মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু



প্রিন্স আশরাফ
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইদানীং শামসাদ আজাদের মনে হয় মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু, চারিদিকে চোখকান খোলা রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। জন্মগতভাবেই চারপেয়ে মানুষ জোর করে দুপেয়ে মানুষ হয়ে নিজেকে একটা ঝামেলাযুক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। শামসাদ আজাদের এই চারপেয়ে অনূভূতি শুরু হয় সকালে পত্রিকা নিয়ে হাইকমোডে বসার পর থেকেই। পত্রিকার নৈর্ব্যক্তিক খবরগুলোর সাথে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য মিলিয়ে তার মনে হয় চারপেয়ে জন্তু হলে তাকে এখন এই অদ্ভুত দুপেয়ে পজিশনে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে মলত্যাগের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না, চারপেয়ে জন্তুরা শারীরিক গঠনগত কারণেই স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করে, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে না।

দেশের সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের ধারণায় একটা তরতাজা প্রাণকে তারই সহপাঠী শিক্ষার্থীরা রাতভর নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দেখে এবং পড়ে শামসাদ আজাদের না হওয়া মলত্যাগ বন্ধ হয়ে গেল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাবা চাচারাই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুর নাক, কান, লিঙ্গ কেটে সেই ধারালো অস্ত্র দুখানিই নৃশংসভাবে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে শিশুটিকে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। খুন, ধর্ষণ, নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনাসহ মানুষের ভেতরের পশু প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেখলে শামসাদের নিজেকেও চতুষ্পদী জন্তু বলে মনে হতে থাকে।

শামসাদ আজাদ হাই কমোডের ওপর বসা অবস্থা থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমের মেঝেতে দুহাত সামনের পায়ের মতো ব্যবহার করে যেন সেই সূদূর শৈশবে ফিরে গেলেন। বাথরুমের দরজা খোলাই থাকে তার, একা বাসায় বাথরুম লকের দরকার হয় না, তাছাড়া বাথরুম লক করলে তার সাফোকেশন হয়ে মগজের অক্সিজেন কমে যায়, এর আগেও তিনি মগজে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে বাথরুমে পড়ে দুদুবার মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। সেই কারণে কাজের ছেলের ওপর দায়িত্ব আছে যাতে তিনি বাথরুম লক না করেন। শামসাদ আজাদ খুব সহজে বাথরুমের ভেজানো দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। দুরুমের ফ্লাট বাড়িতে তাকে দেখভালের জন্য বছর ষোল সতেরোর মজনু মিয়া তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মজনু মিয়া তখন সকালের সাহেবী ব্রেকফাস্ট পুরানো কাঠের ডাইনিং টেবিলে সাজানোতে ব্যস্ত থাকলেও মজনুর মন পড়েছিল মোবাইলের রিংটোনের শব্দের দিকে। এই সময় তার কয়েকটা মিসড কল আসবে, কয়েক বাসা পরের হাউজমেইড লাবণীর মোবাইল থেকে। শুধুমাত্র লাবণীর কারণেই সে এই আধবুড়োর বাসায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে।

মোবাইলের রিংটোনের শব্দের জন্য উৎকীর্ণ থাকায় মজনু মিয়া বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে স্যার যে বেরিয়ে এসেছেন এটা বুঝতে পারলেও প্রথমে পাত্তা দিল না। কিন্তু যখন ডাইনিং থেকে বাথরুমের দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে পেল না তখন একটু অবাক হলো। মানুষটা শব্দ করে বাথরুমের দরজা খুলল অথচ নেই হয়ে গেল কিভাবে? তখনই ডাইনিং টেবিলের পায়ের কাছে মানুষের গলা শুনে মজনু মিয়া এরকম চমকাল যে তার হাতে থাকা জুসের গ্লাস থেকে ছলকে একটুখানি জুস ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ল।
‘মজনু, সকালের নাস্তা যা বানিয়েছিস ওসব ডিম মামলেট টামলেট সব অফ। আমি এখন শাকপাতা খাব।’
মজনু এমনিতেই স্যারকে চার হাতপায়ে এক বছরের বাচ্চার ভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে দেখে এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে সে স্যারের কথা কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যার, শাকটাক কিছু কেনা নেই স্যার। বাজার করতে হবে।’
‘ওকে। ঠিক আছে। চারপেয়ে জন্তুরা যে শুধু ঘাসলতাপাতা খায় তা নয়, ওরা সব খায়। ঠিক আছে, তুই ডাইনিংয়ে যা খাবার দিয়েছিস তা আমার মুখের সামনে টেবিলের নিচে দে। এখানেই খাওয়ার কাজটা সেরে ফেলি। চারপাওয়ালারা ডাইনিং টেবিলে খায় না।’

