বহু ভাষার জগৎ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

এ জগৎ বহু ভাষার মানুষে পূর্ণ। এ জগৎ বহু বর্ণের মানুষে ভরা। এ জগৎ বৈচিত্র্যে এক অপার ভাণ্ডার।

ভাষা, মানুষ, প্রকৃতি, নদ-নদী, ভূমিরূপ, সব কিছু মিলিয়েই এ জগৎ-সংসার বড় বিচিত্র এক জায়গা, এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে সাধিত হয়েছে ঐক্য, সমন্বয় ও সহাবস্থানের সূত্র।

বিজ্ঞাপন

বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি জগতের বিচিত্র সমাবেশের এক উজ্জ্বল ও গর্বিত সদস্য। ফলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি, বিশ্বের অপরাপর ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের জানতে-বুঝতে হয়। সহনাগরিক ও জগতের আমাদের মতো আরো যারা আছে, তাদের সম্পর্কে না জেনে বসবাস করা যায় না। মেলামেশা ও আদান-প্রদানের মাধমেই জগতে বসবাসকারী সকল সদস্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।

অতএব বহুজন যেমনভাবে বাংলা শিখতে আসে, আমরা তেমনিভাবে বিদেশি ভাষা শিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের দিক থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রচলিত ধরণটি কেমন, সেটা লক্ষ্য করে দেখার মতো বিষয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবিকার ভাষা, বিজ্ঞান ও বিশ্বায়নের ভাষা, কিংবা ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’র ভাষা বলে পরিচিত ইংরেজি, এমন কি, ফরাসি, স্পেনীশ, আরবি, কোরিয়ান ভাষাকে চিহ্নিত করা হয় এবং এসব শিখতে আমাদেরকে কেউ মানা করছে না। সমস্যাটি তখনই হয়, যখন অন্য ভাষা শেখার নাম করে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা হয়। অন্য ভাষাকে অতি গুরুত্ব দিয়ে বাংলা ভাষাকে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বহীন করা হলেই বিপদ।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বায়নের চলমান সময়ে মানুষ যে কেবল ইংরেজি শিখছে, তা নয়। যেখানে চাকরি আছে, সেখানকার ভাষাই শিক্ষা করার একটা প্রবল বেগ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কেউ যদি একটু নজর দিয়ে ফুটপাতের বইয়ের দোকানগুলোর দিকে তাকান, তাহলে বাংলা ভাষীদের জন্য অন্তত দশটি ভাষা শেখানোর মতো চটি বই বিক্রি হতে দেখতে পাবেন।

রাজধানী ঢাকার নীলক্ষেত, পল্টন ও বায়তুল মোকাররমের অস্থায়ী বইয়ের দোকানে খেয়াল করে দেখেছি, সেখানে সহজে ইংরেজি শেখানোর হরেক রকম বইয়ের পাশে আরবি, জাপানি, কোরিয়ান, হিন্দি, মালয়েশিয়ান, চাইনিজ, ফরাসি, স্পেনিশ ইত্যাদি ভাষা শেখানোর কায়দা-কানুনওয়ালা বই রয়েছে। হাতে নিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যায় যে, ব্যাকরণ-সিদ্ধ কাঠামোয় বইগুলো রচিত হয় নি। নিরেট কাজ চালানোর মতো কিছু শব্দ ও বাক্য দিয়ে বইগুলোর পাতা পূর্ণ করা হয়েছে।

দোকানির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘মূলত কারা এইসব বইয়ের ক্রেতা?’ উত্তরে তার কাছ থেকে জানা যায়, ‘যারা বিদেশে কাজ করতে যেতে আগ্রহী, তারাই এসব বই কেনেনে।’ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে, অদক্ষ জনশক্তি হিসাবে যারা বিদেশে চাকরির জন্য যাচ্ছে, তারাই সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা সম্পর্কে জানতে বইগুলোর সাহায্য নিচ্ছেন।

