হাসন রাজা: জল ও জোছনার মরমী শিল্পী
আজো কানে আসে উন্মাতাল সুরে গাওয়া সেই গান: ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে।’ গানে ও সুরে পিরীতির নেশা লাগিয়ে দিয়েছিলেন হাসন রাজা। মানুষের নয়নে ও অন্তরে জাগিয়েছিলেন প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা।
এই সাধকের কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বার বার উল্লেখ করেছিলেন। আবহমান বাংলার এই মরমী সঙ্গীত সম্রাটের মৃত্যুবার্ষিকী ৬ ডিসেম্বর, মতান্তরে ৭ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে।
অনিন্দ্য সুরমা নদী তীরের মায়াবী মানুষ হাসন রাজার জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সালে। তিনি ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের জল ও জোছনার শহর সুনামগঞ্জের জমিদার। তার আসল নাম অহিদুর রেজা হলেও তিনি পরিচিত হন দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী নামে।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অঢেল সম্পদের কারণে প্রথম জীবনে তিনি বেছে নেন ভোগ ও বিলাশের অপরিমিত জীবন। আনন্দ, উল্লাস ও সৌখিনতায় তিনি একজন কুখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন।
কিন্তু ভাগ্যের বিচিত্র খেলায় সেই ব্যক্তিই বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার স্পর্শে সম্পূর্ণ বদলে যান। পরিণত হন সর্বত্যাগী এক সাধকে। লোকায়ত শিল্পীর মতো গান নিয়ে মেতে থাকেন নদীতে, নৌকায়, লোকালয়ে। গাইতে থাকেন অবিস্মরণীয় গান। গানের কথায় বলতে থাকেন জীবনের দার্শনিক কথামালা: ‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার/কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরই মাঝার।’
হাসন রাজা শুধু মনোজগতেই নন, বাইরের জীবনেও সম্পূর্ণ বদলে যান। খুলে ফেলেন রাজকীয় পোষাক-পরিচ্ছদ। ছেড়ে দেন জাকজমক। যৌবনকালের বেপরোয়ারা আচরণের লেশ মাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না তার মধ্যে। মানসিক পরিবর্তনের ফলে তিনি ছেড়ে দিলেন ভোগ-বিলাস এবং বিলি-বণ্টন করে দিলেন যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি। রাজার অবস্থান পরিত্যাগ করে তিনি সাধারণ মানুষের দীন-হীন জীবন অবলম্বন করেন।
জীবনবোধ ও চিন্তা-চেতনার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে হাসন রাজা তখন এক বদলে যাওয়া মানুষে রূপান্তরিত হন। সৃষ্টিকর্তার প্রেমে আকুল তখন তিনি। নিবেদিত তিনি সৃষ্টির সেবায়। আরাধনা, মানবকল্যাণ ও মানবসেবা হয়ে ওঠে তার জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান।
যে লোকের ভয়ে মানুষ কাঁপতো, সেই লোকই মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। হাজির হন জীবনের গূঢ় রহস্য ও দার্শনিকতার বাণী নিয়ে। ভোগের বদলে ত্যাগে আলোকিত এক জীবনের কথা তিনি বলতে থাকেন। শারীরিক ও কামজাত প্রেমের বদলে তিনি ডাক দেন শাশ্বত প্রেমময়তায় দিকে। কণ্ঠের হৃদয়স্পর্শী দরদ ভরা গানে ও সুরে বলতে থাকেন: ‘সোনাবন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো…।’
বাংলার পূর্বাঞ্চলের জলজ ভূগোলের এই রাজ্য-ত্যাগী হাসন রাজা সাধনার কঠিন পথে সঙ্গীত ও আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে পৌঁছে যান। তার গানের বাণী ও দর্শন উচ্চাঙ্গের বক্তব্যের মাধ্যমে ঋদ্ধ করে সমগ্র বাংলাদেশকে। বাংলার লোক-লোকান্তরের সংস্কৃতিতে মরমী আবহের চরম প্রকাশ ঘটে হাসন রাজার সহস্রাধিক গানে। যেসব গানের খুব কমই সংরক্ষিত হয়েছে। অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে। অনেকগুলো মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে।
অনন্য লালনের সঙ্গে তুলনা করা চলে অসামান্য হাসন রাজাকে। বাংলার আউল-বাউল-মরমী সঙ্গীতের পরম্পরায় তাকে শ্রেষ্ঠতর রূপে মান্য করা হয়। কথা ও সুরের সুগভীর তাৎপর্যে তিনি শতবর্ষ পরেও মানুষের আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন। গানে গানে মোহীত করছেন বাংলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে।
লোকায়ত বাংলার গ্রাম-জনপদে কান পাতলেই শোনা যায় তার হৃদয়ছোঁয়া গান। নদীতীরের ব্যথিত মানুষ বা আদিঅন্তহীন মাঠের উতলা কৃষক অথবা পল্লীর তাপিত কৃষাণীর গলায় গীত হয় তার গান। তার গান হৃদয়মথিত করে ভেসে আসে দূরাগত বেদনার ধ্বনি হয়ে।
হাসন রাজার শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই নিহিত যে, তিনি অপার সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পরলোকে যাত্রা করার কালেও গাইতে থাকেন: ‘সোনাবন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো…।’ ভালোবাসার কথাই তিনি বলেছেন জীবনে ও মরণে। তিনি এমন অনিন্দ্যিত ভালোবাসার গান গেয়েছেন, যে ভালোবাসায় সর্বত্যাগী ও বেদনার্ত হলেও বুকে খেলা করে এক অপার সমুদ্র। যে ভালোবাসা মিলনে বা বিচ্ছেদের হীরন্ময় দ্যুতির উজ্জ্বল আলোকমালায় মানুষের অন্দর ও বাহিরকে পূর্ণ ও পবিত্র করে। জল ও জোছনার শুদ্ধতম আবহে মানুষকে স্নাত করে হাসন রাজার অবিস্মরণীয় গানগুলো।