শামসাদ আজাদ খাবারের লোভে মুখ থেকে কুকুরের মতো জিহবা বের করেই রাখলেন। মজনু কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। রান্নাঘরে মোবাইলের রিংটোন বেজেই চলেছে, কিন্তু মোবাইল ধরার মতো মনের অবস্থা এখন নেই। মজনু স্যারের দ্বিতীয়বার ধমক খেয়েই পাউরুটি, জেলি, ডিম মামলেট ও জুসের গ্লাস কাঁপা কাঁপা হাতে নিচে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার, বাজার থেকে শাকপাতা কিনে নিয়ে আসি?’
শামসাদ আজাদ পাউরুটির ওপর লাগানো জেলি বিড়ালের মতো করে জিহবা দিয়ে একমনে চাটতে চাটতে মজনুর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘যা, যা, শিগগিরই যা। টাটকা দেখে শাকসবজি নিয়ে আসবি। ফরমালিন দেওয়া ছ্যাতা পড়া না। চারপেয়েরা সব টাটকাই খায়, জানিস না?’

মজনু মিয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে এত দ্রুত ফ্লাটের বাইরে চলে এলো যে স্যারের কাছ থেকে বাজারের টাকাটা নিতেও ভুলে গেল। অন্য সময় এই বাজারের টাকা থেকেই তার দুপাইস ইনকাম হয়, তাতে হাতখরচ, মোবাইল খরচ উঠে আসে। এমনকি লাবণীর তিনটে মিসড কল দেখেও সে কলব্যাকের দিকে না গিয়ে সরাসরি খালাম্মার নাম্বারে ফোন দিল। খালাম্মাকে এরকম হুটহাট কল দেওয়ার কড়া নিষেধ আছে। স্যারকে ছেড়ে স্যারের বিপত্নীক বন্ধুর সাথে সংসার করায় যখন তখন কেউ খালাম্মাকে ফোন দিয়ে জ্বালায় না। বলা আছে, শুধুমাত্র ইর্মাজেন্সি বা অসুখ-বিসুখেই মজনু মিয়া ফোন করতে পারবে। মজনুর মনে হয় এরচেয়ে ইর্মাজেন্সি বোধ হয় হার্ট এ্যাটার্ক করলেও হয় না। খালাম্মা ওপাশে ফোন ধরতেই মজনু তোতলাতে তোতলাতে কোনমতে বলল, ‘খালাম্মা, স্যার কেমন জানি করতেসে!’

খালাম্মা আফরোজা তখন নতুন স্বামীর প্লেটে রাইস তুলে দিচ্ছিলেন, কিন্তু রাইসের চামচ প্লেটের ওপরে গিয়েই থেমে গেল। কানের কাছে ধরা মোবাইলে আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে? আবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছে?’
‘না খালাম্মা। কুকুর বেড়ালের মতো কেমন করে জানি চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবারও খাচ্ছে জিব দিয়ে চেটে চেটে, কুকুর বেড়ালে যেরকম করে খায়। আমি খুব ভয় পাইছি খালাম্মা। আপনি একটু এসে দেখে যান।’

খালাম্মার স্বামী জাফর, যে শামসাদের ভূতপূর্ব বন্ধুও, খাওয়ার প্লেটে হাত গুটিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্ত্রীর ফোনে কথা বলা শেষ হলে বললেন, ‘শামসের কী হয়েছে? হার্ট এ্যার্টাক? স্ট্রোক? এক্সিডেন্ট?’
‘কী বলল মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। বলল, ঘরজুড়ে নাকি হামাগুড়ি দিয়ে চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটাহাঁটি করছে।’
‘নতুন কোনো ব্যায়াম ট্যায়াম?’ জাফর প্লেটেই হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। ‘আমার মনে হয় আমাদের এখুনি গিয়ে ব্যাপারটা কী দেখা উচিত?’
‘তোমার না আজ একটা ক্লায়েন্ট মিটিং ছিল?’ আফরোজারও খাওয়ার রুচি নেই, ডাইনিংয়ে খাবার ঢাকা দিতে দিতে বললেন।
‘বাদ দাও, অন্যরা সামলে নেবে। আগে শামসের কী হলো দেখা দরকার। তুমি তার প্রাক্তন স্ত্রী হলেও তার আগে ও আমার বন্ধু। চলো এখনি বেরিয়ে পড়ি।’ জাফর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘তোমার ছেলেদেরও ব্যাপারটা জানানো দরকার। বাবার ব্যাপার।’
‘হুম।’ আফরোজা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন। ‘জানাব। তার আগে চলো আমরাই গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী? না হলে ওদের জানাবটা কী? নিজেই যখন জানি না।’

জাফর নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আফরোজাকে সাথে নিয়ে সারি সারি এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের শামসাদের এপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখলেন মজনু মিয়া দরজার বাইরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মজনুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘ভেতরে যেতে ভয় করছে খালাম্মা।’ মজনু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। আফরোজা দরজার দিকে এগিয়ে ধাক্কার দেওয়ার আগেই মজনু বলল, ‘সাবধানে ধাক্কা দেন। স্যার দরজার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে থাকতে পারে।’
আফরোজা আর দরজা ধাক্কা দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রাক্তন স্বামীর নাম ধরে ডাক দিলেন, ‘সামু, সামু?’ পাশ থেকে জাফরও গলা চড়ালেন, ‘শামস? শামস?’
ভেতর থেকে একবারে শান্ত গলা ভেসে এলো। ‘দরজা খোলাই আছে, ভেতরে আয়। মজনু মিয়া দরজা খুলে রেখে বাজার করতে গেছে। আমি আর দরজা লাগাতে পারছি না।’
দুজনে খুব সাবধানে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চোখ চোখের সমান্তরালে মানুষ খোঁজে। ওরাও সোজাসুজি তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখনই দরজার একপাশে হামাগুড়ি দেওয়া মানুষটাকে এবং তার কণ্ঠস্বরও শুনতে পেলেন। ‘চারপেয়ে হয়ে বেশ আছি। দুপায়ে দাঁড়াতেই এখন আমার বেশি কষ্ট হয়!’
জাফর একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, ‘তুই কি ওভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলবি নাকি?’
আফরোজার চোখ ততক্ষণে ডাইনিংয়ের নিচের খাবারের প্লেট এবং ছড়ানো ছিটানো খাবার ও উচ্ছিষ্টগুলোর দিকে চলে গেছে। তিনি ভয়ে ভয়ে পেছনে ঢোকা মজনুর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, ‘এখান থেকে এগুলো সব পরিষ্কার কর। আমি দেখি ভেতরের ঘরে কোনো ঝামেলা পাকানো আছে কিনা?’ প্রাক্তন স্বামীর সামনে থেকে সরে যাওয়াই আফরোজার মূল উদ্দেশ্য।

জাফরের পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসা শামসাদ আজাদ খুব স্বাভাবিকস্বরে বললেন, ‘তুই আরাম করে সোফায় বস। আমি দুপায়ে দাঁড়িয়ে বসছি।’ তিনি দুপায়ে দাড়িয়ে জাফরের মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘দুপায়ে দাঁড়ানোটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। আমরা মানুষেরা সবসময় সেই কাজটাই করে যাচ্ছি। একারণেই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ফলস্বরূপ এই মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হিংসা দ্বেষ। আজ সকালের পেপার দেখেছিস?’
‘হু। চোখ বুলিয়েছি। একটা মিটিং ছিল। মিস দিলাম।’
‘দেখিসনি একটা মেধাবী ছেলেকে কিভাবে তার হলের বন্ধুরা, বড়ভাইরা মিলে সারারাত ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। দুপেয়ে হয়েই এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে। চারপেয়ে হলে হতো না। চারপেয়েরা প্রয়োজন ছাড়া কাউকে হত্যা করে না।’

জাফর একটু বিরক্ত হলেন। বন্ধুর মাথা আগে থেকেই একটু অন্যরকম ছিল, এখন আরো বেড়েছে মনে হয়, সে কারণেই তো আফরোজা এই শেষ বয়সে এসেও আর ওর ঘর করতে পারল না, অথচ দোষটা গিয়ে পড়ে তার ওপরে। যত্তসব। এখন ক্লায়েন্ট মিটিং বাদ দিয়ে এই পাগলের সাথে বসে দুপেয়ে চারপেয়ে পার্থক্য শুনছে। যত্তসব!

‘চারপেয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধে কী জানিস? ব্যালেন্স! খুব চমৎকার ব্যালেন্স হয়। আমার মনে হয় এই ব্যালেন্স শুধু শারীরিক নয়, প্রাকৃতিকও। সবাই চারপেয়ে থাকলে প্রাকৃতিক ব্যালেন্স ঠিকঠাক থাকত। আমার তো মনে হয়, প্রকৃতির সব নিয়ম ঠিকঠাক মানলে আমরা সবাই আবার চারপেয়ে হয়ে যাব। আমাকে দিয়েই ধর না, আমি তো ধীরে ধীরে চারপায়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আর এটা অভ্যস্ততার কি আছে? আমরা জন্মেছিলাম চারপেয়ে, জোর করে দুপেয়ে হয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছি। এখন প্রকৃতিই ভারসাম্য রাখতে আবার আমাদেরকে চারপেয়ে করতে চাচ্ছে। আমি প্রকৃতির সেই তাল রক্ষার চেষ্টা করছি।’ বলেই শামসাদ আবার সোফা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচে। জাফরের পায়ের কাছে এসে মুখ তুলে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমরা সঙ্গমও করি চারপেয়ে তাই না? চতুষ্পদী জন্তুর মতো। হা হা হা!’

জাফরের অসহ্য লাগছিল। এখনো গাড়ি টেনে গেলে ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে এটেন্ড করা যাবে। তাহলে বসে বসে এই পাগলের প্রলাপ শুনতে হবে না। ওর প্রাক্তন স্ত্রী শুনতে চাইলে শুনুক। ইচ্ছে করলে ওরা চারপেয়ে হয়ে সঙ্গমও করতে পারে, আগে তো অসংখ্যবার করেছে। যা ইচ্ছে তাই করুক। জাফর খোলা দরজা দিয়ে কাউকে কিছু না বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

আফরোজা ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন শামস হামাগুড়ি দিয়ে ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। জাফর বেরিয়ে গেছে। একটু যেন স্বস্তি পেলেন তিনি। যত যাই হোক, বর্তমান স্বামীর সামনে প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো যায় না। আফরোজা নিজেও বসে প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিমায় প্রাক্তন স্বামীর মুখোমুখি হয়ে গায়ে মাথায় কপালে হাত দিয়ে নরোম স্বরে বললেন, ‘তোমার শরীর তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে, তাহলে এরকম করছো কেন?’
শামস স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আহবানের স্বরে বললেন, ‘চারপেয়ে হওয়ার পরে আমি খুব ভালো আছি। তুমিও আমার মতো চারপেয়ে হয়ে দেখ শরীরে অদ্ভুত একটা ব্যালেন্স চলে আসবে। মনে হবে শরীরে কোনো রোগব্যাধি নেই, ছিলও না।’
‘না বাবা, আমি তোমার মতো ওরকম করতে পারব না। পুরুষ মানুষ যা পারে নারীরা তা পারে না।’
‘পারে, পারে। চারপেয়ে হয়ে গেলেই পারে। তখন এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মান-অপমানবোধ, হিংসা-দ্বেষ, ঈর্ষা কোনো কিছুই আর মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই কেবল আমাদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এবং তখনই যত বিপত্তি ঘটতে থাকে। চারপেয়ে হয়ে গেলে তখন আর আমাদের মধ্যে এইসব মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না। এবং এই ঘটনাগুলোও ঘটবে না। বন্ধুরা তখন পিটিয়ে বন্ধুদের মেরে ফেলবে না। এই ধরো, এখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি, আমার মধ্যে কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। জাফর যে আমার কাছ থেকে তোমাকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে দুপেয়ে অবস্থায় থাকলে আমি ওকে কস্মিনকালেও আমার এই ঘরে ঢুকতে দিতাম না, কিন্তু চতুষ্পদী হয়ে ওর ওপরে আমার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। যেমন তোমার ওপরেও আমার কোনো মান অভিমান রাগ-ক্ষোভ-দ্বেষ কোনো কিছুই নেই। তোমাকে সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছি। চারপেয়ে হলেই সবাইকে সহজে ক্ষমা করে দেওয়া যায়।’

আফরোজা কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। ওকে ছেড়ে যাওয়াটাই কি এই মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ? নাকি এগুলো আগেই ভেতরে চাপা দেওয়া ছিল, তিনি ছেড়ে চলে গেছেন বলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে? ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। তার আগে সামর্থ্যবান, আলাদা আলাদা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকা দুই সংসারী ছেলেকেও ব্যাপারটা জানাতে হবে। হাজার হোক তাদের বাবা তো!

আফরোজা শামসের গায়ে মুখে একটু হাত বুলাতেই শামস চতুষ্পদী জন্তুর মতো গরগর শব্দ করে আদর খেতে লাগলেন। আফরোজা একটু বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন, ‘তুমি কি সারাদিন এভাবেই থাকবে? সোজা হবে না?’
‘দেখি কতক্ষণ থাকা যায়। এভাবেই থাকতে ভালো লাগছে। এখন দুপেয়ে হতে গেলেই কষ্ট হয়।’
‘ঠিক আছে, তুমি থাকো এভাবে। আমি মজনু মিয়াকে সব বলে যাচ্ছি। ও তোমার খাবারদাবার যেভাবে চাও গুছিয়ে দেবে। শুনলাম তুমি শাকপাতা খেতে চেয়েছো। ওকে কিনতে পাঠিয়েছিলাম। এখন রান্না করতে বলেছি। আর তুমি তোমার মতো থাকো। ওকে ভয় দেখিয়ো না। বেচারা ভয়ে একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শোনো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এই কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরব। এরমধ্যে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসো না যেন।’

