ভুল বানানের মচ্ছব!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায় ভুল বানানের মচ্ছব। বিশেষত সাইনবোর্ড, প্রচারপত্রে এম বানান দেখা যায় যে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে। কখনো আঞ্চলিক বা কথ্য ভাবে ব্যবহৃত শব্দটিকেই লিখিত রূপ দেওয়া হয়। যেখানে আঞ্চলিক উপভাষা প্রবল, যেমন সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সেখানে এমন শব্দ বিভ্রাট লক্ষ্যণীয়।

এই তো গেল ভুল জেনে ভুল প্রয়োগের সমস্যা। তার বাইরেও আছে প্রচলিত একাধিক বানানের মধ্যে বিভ্রান্তি। কোনটি রেখে কোনটি গ্রহণ করবে মানুষ, তা ভেবে কূল পান না। যেমন, ‘পাখি’ না হয়ে ‘পাখী’ হলে কি লাভ বা ক্ষতি? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। বাংলা ভাষার বানান নিয়ে এ রকম অনেক বিভ্রান্তি আগেও ছিল, এখন আরও বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

বানানের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ভাষার নিয়মের গ্রন্থ ব্যাকরণেও বানান নিয়ে কিছু নিয়ম আছে, তবে সেগুলো সর্বজন স্বীকৃত নয়। ফলে পণ্ডিতরাই নানা বানানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। একই শব্দ বিভিন্ন বানানে লিখলেও সঠিকই থাকে। যেমন, আরো বা আরও। এমন উদাহরণ অনেক।

সংস্কৃত থেকে আগত শব্দের বানান বিধি আর বিদেশি শব্দের বানান বিধিও এক নয়। এসব ক্ষেত্রে এখন অনেক সহজবোধ্যতা তৈরি করা হয়েছে। এখন আর সূয্য (সূয), সর্ব্ব (সর্ব), চক্রবর্ত্তী (চক্রবর্তী), বিদেশী (বিদেশি) দেখা যায় না। সরলীকরণ করা হয়েছে অনেক বানানে। বিদেশি বানানকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসা হয়েছে। ষ্টোর বা ষ্টেশন এখন স্টোর ও স্টেশন।

বিজ্ঞাপন

এতসব করার পরেও বানান বিধি অভিন্ন হয়েছে, এমন বলা যাবে না। বিভিন্ন পত্রিকার বানান রীতিও বিভিন্ন। এতে সাধারণ মানুষ পড়েন বিড়ম্বনায়। তিনি কোন বানানটিকে সঠিক বলে ধরে নেবেন? শিক্ষার্থীরাও অভিন্ন বানান শিখতে পারছে না।

এমন সমস্যার সঙ্গে রয়েছে অজ্ঞতা হেতু ভুল। দোকানের সাইনবোর্ডে, বাস, টেম্পু বা রিক্সায় এমন এমন বানান লেখা হয়, যা শুধু ভুলই নয়, হাস্যকরও বটে। এমনই বহু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কথ্য ও লিখিত ভাষ্যে, যা প্রমিত উচ্চারণ ও বানান বিধিকে তোয়াক্কা না করে আঞ্চলিক ধরনটিকেই সর্ব সাধারণ্যে প্রচলিত করেছে।

একথা অবশ্য সত্য যে, লিখতে গিয়ে জীবনে কখনও ভুল করেননি, এমন মানুষ সম্ভবত পৃথিবীতে বিরল। লিখতে গিয়ে হাত থেকে ভুল শব্দ বা বানান বের হয় নি, এমন মানুষও পাওয়া দুস্কর। ভুলের মধ্যে বানান ভুলই হলো সবচেয়ে মারাত্মক ও সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এতে অর্থের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেখার গুণ ও মানের পতন ঘটে।

