৯০-তেও রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছেন রজক
দৃষ্টিশক্তি এখনও তীক্ষ্ণ, শ্রবণশক্তিও ভালো তার। ফকির রজক ছুটে চলেছেন সকাল দুপুর দুই পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে। মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই, কেবলই সরলতার হাসি; যেন এই ৯০ বছরের জীবনটা অনায়াসেই কেটে গেছে তার। শুধু কাছের মানুষগুলোই জানেন, সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে দুঃখ-কষ্টের কত শত কাহিনী।
যার শুরু হয়েছিল এই পৃথিবীর আলো দেখার সাথে সাথেই। জন্মের পর মাত্র ১২ দিনের মাথায় মাকে হারান রজক। স্ত্রীকে হারানোর শোকে তার বাবাও ছয় মাস পর চলে যান না ফেরার দেশে। মা-বাবার কোনো স্মৃতি নেই রজকের। বাবা-মায়ের স্নেহ মমতার স্পর্শ কী তা তিনি জানেনও না।
নানা-নানি বুকে তুলে নেন রজককে। কিন্তু বুদ্ধি হওয়ার আগে নানা-নানিও মারা যান। এসবই প্রতিবেশীদের কাছে শোনা। এরপর সেই শিশু বয়স থেকেই কয়লা বহন করেন, ধোপার কাজ করে নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করতেন রজক।
২০ বছর বয়সে রজকের একাকিত্বের জীবনে আসেন তার স্ত্রী আরতি। তাকে বরণ করারও কেউ ছিল না। সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। একে একে ঘর আলো করে তাদের সংসারে আগমন ঘটল নতুন সদস্য। আট সন্তানের মধ্যে সাতটি মেয়ে, একটি ছেলে। বড় মেয়ে লক্ষী, তারপর বাসন্তি, শান্তি, মুক্তি, পঞ্চমী এরপর সরস্বতী ও ছোট মেয়ে জবা। ছেলের নাম রাখেন দিলিপ রজক।
আটটি সন্তানের মুখের খাবার জোগাড় করতে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে রজকের। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘুরিয়ে চলেছেন রিকশার চাকা। শুধু দুচোখে জ্বলজ্বল করছে তার আটটি ফুলের হাসি। মেয়েদের বেশিদূর পড়াতে পারেননি। কিন্তু একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রজক দিন-রাত এক করে রিকশা চালিয়েছেন।
এর মধ্যে দেশে যুদ্ধ শুরু হলে পরিবার নিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। একে একে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের উচ্চশিক্ষা শেষ হলে রজক ভাবলেন দুঃখের দিন এবার বুঝি শেষ হল! কিন্তু ছেলে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে বাবা-মাকে ছেড়ে চলে গেলেন। ছেলের এই অবাধ্যতা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ একদিন তার স্ত্রী আরতিও মারা গেলেন।
বৃদ্ধ বয়সে রজককে আবারও সেই একাকিত্বের জীবনে ফিরতে বাধ্য করল তার নিয়তি। রাজশাহী নগরের মহিষা বাথান এলাকায় থাকেন, ছোট মেয়ে জবা পাশেই থাকেন। তাদেরও অভাবের সংসার। ছোট জামাইও রিকশাচালক। এ যুগে তাদের সংসারে দুই সন্তানের পড়াশোনাসহ চার জনের অন্ন জোগাড় করতেই হিমশিম। সেখানে বাবার জন্য আর আর্থিক সহযোগিতার জায়গা কোথায়?
ঘরের পাশে দুটি ঘর করে ভাড়া দিয়েছিলেন রজক। সেই ঘরভাড়াও তার ছেলে মাস শেষে এসে জোর করে তুলে নিয়ে যান। তাই এখনও ৯০ বছর বয়সে ঘুরিয়েই চলেছেন রিকশার প্যাডেল। তার জীবনের প্যাডেল ঘোরানো রিকশা এখন বড় রাস্তায় চলাচলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই অলিতে গলিতে দু-একটি ভাড়া মারতে পারেন, তাও সময় বেশি লাগে বলে যাত্রীরা তার রিকশায় উঠতে চায় না।
সারা জীবনে নিজের জন্য একটা কানাকড়িও সঞ্চয় করতে পারেননি। তাই অটোরিকশা কেনার সামর্থ্য নেই। গ্যারেজ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতে বের হন। রিকশার জমা খরচ দিতেই তার বাকির খাতায় নাম লেখাতে হয়। বয়সের কারণে আজকাল প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সামান্য কিছু টাকা পান বয়স্ক ভাতা হিসেবে। যা দিয়ে তার চিকিৎসা খরচই হয় না।
রজক জানান, সরকার বা সমাজের কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাকে একটা অটোরিকশা কিনে দেয় ও নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করেন, তাহলে জীবনের কাছে আর কোনো প্রত্যাশা নেই তার।