এপার্টমেন্টের বাইরে বেরিয়ে আফরোজা একটু মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলেন। সামনে অনেকগুলো করণীয় কাজ। মানুষটা এভাবে উন্মত্ত হয়ে পড়লেও তাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া যায় না। প্রাক্তন স্বামী হলেও তার সন্তানের বাবা। তারচেয়ে বড় কথা, একজন সুস্থ মানুষকে খুব সহজেই ফেলে চলে যাওয়া যায়, একজন অসুস্থ মানুষকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। মানুষটা অসুস্থ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ। সেই সাথে বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতাগুলোও বেড়েছে কিনা একটু দেখা দরকার। ব্লাড প্রেশারের ওঠানামা, ডায়াবেটিসের বেড়ে যাওয়া, মস্কিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাইজনিত যে সমস্যাটা ওর মাঝেমধ্যে দেখা দিত সেগুলোর চেকআপের জন্য একটা ক্লিনিকে নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা তিনি একা পারবেন না। ছেলেরা এসে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি কোথাও নিয়ে যেতে পারে এবং মনে হয় কোনো একটা সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও এপয়েনমেন্ট করে রাখা দরকার। কিন্তু তার আগে দরকার ওর চারপেয়ে থেকে দুপেয়ে হওয়া। আফরোজার হঠাৎ মনে হয়, চারপেয়ে হওয়াটা খারাপ কিছু না। চতুষ্পদী জন্তু হলে এত এত অসুখ বিসুখ হয়তো দেখা দিত না!

বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আসিফ একটা সাইটে কনস্ট্রাকশনের কাজ তদারকি করছিল। জেনারেটরের একটানা জোরালো ঘটরঘটর ইঞ্জিনের শব্দে ওপাশ থেকে মায়ের কথাবার্তা তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে আসিফ যেটুকু বুঝল মা এখন বাবার বাসায় আছে। বাবার কিছু একটা হয়েছে। তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। শুধু এটুকু বুঝল, বাবা আর মানুষ নেই। চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে। মানুষের স্বভাবের সবচেয়ে বড় প্রবৃত্তি হলো দুবোর্ধ্যতা। সাইটে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আছে, কাজ চলছে ঠিকঠাকভাবে। সে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুরে এলে কিচ্ছু যাবে আসবে না, তবুও হয়তো সে মায়ের কাছ থেকে বাবার ব্লাড প্রেশার ট্রেশারের কথা শুনলে যেত না। মানুষের বয়স হয়ে গেলে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকবে, এ তো স্বাভাবিকই। এজন্য নিজেদের কাজকর্ম বন্ধ করে বাবা মায়ের কাছে কে বসে থাকে? তাছাড়া তার স্ত্রী সোমা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্যই করতে পারে না। আলাদা ভাড়া বাসা নিয়ে পৃথগন্ন হতে হয়েছে সোমার কারণেই। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে তো সোমা এখন খোঁটা দেওয়ার নতুন সাবজেক্ট পেয়েছে। ফেসবুকে কোনো অফিসিয়াল মহিলার সাথে চ্যাট করতে দেখলেও মুখ ঝামটি দিয়ে বলে ওঠে, ‘যেমন মা তার পেটে আর কেমন পয়দা হবে। খানকির ঘরে নাঙই জন্মায়!’ বাবা চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে শুনে আসিফের আগ্রহটা বেড়ে উঠল, ব্যাপারটা কী সরেজমিনে দেখাই যাক, সিরিয়াস কিছু না হলে মা যে পরিস্থিতিতে বাবাকে ছেড়ে গেছে তাতে এখনো বাবার ওখানে যাওয়ারই কথা না। আসিফ সোমাকে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জুনিয়রের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ছোটছেলে ব্যাংকার সাকিব ব্যাংকের জটিল গাণিতিক হিসাব নিকেশ মেলাচ্ছিল। এখন ব্যাংকে রাশ আওয়ার। দম ফেলাবারও ফুসরত নেই। মায়ের কল দেখেও প্রথমে দুবার সে রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে দিল। তিনবারের বার জরুরি কিছু ভেবেই রিসিভ করে গাণিতিক মাথায় মার দুর্বোধ্য কথা কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু এটুকু বুঝল, বাবার কিছু একটা হয়েছে। এখনি যেতে হবে। বড়ভাইয়াও আসছে। বড়ভাইয়াও আসছে শুনে সাকিবের মাথার মধ্যে গাণিতিক হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেল। তার মানে কি বাবার অন্তিম সময় উপস্থিত? তাই কি উইল টুইল করার জন্য এভাবে ডেকে পাঠাচ্ছে? না হলে যে বড় ভাইয়া কখনো বাবার সাথে দেখাও করতে যায় না, সে কেন আগ বাড়িয়ে যাবে? নিশ্চয়ই ধনসম্পত্তি লাভের কোনো ব্যাপার-স্যাপার আছে। এই সময় বাবার মুখের কাছে না থাকলে উইলে যদি ভাইয়াকে লায়ন শেয়ার দিয়ে বসে? বাবার তো কোনো মতিগতির ঠিক নেই!

