হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে
তিনি বলেছিলেন, তার মৃত্যুতে কেউ যেন না কাঁদে। বিষাদ কণ্ঠে গেয়েছিলেন গান, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে জাদু ধন। মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’
কিন্তু সাত বছর আগে সুদূর আমেরিকায় তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন পুরো বাংলাদেশ কেঁদেছিল তার জন্য। শুধু সেদিনই নয়, বাংলা সাহিত্যের ভক্ত-অনুরাগীরা প্রতিটি দিনই তাকে স্মরণ করেন। তার কথা ভাবেন। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্ম নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। জীবনের প্রতিটি দিন তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল ও কর্মমুখর। জীবনকে উপভোগ করেছেন তিনি সৃজনের বিবিধ উপাচারে।
হাওর-বাওর-গানের দেশ বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোণার মোহনগঞ্জের নানাবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। একই জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর তার পিতৃভূমি।
পিতার চাকরির সুবাদে হুমায়ূনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের বহু স্থানে। সিলেটের মীরাবাজার, চট্টগ্রাম শহর, পিরোজপুরের মনকাড়া প্রকৃতিতে। যেসব কথা তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নের স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। পিএইচডি ডিগ্রি নেন আমেরিকার থেকে। শুরু করেন অধ্যাপনা।
কিন্তু তার ভাগ্য মিশে ছিল সাহিত্যে। সার্বক্ষণিক লেখালেখি, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণকে তিনি বেছে নেন। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে যে লেখক জীবনের সূচনা ঘটে, তা পরিণত হয় বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয়-জনপ্রিয় লেখক সত্তায়।
গল্প-উপন্যাসের জাদুকরী ক্ষমতায় অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেন তিনি। মানুষ লাইন ধরে কেনে তার বই। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয় হাজার হাজার কপি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব।
আর তিনি ছিলেন মেধা, প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার এক বিরল ব্যক্তিত্ব। সমকাল তো বটেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি গড়েছিলেন পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী রেকর্ড। যে রেকর্ড কারো পক্ষে ভাঙা আদৌ সম্ভব হবে না।
‘অচিনপুর’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’, ‘লীলাবতী’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘অচিনপুর’, ‘বাদশাহ নামদার’, ‘দেয়াল’, এমন তিন শতাধিক পাঠকনন্দিত উপন্যাসের রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যে অর্জন করেন নিজস্ব পরিচিতি ও ভূগোল। একা লড়াই করে সাহিত্যের পাঠক সৃষ্টির পাশাপাশি মৃতপ্রায় প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে দেন তিনি।
টিভি নাটকেও জনপ্রিয়তার ইতিহাস গড়েন তিনি। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘অয়োময়’, ‘দূরে কোথাও’, এমন হৃদয়ছোঁয়া নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় টেনে আনেন হাজার হাজার দর্শক।
চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও সোনা ফলিয়েছেন হুমায়ূন। সিনেমাহলমুখী করেছেন মানুষকে। তার নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘ঘেটু পুত্র কমলা’র মতো ছবি বাণিজ্য সফল ও পুরস্কৃত হয়েছে।
নাটক ও চলচ্চিত্রে তিনি লোকবাংলার বহু গান চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা বলেছেন। মানব-মানবীর অন্তর্গত হৃদয়ের দাহ ও বিষাদকে তুলে ধরেছেন অনন্য সুষমায়। তাকে ঘিরে শিল্প, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের এক নান্দনিক জগত উন্মোচিত হয়েছিল।
প্রেম ও রহস্যময় বেদনার প্রতীক নগ্নপদে হলুদপাঞ্জাবির ‘হিমু’ তার অনবদ্য সৃষ্টি। যুক্তিবাদী বিশ্লেষক মিসির আলীর মতো চরিত্রও তিনি সৃষ্টি করেছেন। হুমায়ূনের এই দুই চরিত্রের কথা বাংলা সাহিত্যের পাঠক সহজে ভুলবে না। ভুলবে না এমন আরো অনেক মানবিক চরিত্র ও কাহিনীর নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকেও।
মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদ, পুলিশ অফিসার বাবার জেষ্ঠ্য সন্তান হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির পুরোটা জুড়েই আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। হুমায়ূনের উপন্যাস ‘১৯৭১’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘উতল হাওয়া’ এবং চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়স্পর্শী কাহিনীচিত্র। যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখার পাশাপাশি আন্দোলনও করেছেন তিনি।
প্রেম ও বিরহ হুমায়ূনের লেখার মূল উপজীব্য হলেও তিনি তার লেখায় অপরূপ দক্ষতায় স্পর্শ করেছেন রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ঘটনাবলি। লেখার মায়াবী টানে তিনি পৌঁছে গেছেন মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে। নীল জোছনায় বেদনাহত একটি তরুণ কিংবা নীলপদ্ম হাতে একটি তরুণীর স্মৃতি-সত্তা পেরিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন মানুষের চেতনার গহীন প্রদেশে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে।