দাসপ্রথার বিস্তার ও বিলোপের ইতিহাস



শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
দাসপ্রথার মতো অমানবিক পন্থা বিশ্বজুড়ে টিকে ছিল আঠার শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত

দাসপ্রথার মতো অমানবিক পন্থা বিশ্বজুড়ে টিকে ছিল আঠার শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

একসময় গবাদী পশুর মতোই হাটে-বাজারে কেনাবেচা হতো মানুষ। দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো তাদের। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকে পুরো দুনিয়ায় দাস ব্যবসা বিলুপ্ত হতে শুরু করলেও, দাসপ্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই বর্বর প্রথাকে উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামও চলে এসেছে অনেকদিন ধরে। সেই আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে, দুনিয়া থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে দাসপ্রথার। এই অমানবিক প্রথার অবসানকে চিহ্নিত করতে এবং প্রথাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ থেকে প্রতিবছর ২৩ আগস্ট পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/22/1566479459852.jpg
◤ সম-অধিকার, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোকে ত্বরান্বিত করেছে দাস প্রথার বিলোপ ◢


আজকের দিনে সারা দুনিয়াজুড়ে যে সম-অধিকার, মানবাধিকারের মতো ব্যাপারগুলো এত আলোচিত বিষয়, সেই পথে বিশ্ববাসীকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল দাস প্রথার বিলোপের মতো মহা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি। আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—মানবপাচার, যৌনদাস, জবরদস্তিমূলক শিশুশ্রম, বলপ্রয়োগে বিয়ে ও যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৭৯১ সালে বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিকান অঞ্চলে প্রথমে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেন ১৮০৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৮০৮ সালে তাদের আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। এরপর যুক্তরাজ্য ১৮৩৩ সালে, ফ্রান্স ১৮৪৮ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৫ সালে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। তারপরেও এখনো বিশ্বের এক কোটি ২০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দী রয়েছে। 

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/22/1566479489579.jpg
◤ পিরামিডের মতো সুবিশাল স্থাপত্যগুলো গড়ে উঠেছে দাসদের ঘাম, রক্ত ও ত্যাগে ◢


প্রাচীন দাসপ্রথাটি এখনো বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে এবং বিভিন্ন পরিবারে। মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। এর হাজারখানেক বছর পর থেকে এই প্রথা মিসর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষে। মিশরের গ্রেট পিরামিডের মতো সুবিশাল স্থাপত্যও তৈরি করা হয় দাসদের কাজে লাগিয়েই। এর অনেক পরে চীনে এই কু-প্রথাটি জেঁকে বসে। পিরামিডের মতোই চীনের মহাপ্রাচীরও নির্মিত দাসদের ঘাম, রক্ত ও কষ্টের ইতিহাস দিয়েই। ৮০০ হতে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিস এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার মারাত্মক বিস্তার। এভাবে প্রায় বিশ্বজুড়েই একসময় ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়াবহ কু-প্রথাটি।

কুখ্যাত ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা

দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে প্রচলিত ছিল দাস ব্যবসা। দাস ব্যবসার খুবই মন্দ রূপটি দেখা গিয়েছে মধ্যযুগে ‘ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা’য়। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর মানবজাতির ইতিহাস বদলে দেওয়া একটা দিন বলা যেতে পারে। ওইদিন ভারতের মাটিতে পৌঁছেছেন মনে করে আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে পা রাখেন নাবিক কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। এরপর থেকেই, ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মতো ইউরোপীয়রা ছুটে আসতে শুরু করল সদ্য আবিষ্কৃত এই মহাদেশে। স্থানীয় আদিবাসীদের একটু একটু করে সরিয়ে দিয়ে দখল করতে লাগল তাদের জমি। ইউরোপে অভাব ছিল প্রচুর পরিমাণে আবাদযোগ্য জমির। তাই, বিপুল পরিমাণে ফাঁকা আবাদী জমি পেয়ে যেন হাটে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল তারা। শুরু হলো ব্যাপক কৃষিকাজ, কিন্তু বাড়ল স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার। কিন্তু সমস্যা হলো উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো বিশাল দুটি মহাদেশের হাজার হাজার মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করার মতো জনবল তাদের ছিল না। সেই সমস্যা সমাধানে আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ কালো মানুষ ধরে আনা হলো কৃষি জমিতে কাজ করানোর জন্য। আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকায় দাস ধরে আনা হতো বলে ইতিহাসে তা পরিচিত ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’ হিসাবে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/22/1566479521413.jpg
◤ দাস ব্যবসার ঘৃণিত ও ভয়াবহতম রূপ দেখা গিয়েছে ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’-এ ◢