এইসব বিদেশি ভাষা শিক্ষার চটি বই চরমভাবে অসম্পাদিত। বাংলার সাথে তুলনা করে অন্য ভাষা শেখানোর বিজ্ঞানভিত্তিক কোনও প্রচেষ্টাও বইগুলোতে নেই। যা আছে, তা হলো, কিছু শব্দ ও বাক্যের অনুবাদ। এতে ‘ইয়েস, নো, ভেরিগুড’ ধরনের শিক্ষা ছাড়া বিশেষ কিছু হবে না।

আমরা সবাই জানি যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা ভাষার দুর্বলতার মতো বিদেশি ভাষায় দুর্বলতাও বর্তমানে প্রকট। জানতে পেরেছি, কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য কিংবা আরবি সাহিত্য পড়ানো হয় বাংলা ভাষায়। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের চোখে দেখেছি, বিরাট বড় মাদ্রাসার ডিগ্রিধারী লোকজন এক লাইনও আরবি বুঝতে বা বলতে পারছে না। আগে মাদ্রাসাগুলোতে আরবি ছাড়াও ফারসি বা উর্দু ভাষা জ্ঞানসম্পন্ন অনেকেই ছিলেন। এখন খোঁজ নিলে বিশেষ কাউকে পাওয়ার উপায় নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে জ্ঞানের আহরণ ও সঞ্চালনের জন্য অপরাপর বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশ্বায়নের কারণে যোগাযোগ, চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা শিখতে হয়। এজন্য প্রায়-সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভাষা ইনসটিটিউট রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেখানে ছাত্র সংখ্যা মুষ্টিমেয়।

ইউরোপের একটি স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো নিজের প্রথম ভাষার পাশাপাশি সেকেন্ড ও থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে লোকজন। কাজের জন্য ভাষাকে তারা একটি মাধ্যম করে নিয়েছেন। আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছি না। চাকরি বা অন্যবিধ প্রয়োজন হলে চটি বই কিনে ভাষা রপ্ত করছি।

অথচ ভাষা ইনটিটিউট ছাড়াও বিভিন্ন দূতাবাসের সাংস্কৃতিক শাখা তাদের দেশের ভাষা শেখাচ্ছে। একটু আগ্রহ থাকলেই ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি, জার্মান, রুশ, ফারসি, স্পেনিশ, জাপানিজ ভাষা শিখে ফেলা সম্ভব। এতে উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হওয়া ছাড়াও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক স্তরে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির রাস্তাটাও প্রশস্ত হয়। বিভিন্ন দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক জ্ঞানের স্বাদ নেওয়াও হয়ে যায় উপরি পাওনা হিসাবে।

অভিভাবকরা একটু মনোযোগী ও উদ্যোগী হলেই সন্তানের শিক্ষা পরিকল্পনায় বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। যে টাকা-পয়সা জীবনের বিভিন্ন উপাচারের পেছনে ব্যয় হয়, সেখান থেকে কিছুটা খরচ করলেই ভাষা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজ নিজ সন্তানদের অনেক দূর এগিয়ে দেওয়া সম্ভব।

বর্তমান বিশ্বে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বাড়ি বা গাড়ি বা সহায়-সম্পতি নয়, সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হলো শিক্ষায় বিনিয়োগ। এ সত্যটি সম্ভবত আমরা এখনও উপলব্ধি করতে পারছি না। করলেও আমাদের সন্তানদের ভাষা-জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে নীতিটি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছি, যা কাম্য নয়।

বহু ভাষার এ বিচিত্র জগতে বাংলা যেমন শিখতে ও প্রসারিত করতে হবে, অপরাপর ভাষা সম্পর্কেও তেমনি আগ্রহ বাড়াতে হবে। কারণ এ বিশ্বে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা থাকা সম্ভব নয়। পারম্পরিক মেলামেশা ও যোগাযোগ সাধন করে উপকৃত হওয়ার সময়কাল চলছে এখন। একালের সুযোগকে কাজে লাগাতে ভাষা একটি প্রধান হাতিয়ার। নিজের ভাষা এবং অন্য ভাষা শেখার মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব। বিদেশিদের বেশি বেশি বাংলা ভাষা শেখালে যেমন লাভ, বাংলাভাষীরা অধিক হারে বিদেশি ভাষা শিক্ষা করলেও তেমনই লাভ।