বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট আমি ছাড়বো না: ঊর্মি রহমান

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঊর্মি রহমান, ছবি: সংগৃহীত

ঊর্মি রহমান, ছবি: সংগৃহীত

লাল-সবুজে চিত্রিত পতাকার পবিত্র ভূমি বাংলাদেশ তার প্রিয় জন্মভূমি। কর্মসূত্রে, পেশা ও পারিবারিক প্রয়োজনে দীর্ঘ বছর বসবাস করেছেন বিশ্বের নানা দেশে। তবু অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেন নি তিনি। একবারের জন্যও বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার কথা ভাবেন নি পর্যন্ত।

তিনি ঊর্মি রহমান। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রণী একজন। এখন থাকেন কলকাতায়। প্রতি ছয় মাস অন্তর বাংলাদেশে আসেন। বললেন, 'বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট আমি ছাড়বো না।'

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের স্মৃতিবাহী মার্চে বার্তা২৪.কমকে ঊর্মি রহমান বললেন এই স্বাদেশিকতায় দীপ্ত প্রতীতির কথা। শোনালেন বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র, যার কেন্দ্রস্থলে সবসময় অবস্থান করছে বাংলাদেশ নামক প্রিয় জন্মভূমির প্রত্যয়।

শৈশবের পার্বত্য চট্টগ্রাম 

বিজ্ঞাপন

শৈশবের কিছুটা সময় আমার কেটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। রাঙামাটি, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনায়। আমার বাবা চন্দ্রঘোনা পেপার মিল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখনো কাপ্তাই লেক হয় নি। লোকালয় থেকে তিন দিন নৌকায় চেপে আমাদের পৌছাতে হতো গহীন অরণ্যময় পিতার কর্মস্থলে। সাত দিনে একবার গ্রাম্য হাট বসতো। পাহাড়িরা নানা জিনিষ নিয়ে আসতেন। ঐ দিনেই পুরো সপ্তাহের বাজার কিনে রাখতে হতো। রাস্তাঘাট হয় নি সে সময়। নদীপথই একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। রাঙামাটির কাপ্তাই অঞ্চলে তখনো কিছু ইংরেজ শিক্ষক, মিশনারি ছিলেন।

চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন

ছবির মতো সুন্দর ছিলো ৫০/৬০ দশকের চট্টগ্রাম শহর। আব্বার অফিস ছিলো কাটাপাহাড়-নন্দনকাননে। আমরা থাকতাম পাশের জে.এম. সেন লেনে। পার্বত্য-অরণ্যময়ী শহর ঘুরে বেড়াতাম। নাগরিক সমাজে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ছিলেন। তাদের বিচিত্র পোষাক ও ইংরেজি কথাবার্তা আকর্ষণীয় ছিল। ছোট্ট ও ছিমছাম চট্টগ্রাম শহরের স্মৃতি আজো আমার কাছে অমলিন। আমার আব্বার মৃত্যুও হয়েছে এ শহরে। পরে চট্টগ্রামের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কেও জড়িয়েছি। চট্টগ্রাম আমার প্রিয় শহরগুলোর একটি।

চট্টগ্রাম ভার্সিটি ও ইউনূস ভাই

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভর্তি হই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। আমরাই মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। আমি বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে হলে উঠি। শহর থেকে বাসে বড় রাস্তায় নেমে রিকসায় ক্যাম্পাসে যেতে হতো। চবি ক্যাম্পসের সঙ্গে শহরের ট্রেন যোগাযোগ ছিল না ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে। ইউনূস ভাই (ড. মুহম্মদ ইউনূস) তখন গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল নিয়ে কাজ করছিলেন ক্যাম্পাসের পাশে জোবরা গ্রামে। আমি তার প্রজেক্টে জড়িয়ে পড়ি। মহিলাদের সাক্ষাতকার নিতে ক্যাম্পাসের পাশের গ্রামগুলোর প্রায়-প্রতিটি ঘরে গিয়েছি সে সময়।

সাংবাদিকতায় আমরা ক'জন 

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সংবাদ পত্রিকায় যোগ দিই। তখন পুরো বাংলাদেশে আমরা ৫/৬ জন নারী সাংবাদিকতায় ছিলাম। আমি ছাড়াও ছিলেন বেবী মওদুদ, নিনি, জলি প্রমুখ। কলকাতায় তখনো কোনো নারী সাংবাদিকতায় আসেন নি। 'সংবাদ'-এ আমরা কাজ করেছি রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, মন্টু ভাইয়ের সঙ্গে। দারুণ ছিল সেসব দিনগুলো।

পিআইবি'র দিনগুলো 

যোগ দিয়েছিলাম প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এ। প্রতিষ্ঠানটি সবে গড়ে উঠছে। ডিজি ছিলেন ড. আনিসুজ্জামানের শ্বশুর আবদুল ওয়াহাব সাহেব। পরিচালক ছিলেন তোয়াব ভাই। তোয়াব ভাইকে পরে দৈনিক বাংলায়ও পেয়েছি। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মহীরুহ তিনি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/03/1551618158530.jpg

বিচিত্রা-দৈনিক বাংলায় 

বিচিত্রায় কাজ করে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেছি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা-দৈনিক বাংলায় তোয়াব ভাই ছাড়াও এখানে পেয়েছি তৎকালের বাংলাদেশের সেরা ও মেধাবী লেখক-সাংবাদিকদের। এদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে পারিবারিক পর্যায়েও সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আহমেদ হুমায়ূনের ছেলে ইরাজ আহমেদ সে সূত্রে এখনো যোগাযোগ রাখে। ফজল শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী আজমেরী আমার সহপাঠী ছিল। বিচিত্রার শাহাদত ভাই ছিলেন। সবার কথা বলেও শেষ করা যাবে না।

বিবিসি'তে 

দশ বছরের বেশি ছিলাম বিলাতে। বিবিসিতে কাজ করেছি। বাংলাদেশি কমিউনিটিকে কাছ থেকে দেখেছি। তখন ইচ্ছা করলেই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেওয়া যেতো। আইন-কানুন এতো কঠিন ছিল না। সবাই অবাক হয় এটা শুনে যে, দশ বছর বিলাতে থেকেও আমি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিই নি।

কলকাতায় থাকি বাংলাদেশি পাসপোর্টে 

এখন আমি কলকাতায় থাকি। দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সাউথ সিটি মল অ্যাপার্টমেন্টে। পারিবারিক কারণে আমাকে কলকাতা থাকতে হয় বলে আমার পক্ষে ভারতীয় নাগরিকত্ব নেওয়া সম্ভব। বহুবার আমাকে বলাও হয়েছে। কিন্তু আমি তো আমার বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট ছাড়বো না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম আমি 

বাংলাদেশের ফরিদপুরের মানুষ আমি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনায় বড় হয়েছি। বাংলাদেশের পুরোটা আমার মুখস্ত। ইউরোপের ব্রিটেনে, দক্ষিণ এশিয়ার ভারতে কাজ ও বসবাস করেছি। এখন থাকছি কলকাতায়। ছয় মাস পর পর বাংলাদেশে এসে ভিসা নিয়ে আবার যাই। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে এদেশের নিসর্গ, প্রকৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম আমি। পৃথিবীর যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, বাংলাদেশই আমার আসল ঠিকানা।

নোট: বিলেতে ঊর্মি রহমান ১০ বছরের বেশি ছিলেন। সময়ের হিসাবে তা প্রায় ৩০ বছর। তাকে ছ’মাস পর পর ভিসা নিতে হয় না, কিন্তু ভারতের বাইরে যেতে হয়। পাঁচ বছরের ভিসার শর্ত সেটি।