিকারাগুয়ার ইসতেলি বলে একটি মফস্বল শহরে বাস করছি। অদূর ভবিষ্যতে লাতিন আমেরিকায় পেশাদারী কাজের ধান্দায় আমার এসপানিওল বা স্প্যানিশ ভাষা শেখার প্রয়োজন হয়েছে। তো, ইসতেলি শহরে আছে ইসকুয়েলা হোরাইজনতি বলে চমৎকার একটি এসপানিওল ভাষা শেখার স্কুল। ওখানে আমি ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা করছি। মি. চার্লসের সাথে ইসকুয়েলাতে আমার পরিচয় হয়েছে। তাঁর পুরো নাম চার্লস ডেভান। বয়স সত্তর, তবে ব্যায়াম করা পেটানো দেহের জন্য তাঁকে দেখায় মেরেকেটে বাষট্টির মতো। এক সময় কাজ করতেন আমেরিকান এয়ার ফোর্সে, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, ভ্রমণ করেন, নিজেকে হিস্টোরিয়ান হিসাবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। কিসের ইতিহাস, কেন তিনি তা লিখছেন, ইত্যাদি এখনো আমি ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি।

মি. চার্লস বর্তমানে এসপানিওলের কোনো ক্লাসের ছাত্র নন। তবে বছর দেড়েক আগে তিনি এ ইসকুয়েলাতে এসে এসপানিওলের ওপর একটি কোর্স করেছেন। সে সূত্রে শিক্ষয়িত্রী সিনোরিতাদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব খুবই মজবুত। তিনি প্রায়ই তাঁদের জন্য এক্সপেনসিভ চকোলেট বার নিয়ে আসেন। তারপর, আঙিনায় হোমওয়ার্ক করার জন্য পেতে রাখা চেয়ার-টেবিলে বসে পুরানো পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়েন। এবং আমাকে অবসর দেখলে আলোচনা জুড়ে দেন। তাঁর আলাপের প্রিয় প্রসঙ্গ হচ্ছে—নিকারাগুয়ার বংশানুক্রমের ডিক্টেটর শাসক গোষ্ঠী তথা সমোজা পরিবারের রাজনৈতিক গলদ কোথায় ছিল? সান্দিনিস্তা বলে বামপন্থী বিপ্লবীরা ক্ষমতায় এসেছে মূলত কিসের জোরে? আর শহরের তরুণদের মধ্যে ইদানীং ছড়াচ্ছে যে ড্রাগস ও ভায়োলেন্স, তা রোধ করা যায় কিভাবে ইত্যাদি।

গ্যালারিতে মৃতদের ছবিগ্যালারিতে মৃতদের ছবি

ইসতেলি শহরে মি. চার্লস পর্যটক হিসাবে একটি হোটেলে মাসওয়ারি কড়ারে বসবাস করছেন। তিনি ক্যাটাগরিতে পর্যটক হলেও কী কারণে জানি শহরের আওয়ারা তরুণদের নানা কিসিমের প্রকল্পে যুক্ত করে মাতিয়ে রেখেছেন। এ ধরনের একটি প্রকল্প হচ্ছে—মস্ত রঙিন কাপড় পালের মতো উড়িয়ে তাদের রলারস্কেট করা শেখানো। তাঁর আস্তানা হচ্ছে বিপ্লবী যুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া মৃতদের স্মরণে সৃষ্ট একটি গ্যালারি। নিকারাগুয়ার সাম্প্রতিক বিপ্লবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোদদপুষ্ট সমোজা চক্রকে সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে প্রগতিশীল বাম ধারার সান্দিনিস্তা পার্টি। এ যুদ্ধে ইসতেলি শহরের তিনশো মানুষ আত্মহুতি দেন। তাঁদের ফটোগ্রাফস্, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কাটিং, কাপড়-চোপড়, বুটজুতা ও বন্দুক দিয়ে দনিয়া নিনো আরমানদো বলে এক মহিলা গড়ে তুলেছেন এ স্মারক গ্যালারি।

যুদ্ধে দনিয়া নিনো’র দুটি ছেলের মৃত্যু হয়। প্রথমে তাঁর চৌদ্ধ বছর বয়সের ছোট ছেলেকে সমোজা চক্রের সৈনিকরা প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করে। পরে মৃত্যু হয় আঠারো বছরের বড় ছেলের। বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁর কাটা মুণ্ডু প্রদর্শিত হয় শহরের পার্কে।