ইউরোপ থেকে দাসভর্তি প্রথম জাহাজটি আমেরিকায় পৌঁছায় ১৫০২ সালে। সেটি ছিল এক স্প্যানিশ জাহাজ। শুরুর দিকে দাস ব্যবসা পুরোপুরি ছিল পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশদের হাতে। সময়ের সাথে সাথে সমানতালে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও ফ্রান্স। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া দাস ব্যবসা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়ে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল আফ্রিকার প্রায় দেড় কোটি থেকে দুই কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময়, তাদের ওপর করা অত্যাচারে কিংবা ক্ষুৎপিপাসা ও রোগ শোকে। প্রায় ৮০ লক্ষের মতো দাস আনা হয়েছিল শুধু ব্রাজিলেই। ৪০ লক্ষ যুক্তরাষ্ট্রে। বাকিদের পাঠানো হয়েছিল হাইতি ও অন্যান্য ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোতে।

মূলত দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল যেটা বিস্তৃত ছিল সেনেগাল থেকে অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত। দাস ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ছিল বেনিন, টোগো এবং নাইজেরিয়ার পশ্চিম উপকূলে। তাই এলাকাগুলোকে স্লেভকোস্ট বা দাসের উপকূল বলা হতো। যুদ্ধবন্দী, অপরাধী, ঋণগ্রস্ত ও বিদ্রোহীদেরকে স্থানীয় আফ্রিকানদের কাছ থেকে দাস হিসেবে কিনে নিত ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অনেক সাধারণ মানুষকেও দাস ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে দাস হিসাবে বেচে দিত। মোট ৪৫টি ছোট বড় জাতিগোষ্ঠি থেকে দাস ধরে আনা হতো। এদের বেশিরভাগই ছিল আদিবাসী বা আফ্রিকার স্থানীয় সংস্কৃতির অনুসারী।

দাসদের ধরে আনা হতো জোর করে। তাই তাদের বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন রকম অত্যাচার করা ছিল দাস ব্যবসায়ীদের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তার ওপর বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা পড়ত সমুদ্র পথে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময়। জাহাজগুলোতে খরচ বাঁচানোর জন্য গাদাগাদি করে মানুষ ওঠানো হতো। থাকত না স্যানিটেশনের ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত খাবার। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিত হতো আমেরিকায় নিয়ে আসার পর। সেখানকার সিজনিং ক্যাম্পগুলোতে মারা পড়ত ডায়রিয়া ও আমাশয়ে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দাস। অনেকে এই অপমানের গ্লানি থেকে বাঁচতে পালানোর সময় মারা পড়ত, কেউবা করত আত্মহত্যা। দাসরা বিবেচিত হতো প্রভুর সম্পত্তি হিসাবে। যদিও সুদূর অতীত থেকেই দাসপ্রথা চলে আসছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, তবে কোথাও এর অমানবিকতা আমেরিকান দাসপ্রথাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমেরিকান ভূমি মালিকদের কাছে দাসরা ছিল কেবল কৃষি কাজের মাংসল যন্ত্র।

শিল্প বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর অর্থনীতি ছিল দাস নির্ভর। উত্তর আমেরিকার তুলা এবং ব্রাজিল ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের চিনি ছিল ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রধান অর্থকড়ি ফসল। ভারত থেকে আনা চা পান করার জন্য ক্যারিবীয় অঞ্চলের চিনির কদর তখন সারা ইউরোপ জুড়ে। চিনির বৈশ্বিক বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা। বলা হয়ে থেকে আমেরিকার কার্পাস তুলা থেকেই নাকি সূচনা হয়েছিল ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের। আর সেই তুলা থেকে বানানো সাদা কাপড়ের নীল জোগান দেওয়া হতো আমাদের দেশ থেকেই। সে আরেক নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। তবে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দাস ব্যবসার অর্থনৈতিক আবেদন কমে যেতে থাকে। তাই উনবিংশ শতক থেকে বিভিন্ন জায়গায় দাবি উঠতে থাকে দাস প্রথা বিলোপ করার।

দাসপ্রথা উচ্ছেদে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকা

রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস প্রথা সর্বপ্রথম বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইংল্যন্ড ১৮০৭ সালে। তারপর একে একে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতেও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হতে থাকে দাস ব্যবসা। সর্বশেষ দেশ হিসাবে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছিল ব্রাজিল ১৮৩০ সালে। তবে অবৈধ দাস ব্যবসা বন্ধ হতে ১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত সময় লাগে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ও দাসপ্রথা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৮৬১ সালে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরই আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে, দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলমান বিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল এই গৃহযুদ্ধ। লিংকনের জন্য তখন চ্যালেঞ্জ—এই যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করা, কিন্তু প্রধান সমস্যাটি ছিল চাইলেই দাসপ্রথা দূর করতে পারতেন না তিনি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/22/1566479550757.jpg
◤ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা উচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকা হয়ে আছে চির-স্মরণীয় ◢


শত শত বছর ধরে চলে আসা দাসপ্রথা আমেরিকার সংবিধান প্রণয়ণের সময় পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং লিংকনের আগে কোনো প্রেসিডেন্টই সংবিধান সংশোধনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেননি। অন্যদিকে আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যের যেহেতু স্বাধীনতা রয়েছে নিজস্ব আইন প্রণয়নের, তাই ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্য থেকে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু কট্টর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদ এত বেশি ছিল যে তারা দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে কোনো ভূমিকা নেয়নি, যা এই গৃহযুদ্ধ সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখে।

গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে লিংকনের প্রাধান্য ছিল বিদ্রোহ দমন করা। তার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে এমনটিই প্রতীয়মান হয়। ৬ আগস্ট, ১৮৬১ সালে তিনি একটি আইন পাশ করেন যা পরিচিত ‘কনফিসকেশন অ্যাক্ট’ নামে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্রোহে যারা সমর্থন জুগিয়েছিল তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যেহেতু দাসদেরকেও সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো, তাই এই আইন পাশের এক বছরের মধ্যে দশ হাজারেরও বেশি দাস ছাড়া পায়। কিন্তু এসব দাসেরা তাদের মালিকের কাছ থেকে ছাড়া পেলেও তারা আদৌ মুক্ত ছিল কিনা এবং পরবর্তীতে অন্য কোনো মালিকের দাসে পরিণত হতে পারত কিনা তা এই আইন ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তাই এই আইন তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে যে রাজনৈতিক সমর্থনের দরকার ছিল তা এটি আদায় করতে সক্ষম হয়।

তাই বলা যায় যে, যুদ্ধ যত গড়িয়েছে, ততই বেড়েছিল আব্রাহাম লিংকনের প্রভাব। প্রথমে তিনি শুধুমাত্র আমেরিকাকে একত্র করতে চাইলেও যখন তার কাছে সুযোগ এসেছে দাসদের মুক্ত করে এতদিনের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করার, তিনি কাজে লাগিয়েছেন সেই সুযোগ। এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাকে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এভাবে, ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হয় দাসপ্রথা।

উপমহাদেশে দাসপ্রথা

দাসপ্রথা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল এই বাংলা তথা উপমহাদেশেও। ১৮৬২ সালের হিসাবে আসামে ছিল ২৭,০০০ ও চট্টগ্রামে ছিল ১,২৫,০০০ দাস। দাম ছিল গড়ে কুড়ি টাকা। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাস ছিল এখানকারই নিজস্ব অধিবাসী। কিছু বিদেশি ক্রীতদাসও আসত। কলকাতাতে প্রতিবছর আসত প্রায় ১০০ ভিনদেশি দাস। ১৮৩০ সালের এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অযোধ্যার নবাব চড়া দামে কিনেছিলেন ৫ জন সুন্দরী বিদেশি মেয়ে আর ৭ জন ভিনদেশী পুরুষ। দাম পড়েছিল কুড়ি হাজার টাকা। পলাতক ক্রীতদাস ধরে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণারও নজির রয়েছে অনেক। ব্রিটিশ ওয়ারেন হেস্টিংস তো রীতিমতো নিয়ম করে দিয়েছিলেন কোনো দাস কেনার সময় আদালতে রেজিস্ট্রি করাতে হবে। কলকাতায় এই ফি ছিল দাসপ্রতি ৪ টাকা ৪ আনা। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দাসই হয় দুর্ভিক্ষের কারণে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছিল অথবা ছিল নিচু শ্রেণীর মানুষ, কিংবা ছেলে ধরার হাতে ধরা পড়া বাচ্চারা। বাংলার সুলতানেরা অবশ্য আফ্রিকা, তুর্কিস্তান, পারস্য আর চীন থেকেও কিনে আনাতেন দাস। ১৮৩০-এর শতকের শেষভাগে আফ্রিকা থেকে আনা ‘হাবসী’ আর ‘কাফ্রি’ ক্রীতদাসদের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। হিন্দু সমাজে টাকা দিয়ে কেনা দাসদের ডাকা হতো ‘ক্রীতদাস’ বা ‘দাস’ নামে আর মেয়ে ক্রীতদাসের নাম ছিল ‘দাসী’। মুসলিম সমাজে পুরুষ ক্রীতদাসদের নাম ছিল ‘গোলাম’ বা ‘নফর’ আর মেয়ে ক্রীতদাসের পরিচয় ছিল ‘বাঁদী’ নামে। তাছাড়া সুন্দরী বাঁদীদের দাম আর চাহিদাও বেশি। মহাজনদের দেনা শোধ করতে না পেরেও অসংখ্য মানুষ নিজেদের বিক্রি করে দিত দাস হিসেবে। সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম আর ঢাকা অঞ্চলে ১৮৩৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ওখানকার এক-পঞ্চমাংশ মানুষই ছিল ক্রীতদাস। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এসে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হতে থাকে। আমাদের এই অঞ্চলে ১৮৪৩ সালের পাঁচ নম্বর অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের পথটি সুগম হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/22/1566479583055.jpg
◤ দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলেও বাস্তবে এখনো বিভিন্নরুপে মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহৃত হতে করা হচ্ছে বাধ্য ◢


‘দাসত্ব’ বলতে বোঝায় কোনো মানুষকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এক্ষেত্রে কোনো মানুষকে অন্য মানুষের ‘অস্থাবর সম্পত্তি’ হিসেবে গণ্য করা। এই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্যক্তিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই স্থান বা মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের শ্রমের কোনো মজুরীও নেই। অতীতে কোনো কোনো সমাজে নিজের দাসকে হত্যা করাও আইনসঙ্গত ছিল। সেইসব বর্বরতা থেকে মানবজাতি বেরিয়ে এসেছে। তবে ক্রীতদাস প্রথার যে আধুনিক রূপান্তর, দরকার তার থেকে মুক্তির উপায় বের করা। মানব-সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সুসভ্য জাতিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও সেই অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে নেই। এই প্রেক্ষাপটে যে কোনো ধরনের দাসপ্রথাই যাতে জাতির সেই অগ্রযাত্রার পথকে কলঙ্কিত না করতে পারে, প্রত্যাশা হোক এমনটাই।

পাখিরা সংকটাপন্ন



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বিলুপ্তপ্রায় তালগাছ ও বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা। ছবি: এবি সিদ্দিক

বিলুপ্তপ্রায় তালগাছ ও বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলার পাখিরা এখন সংকটাপন্ন। এ কথার মানে বিপদগ্রস্থ। এক সময় পাখির কলকাকলীতে গ্রামবাংলার মানুষের ঘুম ভাংলেও এখন আর গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে আগের মত ব্যাপকভাবে পাখির ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। কালের আবর্তে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখি।

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে প্রয়োগ করা কীটনাশকের প্রভাবে এসব পাখি আজ বিলুপ্ত প্রায়। বিশেষ করে জাতীয় পাখি দোয়েল, বাবুই, মদনটাক, ঘুঘু, ময়না, শালিক, টিয়া, টুনটুনি, কাঠটোকরা, শ্যামা, কোকিল, চোখগ্যালো, ডাহুক, সারস, মাছরাঙা, মৌটুসি, প্যাঁচাসহ আরো অনেক পাখিকে আর দেখা যায় না।

শোনা যায়না এসব পাখির মধুর ডাক। আগে রাতের ঘুম ভাঙতো পাখির কলতানে অথচ এখন যান্ত্রিক যুগে ঘুম ভাঙে যানবাহন ও মাইকের শব্দে। রাতের প্রতিটি প্রহরে ডাকতো পাখি কিন্তু এখন প্রহর জানার যেন কোন উপায় নেই।

এমনকি বলাবাহুল্য যে, বর্তমান প্রজন্ম এসব পাখি চিনেই না, এসব পাখির ডাক শোনেনি কোন দিন। ফলে কিশোর-কিশোরদের কাছে এসব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। অবাক লাগে এদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল সেটিও আজ বই অথবা ছবিতে দেখে পরিচিত হয় শিশু-কিশোররা। তারা কখনো দেখেনি মুক্ত আকাশে উড়ান্ত এসব নামকরা পাখি, শোনেনি পাখির ডাকও।

শৈল্পিক বাসা তৈরি করছে বাবুই পাখি। ছবি: এবি সিদ্দিক

বলা যাক - বাবুই পাখির কথা। নিপুণ শিল্পকর্মে গড়ে তোলা কুঁড়ে ঘর সদৃশ্য দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখি বিখ্যাত। চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দুই-ই আজ হুমকির মুখে। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে শৈল্পিক বাসার কারিগর বাবুই । মাত্র এক যুগ আগেও বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বত্র চোখে পড়তো বাবুই পাখি। গ্রাম বাংলার মাঠের ধারে, পুকুর কিংবা মাঠের পাড়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে গেছে ইটভাটার আগ্রাসনে। তেমনি হারাতে বসেছে প্রকৃতির শিল্পী পাখির ভোরবেলার কিচিরমিচির সুমধুর ডাকাডাকি আর উড়াউড়ি।

এখন আর সারিবদ্ধ প্রহরী তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায় না তাদের শৈল্পিক বাসা। কিচির মিচির শব্দে মুখর হয় না গ্রামবাংলার জনপদ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকারিদের নানা কৌশলের পাখি শিকার, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছে। তাছাড়া সেই তালগাছের সারিও আজ খুব একটা চোখে পড়ে না।

সচেতনদের মতে, কৃষককূল কীট দমনে ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করে, এতে করে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালি সহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ আক্রান্ত হয় বা মারা যায়। আর এসকল মরা বা আক্রান্ত কীট খেয়ে পাখি মারা যাচ্ছে।

পশ্চিম হাইল হাওর এলাকার প্রায় সত্তর বছরের কৃষক ফজর আলী বললেন, আমরা আগে জমিতে কীটনাশক দিতাম না। ফলে সে সময় মাঠেঘাঠে হরেক রকম পাখি নেচে বেড়াতো। আমাদের ফসলী মাঠে পাখির অবাধ বিচরণের ফলে অতিষ্ঠ হয়ে মাঠে পাহারায় বসতে হতো, আবার কখনো নির্দ্দিষ্ট সময়ের আগেই ফসল ঘরে তুলতে হতো। আজ আর সেসব পাখি দেখা যায় না, পাখির ডাক শোনাও যায়না।

;

পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ

পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ

  • Font increase
  • Font Decrease

আনুমানিক শতবর্ষ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?'' কবিতা রচনার পটভূমি ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ব্রিটিশ-বাংলা। আজকের পটভূমিতেও কবিতাটি এতটুকু প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।

কারণ, একদিকে ঈদের আনন্দে ভাসছে মানুষ। আবার আরেকদিকেই চলছে চাপা হাহাকার। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দ্বৈরথ তীব্রভাবে বিদ্ধ হয়েছে বহু মানুষে আনন্দ, উপভোগ, উৎসব ও উদযাপন।

অনেক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পরেও একথা সত্য যে সমাজে বৈষম্য কমেনি। সম্পদের বণ্টন সুষম হয়নি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনধারণ করতেই নাভিশ্বাস চলছে।

মুদ্রার আরেক পিঠে কেনাবেচা চলছে লাখ টাকার পাঞ্জাবি, বাহারি উপহার, অঢেল টাকাপয়সার সয়লাব। গণমাধ্যমের সংবাদে জানা গেছে, এবার ঈদ উপলক্ষে হরেক রকমের পাঞ্জাবি এসেছে। একেকটির দাম একেক রকম। কাপড়ের মধ্যেও আছে বিস্তর ফারাক। রাজধানীতে পোশাকের বিভিন্ন শোরুম ঘুরে একটিতে এমন একটি পাঞ্জাবি পাওয়া গেল, যেটির দাম ৭৯ হাজার টাকা। রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরে এক ফ্যাশন ডিজাইনেট শোরুমে দেখা মিলল ‘সবচেয়ে দামি’ এই পাঞ্জাবির।

পলিনোজ জর্জেটের ওপর সূক্ষ্ম সেলাইয়ে জামদানির নকশা করা এই পাঞ্জাবি মাত্র একটি আনা হয়েছে। ‘আরোগ’ নামের একটি ব্র্যান্ডের জন্য এই পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে ভারতে। পাঞ্জাবির গায়ে থাকা মূল্য ৭৫ হাজার টাকা। তবে এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করলে এটির মোট দাম দাঁড়ায় ৭৯ হাজার টাকা।

এমন এক পাঞ্জাবির টাকায় কয়েকটি পরিবারের মাসের খরচ চলে যাওয়ার কথা। বিশেষত সদ্য প্রবহমান দারুণ গরমে গ্রামবাংলার বিশাল কৃষকগোষ্ঠী যে নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হয়েছে, তাদের কাছে এই গৌরবময় পাঞ্জাবির সংবাদ বজ্রাঘাত-সম। যে শ্রমিক ও দিনমজুর রোজার চরম কষ্টের পর সামান্য কটি টাকায় পরিবারপরিজনের মুখে ঈদ আনন্দের হাসি ফুটাতে লবেজান, তার কাছে দামি পাঞ্জাবির খবর তৃপ্তির বদলে কষ্ট বাড়ায়।

সামর্থ্যানুযায়ী মানুষ খরচ করবে, এতে কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু সেই খরচ যদি হয় শুধুমাত্র আত্মসুখ কবলিত, তাহলে একটি নৈতিক চাপ থেকে যায়। বরং যে খরচে নিজের পাশাপাশি সমাজের বহু মানুষের মঙ্গল নিহিত থাকে, তেমন খরচই কল্যাণকর।

কবিতায় সবাই পড়েছি, "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।" আরেকটি কবিতায় বলা হয়েছে, "আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা/ জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।"

কবিতাগুলো এমনিতেই রচিত হয়নি। সামাজিক প্রয়োজনে ও মানবিক কল্যাণেই কবি আরো বলেছেন, "আত্মসুখ অন্বেষণে আনন্দ নাহিরে/বারে বারে আসে অবসাদ/পরার্থে যে করে কর্ম তিতি ঘর্ম-নীরে/সেই লভে স্বর্গের প্রসাদ।"

অতএব, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সমাজের কল্যাণে নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে আছে পরম সুখ, অনির্বচনীয় আনন্দ ও অপরিসীম পরিতৃপ্তি।

অন্যের উপকার সাধনই তাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল বলে তাকে সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। এজন্য পরস্পর প্রীতি ও ভালােবাসা, নির্ভরতা ও সহযােগিতার পরিবেশ মানুষ নিজের প্রয়ােজনেই সৃষ্টির গােড়া থেকে গড়ে তুলেছে।

শুধু পরিবার বা সমাজ নয়, রাষ্ট্র নয়, সমগ্র পৃথিবী ও রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং জাতিগােষ্ঠী পরস্পর সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য, নির্ভরতা ও সহযােগিতার মধ্যে বাস করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কারণ একজন মানুষ যেমন সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করতে পারে না, তেমনি পৃথিবীর বৃহৎ মানবগােষ্ঠীও পরস্পর নির্ভরশীলতা ছাড়া বাস করতে পারছে না।

এমন একটি বৈশ্বিক সমাজে আমরা নিজেদের নিয়ে আত্মকেন্দ্রিকভাবে, শুধু নিজের সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে বাস করতে পারব না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ শুধু ভােগ-বিলাস ও স্বার্থের জন্যেই জন্মগ্রহণ করে নি। পরের কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করার মাঝেই তার জীবনের চরম ও পরম সার্থকতা। ঈদের সময় এই মনোভাবই সবার মধ্যে জাগ্রত হোক। ঈদ মোবারক।

;

ঠোকর দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে ছোট হলদেকুড়ালি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
গাছের ডালে মুখোমুখি ছোট হলদেকুড়ালি দম্পতি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

গাছের ডালে মুখোমুখি ছোট হলদেকুড়ালি দম্পতি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

গাছে গাছে গাছের গায়ে ঠোকর দিয়ে বেড়ানো একটি বিশেষ প্রজাতির পাখির নাম ছোট হলদেকুড়ালি। এরা এক ধরণের কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি। এদের ইংরেজি নাম Lesser Yellownape এবং বৈজ্ঞানিক নাম Picus chlorolophus। দেশের বিরল আবাসিক পাখি হিসেবে এরা পরিচিত।

বিরল আবাসিক পাখি -এ কথাটার অর্থ হলো – পাখিটিকে সচরাচর দেখা যায় না। আর যদিও বা দেখা যায় তারপরও খুবই কম সংখ্যায় দেখা যায়।

প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বলেন, ছোট হলদেকুড়ালি বাংলাদেশসহ ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাস করে। ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও সুন্দরবনের বাসিন্দা। এছাড়া চা-বাগানেও দেখা মেলে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। চোখা চঞ্চুর মাধ্যমে গাছের বাকল থেকে পিঁপড়া, উইপোকা ও গাছ ছিদ্রকারী পোকা সংগ্রহ করে খায়। তবে রসাল ফলও খেতে পারে। সচরাচর নীরব, মাঝেমধ্যে নাকি সুরে ‘পি-য়া...’ শব্দে ডাকে।

পাখিটির শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, দেহের দৈর্ঘ্য ২৫-২৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ৫৭-৭৪ গ্রাম। ঠকঠক শব্দে ডাল ঠোকরানো পাখিটি দেখতে বেশ সুন্দর। পিঠসহ দেহের ওপরটা সবুজাভ হলুদ। সবুজাভ মাথা ও জলপাই ঘাড়ে ছোট্ট সুদৃশ্য হলুদ–ঝুঁটি। লেজ কালচে, থুতনি সাদা ও বুক সবুজাভ। সাদা দেহতলে সবুজ ডোরা। চোখের রং গাঢ় লাল। চোখের চারপাশের ত্বক ধূসর। চঞ্চু কালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ, নখ বাদামি।

তিনি আরও বলেন, স্ত্রী-পুরুষে কিছুটা পার্থক্য থাকে। পুরুষের চোখ ও মাথার মাঝে গাঢ় লাল ডোরা থাকে। তাছাড়া একটি গাঢ় লাল রেখা চোখের ওপর দিয়ে চলে গেছে। স্ত্রী পাখির এই ডোরা না থাকলেও গাঢ় লাল রেখাটি চোখের পেছন থেকে ঘাড় পর্যন্ত চলে গেছে।

স্বভাব এবং খাদ্যতালিকা সম্পর্কে এ পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, ছোট হলদেকুড়ালি প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন, পাতাঝরা বন, পাহাড়ি বনও প্যারাবনে বিচরণ করে; সাধারণত জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়; মাঝে মাঝে ফিঙে, ছাতারে ও অন্যান্য পতঙ্গভুক পাখির সহযোগী হয়ে শিকার করতে দেখা যায়। ঠোকর দিয়ে গাছের বাকল থেকে এরা খাদ্য সংগ্রহ করে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঁপড়া ও উইপোকা, কাঠ ছিদ্রকারী পোকা, পিউপা ও রসালো ফল।

এপ্রিল থেকে মে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি ঘাড়ের হলুদ–ঝুঁটি খাড়া করে মাথা এপাশ-ওপাশ ঘোরায় ও গাছের ফাঁপা ডালে আঘাত করে ড্রামের মতো শব্দ করে। গাছের ক্ষয়ে যাওয়া ডালে গর্ত করে বাসা বানায়। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি, রং সাদা, যা ফোটে ১১-১৪ দিনে। আয়ুষ্কাল ৫-৬ বছর বলে জানান এই পাখি গবেষক।

;

বহু দূর থেকে শোনা যেতো যে মায়াবী পাখির ডাক



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
চন্দনা টিয়ার সৌন্দর্য। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