ভাষা বিষয়ক পণ্ডিতরা শব্দের বানান ভুলের পেছনে দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। অনেক ভেবেই বিশেষজ্ঞরা ভুল-বানানের এই শ্রেণিকরণ করেছেন। তা হলো: এক) শব্দের সঠিক বানান না জানা বা ভুলে যাওয়া; দুই) লিখতে লিখতে কলম-বিচ্যুতি বা আজকাল টাইপের সময় আঙুলের-বিচ্যুতি।

শব্দের বানান জানা না থাকলে মানুষ সাধারণত উচ্চারণানুগ বানান লিখতে চেষ্টা করে। আর তখনই স, শ, ষ কিংবা ন, ণ ইত্যাদিতে ভুল করেন। বানান না জানলে কেবল উচ্চারণ দিয়ে ষাঁড় শব্দটি লেখা সম্ভব নয়। না জানার কারণে সেটি সাড় ও শাড় হয়ে যেতে পারে।

কিছু শব্দের বানান মনে রাখা বেশ সহজ। যেমন, ফুল, পাতা, লতা, আম, কলা। এখানে বানান ও উচ্চারণে পার্থক্য নেই। কারণ এই শব্দগুলোতে কোনও বর্ণেই সমোচ্চারিত প্রতিরূপ বাংলা বর্ণমালায় নেই। ণ-ত্ব এবং ষ-ত্ব বিধান মনে রাখলেও ন-ণ, র-ড়, স-ষ শব্দগুলোর ব্যবহার বানান বিশেষে কেমন হবে, সেটাও নির্ভুল করা যায়।

বানানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপদ হয় যেসব শব্দে একাধিক সমোচ্চারিত বর্ণের উভয়টিই রয়েছে, সেসবে। যেমন, মুমূর্ষ। এখানে কোথায় হ্রস্ব এবং কোথায় দীর্ঘ ঊ-কার লাগবে তা নিয়ে দোলাচল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার, নিরিবিলি-র মতো শব্দে সবই হ্রস্ব-ইকার, সুতরাং মনে রাখা সহজ। গবেষণায় দেখা গেছে, হ্রস্বস্বর যত সহজে মনে থাকে, দীর্ঘস্বর ততটা সহজ নয়। হরীতকী-র দু’টি দীর্ঘ-ঈ-কার দিতে ভুল করেন অনেকেই।

শব্দে একাধিক সমোচ্চারিত ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলেও সমস্যা হয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে উচ্চারণ বিকৃতির কারণে। যেমন, আমরা লিখে থাকি ‘মতি’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘মোতি’। আরো যেমন, শত (শতো), কত (কতো) ইত্যাদি।

বিশেষ করে ইংরেজির তুলনায় বাংলা বানানগুলো মনে রাখার অসুবিধা বেশি। তবে বানানের নিয়ম-কানুনগুলো স্মৃতিতে ধরে রাখলে বানান ভুলের শঙ্কা কম। পাশাপাশি প্রচুর পড়াশোনা ও লেখালেখি করলে প্রতিনিয়ত স্মৃতিতে অসংখ্য শব্দ গেঁথে যায়। ফলে বানান ভুল কম হয়। লেখার সময় অমনোযোগিতা এড়ানো সম্ভব হলে কলমচ্যুতির মাধ্যমে বানান ভুল হওয়ার বিপদ কমে যায়।

বানান ভুলের হার কমাতে বানানের আর্দশ তালিকা সামনে থাকা ভালো। বিভিন্ন যোগ্য প্রতিষ্ঠান এমন তালিকা প্রকাশ করে, তা সামনে রাখা যায়। লেখার সময় এবং অবসর সময়ে সেসব চর্চা করলে বানান আত্মস্থ হয়ে থাকে। তাছাড়াও শুদ্ধ বানান শিক্ষার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পড়া ও লেখার চর্চা। মনোযোগ এবং অবিরাম চেষ্টায় কাজগুলো করা হলে বানান দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ভাষাচর্চায় কৃতিত্ব অর্জন করাও মোটেই কঠিন নয়।