করপোরেট 'নারী দিবস'এ আমার মা কই!
সকালেই ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা হলো। ভাত চুলায় বসিয়ে বাবার সঙ্গে এক প্রস্তর ঝগড়া শেষে ফোন দিলেন। অনেকক্ষণ ধরে ক্ষোভ ঝাড়লেন। এটা খুবই চমৎকার রসায়ন যে, এই বাঙালি সমাজে অধিকাংশ সন্তানরাই মায়েদের মুখে শুনতে পেরেছেন, 'জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, তোর বাবার সঙ্গে ঘর বাঁধা।' তবে এক অমোঘ ভালবাসায় মায়েরা সংসারগুলোকে টিকিয়ে রেখেছেন কয়েক দশক ধরে। অন্তত গেলো শতাব্দীতে যারা বেড়ে উঠেছেন, তাদের কাছে এই চিত্র মোটামুটি একই রকম।
মায়ের ক্ষোভ শেষ হলে, যখন জানতে চাইলাম, আজকেতো নারী দিবস। জানেন নাকি? হয়তো প্রশ্ন না শুনেই বাবাকে নিয়ে আরও কিছু অভিযোগ প্রকাশিত হলো। বোঝা গেলো বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নয়। আর এই দিবস তার জন্য ভিন্ন কিছুও নয়। বরং জীবন সংগ্রামেই তিনি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গিয়েছেন, লড়াই করে যাচ্ছেন। সেখানে কোন কোম্পানি এসে উনাকে অধিকারের কথা বলে যাননি৷
অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবস উদযাপন যতটা নারীরা নিজ থেকে সামনে এগিয়ে আনতে পেরেছে তার চেয়ে একটি 'ত্বক ফর্সাকারী স্নো' কোম্পানির ব্যাপক প্রচারণাতেই গত দশকের গোঁড়ার দিকে হৈ-হুল্লোড় তৈরি হয়। যেখানে অধিকারের সচেতনতার চাইতে উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে উদযাপনে বারবার ত্বক নিয়ে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলো সামনে এগিয়ে আসে৷
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তার প্রচারে আর উদযাপনে বারবারই এগিয়ে আনে সকল উৎসবকে। যেখানে অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে প্রচারণার হৈ-হুল্লোড় লক্ষণীয় থাকে। যেখানে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আর প্রচারিত ছবিতে গ্লামারের বিষয়টি থাকে ব্যাপকভাবে।
আজ ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। তবে আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে দেশের প্রায় সকল অফিসে বৃহস্পতিবার ৭ মার্চেই পালিত হয়েছে দিবসটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই দুনিয়ায় ছবি আপলোডে রঙিন হয়েছে দিনটি। তবে ৭ মার্চ কেনো পালিত করা হচ্ছে!
বাঙালির জীবনে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক৷ ৪৮ বছর আগে রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম...।' ৭ মার্চে নারী, পুরুষ, সকল বাঙালির অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে আর কি অনুপ্রেরণা লাগে! যারা ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর থেকে অনুধাবন করে শুনবেন, গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠবে৷ সকল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেড়িয়ে আসার জন্য মনকে অনুপ্রাণিত করবে ভাষণ। সেই ৭ মার্চে কেনো অনুপ্রেরণার জন্য উদযাপন করতে হবে 'নারী দিবস'!
অফিস ছুটি থাকবে বলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপ করার জন্যই কি একদিন আগেই পালন করতে হলো দিনটি! হয়তো করপোরেট চাহিদাই তা। অথচ নারীকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে হবে ঘরে, পথে ঘাটে, সমাজের সবখানেই। কারণ আমার মা'য়েরা সেখানেই সংগ্রাম করে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ ধরে। বাসে উঠতে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারীরা। এখনো চা দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় পুরুষের লালসা চোখের দৃষ্টির দরজা বন্ধ হয়নি৷ ঘরের কাজের মূল্য পায়নি আমাদের মায়েরা।
এখনো দেশের প্রান্তিক নারীদের কাছে পৌঁছায়নি নারী দিবসের প্রতিপাদ্য। করপোরেট আর এনজিও সেক্টর ছবি তোলা ছাড়া কিছু করেছে, এমন উদাহরণ খোঁজা কষ্টের হবে। কারণ দিবসটি পালনের জন্য প্রান্তিক পর্যায়ের নারীকে এখনো টার্গেট গ্রুপ হিসেবে মূল্যায়নে আনেনি করপোরেট বা এনজিও'রা।
১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় নারীদের ভোটাধিকার পাওয়ার মাধ্যমে ৮ মার্চ নারী দিবসের যাত্রা। তাই দিবসটির সত্যিকারের মূল্যায়ন ধরে রাখতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকেই মূল্যায়িত করতে হবে৷ যা ঘর থেকে শুরু করে কর্মস্থল আর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর যখন দিবসটির প্রতিপাদ্য পৌঁছে যাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, আমার মাও প্রতিবাদ করতে পারবেন, সমাজের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তখনই ৮ মার্চের নারী দিবস আমাদের জন্য হয়ে উঠবে সার্থক দিবস।