ভালোবাসার হাজার প্রদীপ জ্বেলে
স্মৃতির জাগরণ আর প্রতিশ্রুতির পুনরুচ্চারণে আজ ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’: যুথবদ্ধ-তারুণ্য-যৌবনের লেলিহান উৎসব আজ। আজ দিন ভালোবাসিবার। নয়নের আর্শিতে ভালোবাসার হাজার প্রদীপ জ্বেলে পথ পরিক্রমণের দিন আজ।
বসন্তের উদ্দাম বাতাসে রঙিন ফুল ও প্রজাপতির মেলায় ভালোবাসার উৎসব ছাড়া হৃদয় বাঁচে না। মানুষ নান্দনিক তৃষ্ণায় ফিরে যায়, ফিরে আসে, স্থিত হয় ভালোবাসারই কাছে। ভালোবাসা জীবনের অন্য নাম হয়ে সেতুবন্ধের মতো এসে দাঁড়ায় মানব-মানবীর চিরায়ত অস্তিত্বে।
ভালোবাসা ও উৎসবময়তা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। মানবসমাজ জীবন্ত থাকে না। আর বাঙালি? বাঙালি তো বাঁচেই না। হয়তো বারো মাসে তেরো পার্বণের ইমেজটি বর্তমানের দ্রুতলয় জীবনে আর নেই। হয়তো অতীতের আনন্দমুখর উৎসবের বিস্তৃত আয়োজন এখন উপকথা বা অতিশয়োক্তিতে পরিণত হয়েছে। তথাপি উৎসব রয়ে গেছে। রয়েছে ভালোবাসার চির আকুতি ও শাশ্বত দ্যোতনা।
অতি-অগ্রসর, অতি-যান্ত্রিক, ধনতন্ত্রের কিছু কিছু ক্ষয়িষ্ণু মানুষ ও সমাজের দেশ ছাড়া বিশ্বের সব দেশের মতোই বাংলাদেশেও ভালোবাসা আছে, উৎসব আছে। ‘ভালোবাসা দিবস’ প্রবলভাবে উৎসবমুখর হয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাংলাদেশে। ঢাকাসহ সমগ্র দেশ অবারিত আনন্দে ও শিহরণে আজ সাজবে ভালোবাসার বহুবর্ণা সাজে।
তত্ত্বের ভাষায়: বৃষ্টি, জল, চাষাবাসের সঙ্গে শ্রমের সংযোগ যেখানে গভীর আর প্রত্যক্ষ, সেখানেই উৎসব। সেখানেই মানুষ মুখর, সেখানেই মানুষ মিশতে চায়, একের সঙ্গে অপরকে মেলাতে চায়। যদিও আমাদের প্রধান উৎসব ধর্মীয়, তবুও মানুষের সম্প্রদায়মুক্ত মনুষ্যতের টানে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ আবহ যে উৎসবে প্রধান হয়ে ওঠে, তার নাম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’ বা ব্যাপকার্থে ‘ভালোবাসা উৎসব’।
‘ভালোবাসা দিবস’ বা ‘ভালোবাসা উৎসব’ আমাদের দৈনন্দিন গ্লানি-যাতনা-অপ্রাপ্তিকে যেমন ভুলিয়ে দেয়, তেমনি দিনযাপনের পাতায় পাতায় সঞ্চারিত করে অন্য এক সুর-ব্যঞ্জনা। আমাদের সাদামাটা দিনগুলোর রঙ বদলায়। ভালোবাসাকে ঘিরে অন্তরে-বাহিরে জেগে ওঠে এক মহাসমুদ্র। স্মৃতির জাগরণে যার উত্থান, প্রতিশ্রুতির পুনরুচ্চারণে যার পুনরাবৃত্তি।
মহাচীনের প্রাচীন দার্শনিক চুয়াংৎসে-এর কথাই ধরা যাক, যার দর্শন-কথাবার্তা-ভাবনা-চিন্তার ধরনই ছিল আলাদা। ভালোবাসা তাঁর কাছে ছিল আত্মমগ্ন-নীরব প্রার্থনার প্রতীক। স্ত্রী-র মৃত্যুর পর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বন্ধুকে বলেছিলেন, “আঃ, বোকার মতো শোক জানাতে এসেছো কেন? আমি যাকে হারালাম সে তো দিব্যি আমার অন্দর-মহলের ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।”
এমনই আত্মমগ্নতার ধ্বনি শোনা গেছে বাংলা ভাষার কবিদের কণ্ঠেও। প্রেম ও নৈঃশব্দের অতলস্পর্শী গভীরতায় ভালোবাসাকে মূর্ত করেছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কবিগণ; করতলে লুকনো মুদ্রার এক পিঠে ভালোবাসা আর অন্য পিঠে বিষাদ নিয়ে খেলা করেছেন চেতনার বর্ণিল আবাহনে।
আসলেই তো, জীবনকে ঠিকভাবে বুঝে নিতে হলে তাকে বারেবারে বিপরীত প্রেক্ষিত থেকে দেখে নেওয়া দরকার। মৃত্যুর মাধ্যমেই তো জীবনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। অন্ধকারকে দিয়েই তো আলোর মূল্য ঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। বিষাদেই সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়, প্রেম কিংবা ভালোবাসা।
ভালোবাসা হলো আনন্দ ও বেদনায় যাপিত মানবজীবনের এক অলৌকিক মহাকাব্য, যা রক্ষিত রয়েছে প্রতিটি নর ও নারীর হৃদয়ের অন্তর্গত মর্মমূলে।