ঐতিহাসিক অধ্যাপক মুশিরুল হাসান স্মরণে
অধ্যাপক মুশিরুল হাসানকে সেই প্রথম দেখা। তখন এম এ ক্লাসের ছাত্র। শীতকালের বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। তারই মধ্যে ১৯৯৯ সালের শেষে কলকাতায় 'ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসে'র অধিবেশন।
মহাসাড়ম্বরে এই ইতিহাস কংগ্রেস ছিল আমাদের ছাত্র কালের শ্রেষ্ঠ পাওনা।
মনে পড়ে , অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনের কথা।
আলিপুর ক্যাম্পাসের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম তলে ফার্স্ট সেশনের লেকচার চলছে। অল্প বয়সী এক ঐতিহাসিক বিলেতি উচ্চারণে পেপার প্রেজেন্ট করে চলেছেন ঝড়ের গতিতে। চেয়ার করছিলেন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার। তখনও তাঁকে চেনার কোন উপায় ছিল না। দেখলাম লেকচার শেষে তিনি সুমিত সরকারের সঙ্গে সটান প্রফেসর চৌধুরীর চেম্বারে ঢুকলেন (ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী )।
সুশীলবাবুর ঘরেই বেশ জমিয়ে আড্ডা চলছে। সুমিত সরকার দেশের নাম করা ঐতিহাসিক। দিল্লীতে পড়ান। ইনি ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারের সুযোগ্য পুত্র। সপ্রতিভ, শান্ত স্বভাবের বিনয়ী মানুষ।
আমাদের কৌতুহল দেখে সুশীল বাবুও আমাদের ঘরে আসতে বললেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি প্রফেসর মুশিরুল হাসান, জামিয়াতে পড়ান। এই সময়ের খুব ব্রিলিয়ান্ট স্কলার, তাঁর অন্য আরও একটা পরিচয় আছে। উনি ঐতিহাসিক মহিবুল হাসানের পুত্র।
অধ্যাপক মুশিরুলের নাম তখনও না শুনলেও মহিবুল হাসানকে আমরা বিলক্ষণ জানতাম। কারণ তিনি টিপু সুলতানের ইতিহাস লিখে সুনাম ছড়িয়েছেন। তাঁর গবেষণা বাদ দিয়ে টিপুর ইতিহাস আজও অসম্পূর্ণ। যা হোক, তাঁর পুত্র মুশিরুল যে একসময় বিখ্যাত হতে পারেন তা খুব স্বাভাবিক।
সোমবার (১০ ডিসেম্বর) তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে ঐতিহাসিক মহলে একটা শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। বলা যায় ভারতীয় ইতিহাস দুনিয়ায় আরও এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ইন্দ্রপতন হলো।
খ্যতনামা ঐতিহাসিক মুশিরুল হাসান মাত্র ৭১ বছর বয়সে চলে গেলেন। মেওয়াট থেকে দিল্লীগামী পথে গত চারবছর আগে এক ভয়ানক গাড়ি দূর্ঘটনার কবলে পড়ে এ যাবৎ তিনি বিছানাগত ছিলেন। ঐতিহাসিক মুশিরুল হাসান পিতারই উত্তরসূরী ছিলেন। ১৯৪৯ সালে ১৫ আগস্ট বিলাসপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণময় জীবনের একাধারে মুশিরুল হাসানের কেবল ঐতিহাসিক হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেননি, ঐতিহাসিক ঘরানার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, জাতীয় মহাফেজখানার ডাইরেক্টরের দ্বায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য প্রশাসক হয়ে কর্মভার গ্রহণ করা। প্রায় তিন বছর যাবৎ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এবং পাঁচ বছর উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতার সঙ্গে উপাচার্যের দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুশিরুল হাসানকে আধুনিক জামিয়া মিলিয়ার রূপকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
মুশিরুলের লেখাপড়ার সূত্রপাত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে কেমব্রিজে গবেষণা এবং দেশে ফিরে ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একটা পর্বে, ২০১০ সালে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন তিনি।
"ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি", "দ্য সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্ডিয়ান সাউথ এশিয়া", "প্যারিস সেন্টার অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ", ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্টনি কলেজ সহ বহু গবেষণামূলক ইনস্টিটিউটে জড়িয়ে ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর প্রশংসনীয় কাজের মধ্যে "পার্টিশন অব ইন্ডিয়া" এবং "কমিউনালিজম" অন্যতম। পার্টিশন নিয়ে তাঁর চুলচেরা বিশ্লেষণ বিজ্ঞজনেদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম প্রসারের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে লব্ধঐতিহাসিক তিনি। তাঁর কর্মময় জীবনে অসংখ্য মৌলিক গবেষণামূলক গ্রন্থ, গ্রন্থ সম্পদনা, প্রবন্ধ লিখেছেন।
এমন বিদগ্ধ ঐতিহাসিককে অকালে হারিয়ে গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি ও কল্যাণ কামনা করি।
লেখক পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাস গবেষক।