ব্যাংকার সাকিব তাড়াতাড়ি আসিফ ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানাল, মা কল করেছিল, বাবার ব্যাপারে। অর্থাৎ সে ফোন দিয়ে ভাইয়াকে সাবধান করে দিতে চায় তুমি কিছু ধান্দাবাজি করার চেষ্টা করো না। আসিফও তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, আমাকেও কল করেছিল। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। তুই কই? ব্যাংকে আছিস। তাহলে তোকে লিফট দিয়ে নিয়ে যাই। আমি তোর ব্যাংকের সামনে দিয়েই যাব।’

সাকিব মনে মনে ভাইয়ার নতুন কেনা গাড়ির ফুটানি সহ্য করলেও গাড়িতে গেলে একসাথে যাওয়া যাবে এবং ভাইয়ার সাথে ব্যাপারটা কী তা নিয়ে কথা বলা যাবে ভেবেই রাজি হলো। আসিফ নিজেই ড্রাইভ করছিল। সাকিব ব্যাংকের সামনে থেকে আসিফের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী তুমি কি কিছু জানো ভাইয়া? আমি মায়ের কথা ঠিক বুঝতে পারিনি।’
‘আমিও না। বলল, বাবা নাকি কেমন করছে। চারপেয়েদের মতো চলাফেরার চেষ্টা করছে। বাবার কি মাথাটাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’ দুভাই কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারলেও এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে করতে কোন ডাক্তার দেখানো যায়, কার কোন পরিচিত ডাক্তার আছে সেইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতেই পথ এগুতে লাগল। এমনকি মায়ের এই বয়সে বিয়ে নিয়ে দুভাই রসিকতা করতেও ছাড়ল না। মা বাবা অনেক সুখী মানুষ। কারণ তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। একজন পুরুষ মানুষের সব চাইতে বড় দুভার্গ্য হচ্ছে সুখী বিবাহিত জীবন, বিবাহবিচ্ছেদের যখন আর কোনো আশা ভরসাই নেই।

বাবার এপার্টমেন্টের দরজার সামনে কোনো ভিড় নেই দেখে দুভাই একটু অবাক হলো। একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলে কিছু না হোক আশপাশের দুচারজন মানুষ তো জড়ো হয়ে পরামর্শ দেয়। ব্যাপার কী? কলিংবেল চাপতেই মজনু মিয়াই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল, যেন ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। মজনু নিচু গলায় বলল, ‘আপনারা ওই ঘরে যান। স্যার ম্যাডাম ওই ঘরেই আছেন।’ কিন্তু তারা বেডরুমের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই মা বেডরুম থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং দুভাই অবাক হয়ে দেখে তাদের একসময়ের দাপুটে চাকুরিজীবী, বর্তমান রিটায়ারমেন্টে থাকা বাবা মায়ের পিছু পিছু আদুরে বেড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চারহাতপায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখে দুভাই এতটাই হতভম্ব হয়ে যায় যে তাদের মুখে রা কাড়ে না। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে দুই ভাইকে বসতে সাহায্য করেন।

মায়ের আঁচলের পেছন থেকে মুখ বের করে দিয়ে শামসাদ আজাদ কিছুটা লজ্জিত মুখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জীবনে সব প্রাকটিস থাকা ভালো। আগে পরে তো মানুষকে চতুষ্পদীই হতে হবে। তাই আমি আগেভাগে হয়ে গেলাম। ঠিক করেছি না?’
পাগল না ঘাঁটানোর মতো ভয়ার্ত দুভাই একসাথে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো মাথা একদিকে কাত করে হীরক রাজার দেশের সভাসদদের মতো ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক’-এর সংকেত দেয়। তাই দেখে প্রফুল্ল মুখে শামসাদ আজাদ বলেন, ‘চারপেয়ে হয়ে গেছি দেখে তোর মা ভয় পেয়ে গেছে। আরেক ব্যাটা তো ভয়ে প্যান্টে প্রচ্ছাব করে দিয়ে তড়িঘড়ি আমার সামনে থেকে পালিয়ে গেছে। তা, তোমরা দুভাই আছো কেমন? সংসারে সব ঠিকঠাক চলছে তো?’
দুভাই আবারও হীরক রাজার সভাসদ। ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক।’
‘যখনই দেখবা সংসারে কোনো কিছুর ঠিকঠাক নাই, তখনই আমার মতো চতুষ্পদী হয়ে যাবা, দেখবা সবই ঠিক হয়ে যাবে। চতুষ্পদীর কোনো ঝামেলা নাই।’
দুভাই যেন বাবার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই বাঁচে। বাবাকে একাকী ছেড়ে দুভাই-ই বউয়ের কথায় আলাদা নিজেদের সংসার পেতেছে, সেই সংসারে বাবার আশ্রয় হয়নি, এক ধরনের অপরাধবোধের তাড়নায় তাদের দুজনেরই মনে হতে থাকে হয়তো এই কারণেই বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন।