চন্দনা টিয়ার সৌন্দর্য। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

আকাশের ওই কোণ থেকে মৃদু ভেসে আসলে একটা পাখির ডাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ডাকটি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো। চা বাগান বা পাহাড়ি অঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায় এই পাখিটি একা কিংবা দলগতভাবে উড়ে চলে। তখন ডাক ছড়ায়। দূর থেকে দূরে।

তবে বর্তমানে এ পাখিটি খুব কম চোখে পড়ে। কালেভাদ্রে হয়তো দেখা যায়। প্রজননজনিত সমস্যা কারণে এ প্রজাতিটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।

বিলুপ্ত হয়ে পড়া এ পাখিটি নাম ‘চন্দনা’। কেউ কেউ ‘চন্দনা টিয়া’ও বলেন। পাখির নাম সবুজ টিয়া। তবে চন্দনা টিয়া নামেও উল্লেখ করা হয়। এর ইংরেজি নাম Alexandrine Parakeet বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula eupatria দেখতে খুব সুন্দর। সবুজ দেহ। তোতা পরিবারের মধ্যে এ পাখিগুলোই বেশি আকর্ষণীয়। দেহের তুলনায় এদের লেজ অনেকটাই লম্বা। বিচরণ করে শুষ্ক ও আর্দ্র পাতাঝরা বনাঞ্চলে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও দেখা যায়। এরা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি।

বিশেষ করে ফল এবং বীজজাতীয় শস্য খেতের আশপাশে বেশি নজরে পড়ে। ঝাঁকবেঁধে শস্য খেতে বিচরণ করার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এরা। যা খায় তার চেয়ে বেশি অপচয় করে। কৃষকদের সঙ্গে এদের বৈরিতার কারণ ফসল নষ্ট করা নিয়ে। মাঝে মধ্যে এদের একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করতে দেখা যায়। কণ্ঠস্বর কর্কশ।

খাবার খেতে ব্যস্ত চন্দনা। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

কয়েক দশক আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ প্রজাতিটির সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও ইদানিং যত্রতত্র নজরে পড়ে না। খাঁচায় বন্দী এবং উঁচু গাছ-গাছালির সংকটের কারণে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে প্রজাতিটি দেশে ‘মহাবিপন্ন’ হয়ে পড়েছে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার পর্যন্ত। অত্রাঞ্চলে এই পাখিগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে।

প্রজাতির দৈর্ঘ্য ৫৬-৬২ সেন্টিমিটার। লেজ ২৯-৩২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখি আকারে কিছুটা লম্বা। তাছাড়া পুরুষ পাখির গলার পেছনে এবং ঘাড়ের পাশে রয়েছে গোলাপি বলয়। থুতনির কালো রেখা গলাবন্ধের সঙ্গে মিশেছে। সব দেহ ঘাস-সবুজ রঙের। কেবল ডানার মধ্য পালকে রয়েছে লালপট্টি। স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে গলার পেছনের গোলাপি বলয় নজরে পড়ে না। থুতনির কালো রেখার উপস্থিতি নেই। যুবক চন্দনার ক্ষেত্রেও এ রকমটি নজরে পড়ে। উভয়ের ঠোঁট গাঢ় লাল। ঠোঁটের ডগা কমলা-লাল। চোখের পাতা কমলা-হলুদ, বলয় নীল।

ফল, ধান, গম, ভুট্টা, ফুলের রস, গাছের কচি পাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। তবে প্রথম পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এ ছাড়াও কাঠ ঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা দুই-চারটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে প্রায় তিন সপ্তাহ।

পাখি গবেষক সৌরভ মাহমুদ বলেন, চন্দনা টিয়া বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ আবাসিক পাখি। বাসা করার জন্য বড় গাছের অভাব, গাছে ফোকরের অভাব এবং অবাধে বেচাকেনার কারণে এ টিয়া প্রজাতি কেবল দেশের কয়েকটি জেলায় দেখা যেত। ঢাকায় এ পাখির উপস্থিতি জানার পর থেকে চন্দনা টিয়া নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হয়। দুই দফায় বাসা করার জন্য কাঠের ও পাইপের তৈরি কৃত্রিম বাসা ঝোলানো হয়, যেখানে এ পাখিটি বাসা করে। কারণ, ঢাকায় বয়সী গাছ কম এবং ফোকরহীন গাছই বেশি।

;