গ্যালারিতে কোনো আর্থিক অনুদান নেই। মি. চার্লস ওখানে মৃত যোদ্ধাদের জননীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ল্যকেল হিস্ট্রি লেখার একটি প্রজেক্ট করছেন। তাঁর প্ররোচনায় আমিও গ্যালারিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কিছু কাজে সামিল হচ্ছি। এ সুবাদে গ্যালারির ব্যবস্থাপক দনিয়া নিনো আরমানদোর সাথে আমাদের দুজনের তৈরি হচ্ছে হার্দিক সম্পর্ক। আর সত্যি কথা বলতে—দনিয়া নিনোর আচরণে এমন কিছু আছে, যার জন্য তাঁকে আমার আত্মীয়-স্বজনদের মতো আপন মনে হয়। তিনি দিন দুয়েক গ্যালারিতে আসেননি। মহিলা সম্ভবত অসুস্থ। মি. চার্লস প্রস্তাব করেন—চলো সুলতান, তাঁর বাড়িতে যাই, দেখে আসি—কী রকম আছেন দনিয়া, কী হয়েছে তাঁর? দনিয়ার আর্থিক অবস্থা কেমন, তাঁর পরিবারের সকলে কিভাবে বসবাস করেন, এ বিষয়টি জানতে আমার আগ্রহ আছে। তার ওপর বিকালবেলা আমার কোনো কাজবাজ নেই, তাই আমি কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে রওয়ানা হই, মি. চার্লসের সাথে দনিয়া নিনোর বসতবাড়ির দিকে।

ছাপড়া কফিশপের সামনে পাবলিক বাস

ছাপড়া কফিশপের সামনে পাবলিক বাস

খুবই সংক্ষিপ্ত শর্টকার্ট পথ ধরে মি. চার্লস আমাকে নিয়ে আসেন শহরের লাগোয়া মিরাফ্লোর পাহাড়ের বেইসে। পথের ধারের এক ছাপড়া কফিশপে বসে আমরা পাবলিক বাসের অপেক্ষা করি। একটা বিষয়ে খটকা লাগে—মি. চার্লস ছোট শহরের চিপাগলি ও কোনাকুনি সব শর্টকার্ট এত ভালো করে চেনেন কিভাবে? তিনি কফিশপ থেকে দনিয়া নিনো আরমানদোর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু সালচিচা বা মশলাদার সসেজ কেনেন। পাবলিক বাসে ছাদের ওপরও কয়েকজন মানুষ বসে আছেন। ভেতরের ভিড়ে আমরা রড ধরে দাঁড়াই। মিরাফ্লোর পাহাড়ের গোড়ায় টিলা-টক্কর ও মাঠ-প্রান্তরে ছড়ানো বেইসটি বিশাল। চাষীরা মিষ্টিআলু, যব ও তামাকের ক্ষেতে কাজ করছে। পাহাড়ের গোড়া পেঁচিয়ে উঠে যাওয়া সড়ক ধরে খানিক আগ বাড়িয়ে বাসটি উল্টা দিকের সমতলে থামলে, আমরা নেমে পড়ে চষাক্ষেতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে আসি দনিয়া নিনোর বাড়িতে।

তাঁর বাড়ির হাতায় খোলামেলা বেশ কিছু জমি। তাতে ফলছে শাকসবজি, ঘাস খাচ্ছে কয়েকটি গরু ও ছাগল। দুটি মুর্গা কককক করে তাড়া করে এসে উড়াল দিয়ে উঠে বসে ঘরের চালে। তাঁর ঘরটি দ্বিতল হলেও অবস্থার নিরিখে তা পর্ণকুটির। অনেক বছর তাতে সারাই-মেরামত হয়নি বলে তা বেজায় রকম ঝুরঝুরে হয়ে আছে। মোরগের ককককে সজাগ হয়ে কে যেন কেশে গলা সাফ করে বলে ওঠেন—মিরা, কিয়েন ভিনো, বা দেখো তো কে আসলো? আমরা ততক্ষণে চলে এসেছি সামনের আঙিনায়। দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়েছিলেন দনিয়া নিনো, তিনি উঠে বসলে দেখি, তাঁর চুলে বেড় দিয়ে পেঁচানো একটি লতা, তাতে গোঁজা রঙিন পাখির পালক। শরীর তাঁর খারাপ করেছে সকাল থেকেই, তাই তিনি গ্যালারিতে যেতে পারেননি। মাঝেমাঝে তাঁর এরকম হয়—মাথার আধখানা জুড়ে তীব্র ব্যথা। এ রকম চলে যায় দিন দুয়েক। লতা দিয়ে পেঁচিয়ে পালক গুঁজলে একটু উপশম হয়।

মিরাফ্লোর পাহাড়ের দৃশ্য

মিরাফ্লোর পাহাড়ের দৃশ্য

বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে তাঁর স্বামী ডন আরমানদো। তিনি বসে বসে মৃদু স্বরে শুনছেন ট্রানজিসটার রেডিও। তাঁর সামনের বেঞ্চে বসে মি. চার্লচ আমার সাথে ডন আরমানদোর পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর, তাঁকে এক প্যাকেট মার্লবরো সিগ্রেট উপহার দেন। ডন আরমানদো একটি সিগ্রেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলেন—সারা জীবন আমি স্লোগান দিয়েছি আবাহো এল ইমপিরিয়েলইজমো ইয়াংকি, বা নিপাত যাক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, তবে অই দেশের একটা জিনিস আমি পছন্দ করি, তা হচ্ছে মার্লবরো সিগ্রেট, স্বাদে বড়ই মোলায়েম। তিনি আরেক দফা ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে এক শলা বাড়িয়ে দেন। চোখ থেকে গড়িয়ে নেমে আসা জল মুছলে আমি খেয়াল করে বুঝতে পারি, তিনি দেখতে পান খুবই সামান্য, তাঁর চোখের মণি দুটোকে দেখায় শ্যাওলা মাখা মার্বেলের গুলির মতো। মি. চার্লস দনিয়া নিনোর সাথে আঙিনায় লাউ-কুমড়ার মাঁচা দেখতে গেলে, ডন আরমানদোর সাথে আমার কথাবার্তা বেশ জমে ওঠে।

দৃষ্টি স্বল্পতা নিয়ে জন্মাননি তিনি। পেশায় চাষী ডন আরমানদো বিপ্লবের আগে মিরাফ্লোরে মরালেস পরিবারের বিশাল কফি এস্টেট ফিনকা নেবলিনাতে কাজ করতেন। মূলত কফি চাষের লোক হলেও এস্টেটের ডাকসাঁইটে মালিক সিনিওর মরালেস যখন মিষ্টিআলু ইত্যাদির এক্সটেনশন শুরু করেন, ক্ষেতে রসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রভৃতি দেওয়ার ভার পড়ে ডন আরমানদোর ওপর। একবার সিনিওর মরালেস আমেরিকান এক কোম্পানির কাছ থেকে সংগ্রহ করেন এনহাইড্রাস এমোনিয়া বলে এ ধরনের সার। এটি স্প্রে করার সময় অসাবধানতায় কিছু ফিউম বা বিষাক্ত বাষ্প লিক করে বাতাসের ঝাপটায় এসে লাগে ডন আরমানদোর চোখমুখে। কিছুক্ষণের ভেতর তিনি চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। ফুলে ওঠে তাঁর চোখমুখ, জ্বালা-যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে এক পর্যায়ে সজ্ঞাহীন হলে প্রতিবেশি চাষীরা তাঁকে হ্যামোকে শুইয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় হাসপাতালে। পাঁচদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে। দিন পনের পর তাঁর চোখে কিছু আলো ফিরে আসে বটে, কিন্তু আগের মতো দেখার পুরাপুরি ক্ষমতা তিনি আর ফিরে পাননি কখনো। সে থেকেই ডন আরমানদো অর্ধেক অন্ধ, কাজকর্ম আর কিছু করতে পারেননি তেমন করে। মূলত বেকার ঘর-বৈঠকি জীবন যাপন করছেন প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছর হলো।

দনিয়া নিনো বারান্দার কোনায় স্টোভ জ্বেলে ফ্রাইপ্যানে ভাজছেন লালচে কফি বিন। তাঁর পাশে টুলে বসে ঘরের মানুষের মতো সহজাত ভঙ্গিতে গালগল্প করছেন মি. চার্লস। আমরাও একটু-আধটু কথা বলি। বিপ্লবের আগে এ বাড়িটিও ছিল মরালেস পরিবারের কফি এস্টেটের সম্পত্তি। চাষী হিসাবে ডন ও দনিয়া তাদের বালবাচ্চা নিয়ে এখানেই বাস করছিলেন। দৃষ্টিক্ষমতা খানিক ফিরে আসতেই সিনিওর মরালেসের কর্মচারীরা এসে তাঁকে আবার ক্ষেতে বিষাক্ত এনহাইড্রাস এমোনিয়া স্প্রে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। তিনি এ রসায়নিক স্পর্শ করতে অস্বীকার করলে তাঁর পরিবারকে একুশ দিনের উকিল নোটিশ দিয়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। একই সাথে ফিনকা নেবলিনাতে চাষী হিসাবে কাজ করার অধিকারও হারান তিনি।

দনিয়া আরমানদোর পর্ণকুটির

দনিয়া আরমানদোর পর্ণকুটির

তারপর দেশে বিপ্লব হলো। মরালেস পরিবারের এস্টেট সমাজতান্ত্রিক সরকার হুকুম-দখল করে নিলে ডন ও দনিয়া এ বাড়িতে ফিরে আসার আইনীস্বত্ব লাভ করেন। ফিনকা নেবলিনাও ইদানীং ভাগ করে দেওয়া হয়েছে যেসব চাষী বিপ্লবে শরীক ছিলেন তাঁদের মধ্যে। এ পরিবারের দুটি ছেলে যেহেতু মুক্তিসংগ্রামে আত্মাহুতি  দিয়েছে; তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁরা পেয়েছেন ফিনকা নেবলিনায় পাঁচ একরের কফি প্ল্যানটেশনের একটি প্লট। তাদের মেঝো ছেলে ওই পাঁচ একরে চাষবাস করে। সে বাসও করছে মিরাফ্লোরের মিডল লেয়ারে।

বারান্দার মাঝামাঝি ছোট্ট একটি টেবিলের ওপর কাঠের ক্রুশের পাশে পানি ভরা বউলে রাখা কিছু তাজা ফুল। তাতে এসে বসে একটি প্রজাপতি। আমি এ বেদির ওপর দেয়ালে টাঙানো জোড়া ফটোগ্রাফসের দিকে তাকাই। আত্মাহুতি দেওয়া ছেলে দুটোর ছবি আমি গ্যালারিতে দেখেছি, তাই তাঁদের চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। হামানদিস্তায় আধপোড়া কফি বিন কুটছেন দনিয়া নিনো, চারদিকে ছড়াচ্ছে তীব্র স্মোকি সৌরভ। ডন কাশতে কাশতে আরেকটি মার্লবরো ধরিয়ে চোখের জল মুছে বলেন—দেশে বিপ্লব হলো, যে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলাম সেখানেও ফিরে এসেছি, আমাদের মেঝো ছেলের কফি বিক্রি করে অবস্থাও খারাপ যাচ্ছে না; তারপরও আমরা ঠিক ইনসাফ পেলাম না। চুপাসংগ্রেজ বা ব্লাডসাকার সিনিওর মরালেস এখনো বেঁচেবর্তে আছে। এ আনসিয়ানো রিএকশনারিও, বা এ বুড়া প্রতিক্রিয়াশীলের নাতনি এখানকার একটি ভাষা বিদ্যালয় ইসকুয়েলা হোরাইজনতিতে বিদেশিদের এসপানিওল শেখায়।

দনিয়া নিনো ও মি. চার্লস আমাদের জন্য নিয়ে আসেন দু পেয়ালা কফি। আমি চুমুক দিতে গিয়ে দেখি, ডন আরমানদো উবু হয়ে হাতড়ে চেয়ারের নিচ থেকে বের করে আনছেন পোড়ামাটির এক সানকি। তাতে বেশ খানিকটা কফি ঢেলে শিস দিয়ে তিনি কাকে যেন ডাকেন। আঙিনা থেকে তাঁর কাছে  চলে আসে একটি ছাগল। সে ঘোলাচোখে ঘাড় কাত করে আমাদের কথাবার্তা শোনে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি, চুন লাগা পাথরের মতো তার রঙ। অন্ধ প্রাণীটি ডন আরমানদোর হাতে ধরা সানকি থেকে চেটে চকাস চকাস করে কালো কফি খায়। আর তিনি আপসোস করে বলেন—বিপ্লবের সময় আমরা ট্রেড ইউনিওন করেছি, কথা হয়েছিল লিবারেশনের পর দেশ থেকে উচ্ছেদ করা হবে বিষাক্ত রসায়নিক সার ও কীটনাশক, কিছু হলো কি? শুনি আজকাল আমেরিকান কোম্পানিগুলো ফিরে এসেছে, কৃষকদের তারা দিচ্ছে কিছু ফ্রি কীটনাশক। এগুলো মিশে যাচ্ছে পশুচারণ ভূমির পানির উৎসে। এতে অন্ধ হয়ে গেছে এ এলাকার বেশ কিছু গরু ও ছাগল। এ ছাগলটি অন্ধ হলে আমার প্রতিবেশি একে কসাইখানায় বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। আমি শুনতে পেয়ে তাকে কিনে নেই। ছাগলটি ঘাড় বাঁকা করে যেন আলাপের সরোৎসার বুঝতে পেরে চেটে দেয় ডন আরমানদোর হাত।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;