মজনু মিয়াকে চা-নাস্তার কথা এবং দুপুরে দুভাই মা সবাই যাতে লাঞ্চ করে যায় সে কথা বলে বাবা হামাগুড়ি দিয়েই আবার বেডরুমে ঢুকে যেতেই ওরা দুভাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বলল, ‘মা, মজনু মিয়াকে আগে পানি খাওয়াতে বলো। যা ভয় পেয়েছে না!’ পানি পান করে দুভাই ধাতস্থ হয়ে পরবর্তী করণীয় কী করা যায় তাই ঠিক করতে বসল। দুভাই যখন মায়ের সাথে কথা বলে ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্টের ব্যাপারে আলোচনা করছে তখনই আসিফের মোবাইল সোমার কল এলো। সোমাকে নিয়ে মায়ের ব্যাপারে কিছু তিক্ত ঘটনা আগে ঘটে গিয়েছিল বলে আসিফ কল রিসিভ করেই দরজা খুলে এপার্টমেন্টের বাইরে এসে চুপি চুপি গোটা ঘটনাটা সোমাকে জানাল। ধুরন্ধর স্বভাবের বিজনেসম্যানের কন্যা সোমা ওপাশ থেকে বলল, ‘এটা তো তোমাদের জন্য শাপেবর হলো। এই তো সুযোগ!’ আসিফ সোমার কথার মমার্থ ধরতে পারল না, তার শুধু মাথায় ভাসছিল বাবার মতো একজন মানুষের ছোট বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে তাদের দিকে আসার দৃশ্য। সে চাপা স্বরেই বলল, ‘তুমি কী বলছো বুঝতে পারছি না।’ ওপাশ থেকে বউয়ের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘তুমি তো দুধের শিশু, কিছুই বোঝ না, দুদু খাও! শোন, বাবা চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটছে মানে বাবা পাগল হয়ে গেছে। এখন এই সুযোগে বাবাকে ধরে বেঁধে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও। প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়ে পাগলের ডাক্তারদের হাত করো। তারপর পাগল বাবার সব সম্পত্তির পাওয়ার অব এর্টনি হয়ে তোমরা দুভাই ভোগ দখল করো। তুমি তো মাথামোটা ঠিক বুঝবে না ব্যাপারটা। তোমার ব্যাংকার ভাইকে এই কথাগুলো বলো। সে হিসেব নিকেশের মানুষ। সহজেই বুঝে ফেলবে।’ আসিফ ইতস্তত করে বলল, ‘মাকেও কি বলব?’ ওপাশ থেকে খেকানো গলা, ‘সে মাগিও দরদ দেখাতে এখানে চলে এসেছে নাকি? ছেড়ে যাওয়ার সময় এত দরদ ছিল কই?’ আসিফ বুঝল সোমার সাথে আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। সে ‘মা ডাকছে,’ বলে সোমার কল কেটে দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে চাপা স্বরে সাকিবকে বাইরে ডেকে নিল। তারপর সোমার বলা কথাগুলোই আবার পুনরাবৃত্তি করল। কথাগুলো শুনতে শুনতেই সাকিবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই ব্যাপারটা তো তার মাথায়ই ঢোকেনি। ভাবী একটা জিনিয়াস! সে ফিসফিস করে বলল, ‘মাকে এসব ব্যাপারে কিছু জানানোর দরকার নেই। সব আমরা দুজনেই করব। তার আগে মাকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলেও বাবার উপরে টান যে আছে তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই টান থাকলে মা আমাদের কাজ হাসিল করতে দেবে না।’

দুভাই পরিকল্পনা গুছিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। মাকে পরামর্শ দেয়, ‘মা, আমরা ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট সব ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমাদের মনে হয় বাবার আর তোমার সম্পর্কের ব্যাপারটা তুমি সামনে থাকলে আপনাতেই চলে আসবে। তাতে তুমিও বিব্রতবোধ করবে, এদিকে বাবারও সুস্থ হতে সময় লাগবে। তারচেয়ে ভালো হয়, আমি গাড়ি চালিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি। তারপর বাবাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার, টেস্ট সব করিয়ে নেব। তোমাকে ফোনে সব খবরাখবর জানাব।’

ছেলেদের কথার উপর কথা চলে না বিবেচনা করেই মা বাবার সাথে বিদায় নেওয়ার জন্য বেডরুমে দেখা করতে গেলেন। বাবা বিছানার নিচে মেঝেতে দুপায়ের ওপর বসে দুহাতে থাবা মেলে ছিলেন। মাকে রুমের ভেতর আসতে দেখে বিব্রত স্বরে বললেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। একটানা বেশিক্ষণ চললে ফিরলে ক্লান্ত লাগে। তাও চতুষ্পদী হয়ে ক্লান্তি কম লাগছে। চুতষ্পদীর সুবিধে কি জানো? স্পিড।’
মা ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেরা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ওদের কথা শুনে ডাক্তার দেখাও। তোমার একটু থরো চেক-আপ দরকার। ওদের কথা শুনো। পাগলামী করো না। আর আমি মাঝে মধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব।’
স্ত্রীর মমতা দেখে বাবারও মন দ্রবীভূত হয়ে গেল। তিনি ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার যখন মন টন খারাপ হবে তখন রুমের মধ্যে চারপেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে দেখো। মন ভালো হয়ে যাবে। একবার চতুষ্পদী জন্তু হতে পারলে বাঁচোয়া। মনটন খারাপের তখন আর কোনো বালাই নেই।’
আফরোজার মনটা এতটাই খারাপ হলো তিনি আর প্রাক্তন স্বামীর সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। মজনু মিয়াকে সব দেখভালের কথা বলে পার্স থেকে একশ টাকা বের করে মজনু হাতে গুঁজে দিয়ে বড় ছেলের সাথে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন।

এই সময়ে সাকিব অনেকগুলো কাজ গুছিয়ে আনল। তার মধ্যে প্রধান কাজ একজন মানসিক রোগের ডাক্তারকে বাসায় এপয়নমেন্ট দিয়ে আনা এবং তার সাজেশন মতোই প্রথমে মানসিক হাসপাতালে এবং সেখান থেকে যাতে পাগলা গারদে পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য উপযুক্ত অর্থ ঢালার প্রতিশ্রুতিও দিল।

চতুষ্পদী জন্তুও খায়, ঘুমায়, রেচনক্রিয়া করে। শামসাদ আজাদও দুপুরে ডাইনিং টেবিলের নিচে বসে হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় খাবারের প্লেটের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে, জিহবা দিয়ে চেটেপুটে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করলেন। ছোটছেলে সাকিব যে পুরো খাওয়ার দৃশ্যটাই ডাইনিং টেবিলের আড়ালে দাঁড়িয়ে উপর থেকে মোবাইলে ভিডিও করে নিয়েছে তা চতুষ্পদী হয়ে মাথা নিচু হয়ে থাকায় শামসাদ আজাদের চোখে পড়েনি। এই ভিডিওটাই বাবার পাগল হয়ে যাওয়ার জন্য জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে কাজ দেবে। দৃশ্য মুখের কথার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

শামসাদ আজাদ নিজের মতো করে খেয়ে, ছেলেকে খেয়ে নিতে বললে সাকিব, ‘ভাইয়া এলে একসাথে খাব, তুমি ঘুমিয়ে যাও’ বলল। কারণ সে জানে বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবে, মানসিক ডাক্তারের পরামর্শে রোগী যাতে ভায়োলেন্ট না হয়ে যায় সেজন্য ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ঘুমের ওষুধ মজনু মিয়ার মাধ্যমে বাবার খাবারের সাথে মিশিয়ে দিয়ে রেখেছিল সাকিব।

ঘুম থেকে উঠে শামসাদ আজাদ খুবই অবাক হলেন, এমনকি তার চতুষ্পদী হয়ে যাওয়ার কথাও কিছুই মনে রইল না। তিনি অন্ধকারে ঘরে চোখ সয়ে আসা আলোয় দেখতে পেলেন তার গলায় একটা চামড়ার মোটা বেল্ট। সেই বেল্টের সাথে একটা শিকল জাতীয় কিছু আটকানো এবং সেই শিকলের শেষ মাথা একটা খাঁচার সাথে বাঁধা। তিনি শিকল ধরে টান দিতেই ঝনঝন শব্দে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আর সাথে সাথে গোটা কক্ষ উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। এবং সেই উজ্জ্বল আলোতে তিনি দেখতে পেলেন তিনি একটা সাদাটে রঙের দেয়াল ঘেরা কক্ষের মধ্যে আছেন, যে কক্ষে কোনো জানালা নেই, শুধু একটা বন্ধ দরজা এবং সেই কক্ষের মধ্যে একটা মজবুত লোহার খাঁচা, হিংস্র চতুষ্পদী জন্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের সময় সর্তকতার সাথে যে খাঁচা ব্যবহার করা হয়। তিনি দুহাতে গলার শিকল আকড়ে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ তুলতেই কক্ষের দরজা খুলে সাদা এপ্রন পরা দশাসই একজন হাতে একটা লোহার ডাণ্ডি উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকেই লোহার খাঁচার ওপর বারকয়েক আঘাত করে হিসহিস করে বলল, ‘কোনো শব্দ হবে না। চতুষ্পদী জন্তুরা অযথা শব্দ করে না।’

শামসাদ আজাদ ভয় পেয়ে চুপ করে গেলেন। হাতের ধরে রাখা শিকলটা ছেড়ে দিয়ে খাঁচার এককোণে ভয় পাওয়া চতুষ্পদী জন্তুর মতো হাতপা গুটিয়ে বসে রইলেন। শামসাদের ভয় পাওয়া দেখে বিকৃত স্বরে হেসে উঠল এপ্রনপরা লাঠিধারী। তারপর মুখে ক্রুর হাসি ধরে রেখে বিকৃত ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে আদেশ দিল, ‘বল, আমার সাথে বল, মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু।’
শামসাদ আজাদ কিছুই বললেন না। কারণ তিনি জানেন, চতুষ্পদী জন্তুরা কথা বলতে পারে না।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;