হুমায়ূনের গান, গানের হুমায়ূন
হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে কিংবদন্তী এক নাম, এটা উল্লেখ না করলেও চলে। সাহিত্যই সাহিত্যিক বানায়, হুমায়ূনকেও বানিয়েছে। আমার ধারণা সাহিত্যিক হুমায়ূনের সাফল্য অন্যান্য হুমায়ূনকে আবিষ্কার করেছে, অন্যান্য স্বপ্ন পূরণের সাহস দিয়েছে। লেখকের বাইরে গিয়ে প্রথমে হয়েছেন টিভি নাট্যকার, এরপর নিজেই পরিচালক। আত্মবিশ্বাসের জোরে ছোট পর্দা থেকে নিজেকে নিয়ে গেছেন বড় পর্দায়—চিত্রনির্মাতাও হয়েছেন। নিজের নাটক-সিনেমার জন্য গান লিখতে গিয়ে গীতিকারও হয়েছেন। প্রয়োজন তাঁকে দিয়ে গান লিখিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ভেতর একজন গীতিকবির বসবাস সবসময়ই ছিল। তিনি তো কবি হতে চেয়েছিলেন, শুরুতে কবিতাই লিখতেন। যখন বুঝেছেন তাঁকে দিয়ে কবিতা হবে না, তাড়াতাড়ি রাস্তা বদলেছেন। বুদ্ধিমান লোক তো! ভাগ্যিস কবিতা ছেড়ে কথাসাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন! না হলে দেশের কথাসাহিত্য বদলে দেওয়া একজন লেখক বাংলাদেশ পেত না। হুমায়ূন হয়তো ব্যর্থ কবি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সফল অধ্যাপক হয়েই থাকতেন। ব্যর্থ কবিরা অনেক সময়েই সফল গীতিকার এবং কথাসাহিত্যিক হন। উদাহরণের অভাব নেই। আমার আলাপ এ বিষয়ে নয়। তাই কথা না বাড়ানোই ভালো।
হুমায়ূন আহমেদ আমৃত্যু গানেরই মানুষ ছিলেন। আমি যতদূর জানি, এমন কোনো সপ্তাহ নেই নুহাশপল্লী বা তাঁর ধানমন্ডির বাসায় গানের আড্ডা হতো না। শাওনের জন্য হুমায়ূনের যে উথাল-পাথাল প্রেম, তা শাওনের গানের গলা আর গান গাইবার ক্ষমতার কারণেই জন্মেছিল। শাওন এ কথা একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নিজেই বলেছেন। লোকটা গানপাগল ছিলেন। বিশেষ ঝোঁক ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ভাটি অঞ্চলের গানের দিকে। তাঁর শেকড় ভাটির দিকে বলে হয়তো দুর্বলতাটা বেশি মাত্রায় ছিল; বিশেষ করে উকিল মুন্সির গানের দিকে তাঁর ঝোঁক কিংবদন্তী পর্যায়ের। নেত্রকোণা অঞ্চলের এই ভাববাদী গীতিকবি হুমায়ূনের গানের মানসে ব্যাপক প্রভাব রেখেছেন। তাঁর নাটক এবং সিনেমার গানের মাধ্যমে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উকিল মুন্সিকে চিনেছে। সুফিগানের শিল্পী বারী সিদ্দিকীকে কে না চেনেন? বারী সিদ্দিকী ছিলেন বংশীবাদক। বাংলা সিনেমা আর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যের গানে বাঁশি বাজাতেন তিনি। কণ্ঠশিল্পী হিসাবে তার ক্ষমতা এবং সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেখানেই ক্ষান্ত হননি লোকটা! বারী সিদ্দিকীকে দিয়ে নিজের পরিচালিত শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে প্লেব্যাক করিয়েছেন। বাকিটা ইতিহাস। ‘সোয়াচান পাখি, সোয়াচান পাখি আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছো নাকি’ আর ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়’ গান দুটি এবং বারী সিদ্দিকী অন্য এক উচ্চতা পেয়েছে। উকিল মুন্সি পৌঁছেছেন বাংলার ঘরে ঘরে।
কখনো কখনো বিরহকাতরতার মধ্যে দিয়েও গানে অদ্ভুতভাবে প্রেম প্রকাশ করেছেন। শাওন, প্রেম আর ব্যক্তিজীবনের সংকট না থাকলে এটা সম্ভবত সম্ভব হতো না। স্যাড টোনেও যে প্রেমের কথা বলা যায়, তা বাঙালিকে প্রথম শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ—এরপর হুমায়ূন। উদাহরণ হিসাবে ‘যদি মন কাঁদে’ গানটার কথা উল্লেখ করা যায়। যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায় ... যদিও আকাশ থাকবে বৈরী / কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি... নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে / মেঘমল্লার বৃষ্টিরও মনে মনে... কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে / জলভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে... হুমায়ূনের লেখা এই গানটিকে অনেকেই মনে করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। তাঁর সামনেই অনেকে বলেছেন, ‘এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা তো অন্যরকম!’ এসব শুনে হুমায়ূন আহমেদ খুব খুশি হতেন। প্রয়াত স্বামীর গান নিয়ে আয়োজিত এক টিভি অনুষ্ঠানে কথাটা শাওন বলেছিলেন ২০১৬’র নভেম্বরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি হুমায়ূন আহমেদের সমসাময়িক হতেন এবং এই গানটি লিখতেন, আমার ধারণা গানের ভাব ও ভাষা কাছাকাছিই হতো।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে যখন লেখা শুরু করেন, তখন রবি ঠাকুরের রোমান্টিসিজম এবং ভাটি গানের ভাব বা আধ্যাত্মবাদ তাতে প্রভাব রেখেছে। তিনি মূলত এই দুই ধরনের গানই লিখেছেন। গীতিকার হবার শুরুর দিকে তিনি ভাববাদী গানই লিখেছেন। রোমান্টিক গান লেখা শুরু করেছেন শাওনের সঙ্গে প্রেম হবার পর। আমার বিশ্বাস গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের পেছনে শাওন এবং তাদের প্রেম বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মনে হয়, একটা ছেলেমানুষী মন ছিল তাঁর, প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাস-উচ্ছল ব্যাপার ছিল পঞ্চাশের পরেও। হুমায়ূন আহমেদ অতিমাত্রায় চন্দ্রগ্রস্ত, মেঘ ও বৃষ্টিমনস্ক ছিলেন—ছিলেন কদমবাতিক। তিনি যদি ১৪/১৫টি গান লিখে থাকেন, এর অন্তত দশটিতে ঘুরে-ফিরে এসেছে চন্দ্র, চাঁদনী পসর, জ্যোৎস্না, বৃষ্টি, মেঘ, মেঘমল্লার, বৃষ্টিতে ভেজা, জল ইত্যাদি শব্দ। গানের কথায় খুব বৈচিত্র আছে বলা যাবে না। কিন্তু শুরুর দিকে মকসুদ জামিল মিন্টু এবং পরবর্তীতে এসআই টুটুল হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিরিকগুলিতে সুর দিতে যে মেধা আর শ্রম বিনিয়োগ করেছেন, খুব সাধারণ কথার গানও শুনতে অসাধারণ লেগেছে। প্রচুর রিপিটেশন থাকলেও হুমায়ূনের গানের ভাষা তাঁর গদ্যের মতোই সরল এবং সহজবোধ্য। যা মিডলক্লাস শ্রোতাদের পছন্দ। তাই মেঘ-বৃষ্টি-জল-চাঁদ-জ্যোৎস্নার বাহুল্য থাকার পরেও ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে অবাক জ্যোৎস্না ঢুইকা পড়ে’, ‘আমার আছে জল’, ‘যদি ডেকে বলি এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে’, ‘বরষার প্রথম দিনে’, ‘নদীর নাম ময়ূরাক্ষী’ গানগুলি বারবার শুনতে খারাপ লাগে না। খারাপ না লাগার আরেকটা কারণ, মুখের কাছাকাছি থাকা ভাষা।
এর বাইরেও হুমায়ূন আহমেদের লেখা দারুণ কিছু রোমান্টিক গান আছে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ‘যে থাকে আঁখি পল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে / যে থাকে নয়নে নয়নে তার সাথে কেন দেখা হবে’। সত্যিই তো, যে চোখের পলকে পলকে থাকে তার সাথে দেখা হবার কিছু নেই তো, সে তো সারাক্ষণই দৃষ্টির ভেতর আছে। চোখ বুঁজলেই যারে দেখা যায় সে তো সব সময়ই পাশে থাকে। একটা ছিল সোনার কন্যা গানটা খুব মনে পড়ছে। এই গানের সরল কাব্যময়তা শ্যামল বাঙলার তরুণীদের মনে পড়ায়। নব্বইয়ের শেষ আর দুই হাজারের শুরুর দিকে গানটি স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মুখেমুখে ছিল; যতদূর মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তোমার ঘরের সামনে ছোট্ট একটা ঘর বানাব গো’ গেয়ে বন্ধুকে প্রেমের প্রস্তাব দিতেও দেখেছি। এখনো হয়তো মান-অভিমান আর ঝগড়ার পর বা ভালোবাসার কথা বলতে প্রিয়জন হুমায়ূনের গান থেকে ‘চলো না যাই বসি নিরিবিলি / দুটি কথা বলি নিচু গলায়’ লাইন দুটি উচ্চারণ করে। টিপিক্যাল হুমায়ূনীয় প্রেমের লিরিক থেকে ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’ একেবারেই আলাদা। নিঃসন্দেহে এটি তাঁর লেখা অন্যতম সেরা একটি গান।
হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের গানগুলির বেশিরভাগই থেকে যাবে ধারণা করি। কেননা, গানগুলির কথার ধরন এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে মেলে। ভীরু, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের প্রেমকে প্রতিনিধিত্ব করে।
সাধারণের মধ্যে রবি ঠাকুরের গান পৌঁছে দিতেও তাঁর অবদান কম না। তাঁর অনেক ছবি আর টেলিভিশন নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার আছে। সেই ব্যবহার বেশ চমৎকার। আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। নাটকে, উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার মুখে বহুবার গান দুটি গাইয়েছেন। লক্ষ্য করার বিষয় এখানেও বৃষ্টি এবং কদমের প্রাধান্য। শাওনের কণ্ঠে অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল ‘মাঝেমাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’।
রোমান্টিসিজমের বাইরে ভাটি অঞ্চলের ভাববাদী গানের প্রভাবে বেশ কিছু গান রচনা করেছেন তিনি। না মানুষী বনে, হাবলঙ্গার বাজারে এই ধাঁচের গানগুলো সম্ভবত গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের শুরুর দিকের লেখা। এই ধরনের গান লেখার চেয়ে কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা অঞ্চলের অনেক গান তিনি প্রমোট করেছেন। তাঁর সবশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা-তে ‘যমুনার জল দেখতে কালো প্রেম করিতে লাগে ভালো যৌবন ভাসিয়া গেল জলে’ বা ‘শুয়া উড়িল উড়িল উড়িল রে’-এর উদাহরণ দেয়া যায়। শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে এ ধরনের গানের ব্যবহারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা সুফি গানগুলিতে মৃত্যুচিন্তা প্রবলভাবে দেখা যায়। তিনি মৃত্যু চিন্তাতেও প্রবল রোমান্টিক ছিলেন। চাঁদনী রাতে ঘর ছেড়ে বের হতে বলেছেন বারবার। প্রেম ও বিরহরাগে তাঁর কাছে জ্যোৎস্না একটা দাওয়াই। চন্দ্রকথা ছবিতে ব্যবহৃত একটি গানের কথা এরকম—‘চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে / কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে ... সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয় / এই চাঁদনী রাইতে তোমার হইছে গো সময়’। শুধু এই গান না, এস আই টুটুলের গাওয়া একটা গানে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন তাঁর মরণ যেন চাঁদনী পসর রাইতে হয়। একই গানে ভালোবাসা নিয়ে হাহাকার আছে। কে মৃত্যু নিয়ে আসে, সে কী দুধের চাঁদর গায়ে চন্দ্রখেলা খেলে? এরকম জিজ্ঞাসাও আছে। মৃত্যুকালে তিনি হসপিটালের বদ্ধ কামরায় স্তব্ধ-নিশ্চুপ দেয়াল দেখেছেন, চাঁদনী পসর রাত দেখতে পাননি। মৃত্যুর দেখা পাবার চেয়েও হুমায়ূন আহমেদকে কি এই না পাওয়ার দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছিল? জানতে ইচ্ছে করে।
মরিলে কান্দিস না আমার দায়। হুমায়ূন আহমেদের খুব প্রিয় গান। জীবনের শেষদিকে তিনি সম্ভবত পাপ-পূণ্য, পরকাল নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। না কেঁদে শিয়রে বসে সন্তানকে সুরা ইয়াছিন পড়া, শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা, কাঁদার বদলে মুখে কলমা পড়ার অনুরোধ এবং মসজিদে বসে আল্লাহর দরবারে কাঁদার কথা বলা হয়েছে এই গানে। হৃদয় বিদীর্ণ করা এক গান।
সব মিলিয়ে সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে গীতিকার এবং গানপাগল মানুষ হিসাবেও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভাবার আছে। যারা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে চেনেন না, তাঁর লেখা একটি লাইনও পড়েননি কিন্তু গান শোনেন—এমন মানুষের কাছেও তাদের অজান্তেই হুমায়ূনের বেঁচে থাকার কথা। যদি মন কাঁদে, ও আমার উড়াল পঙ্খীরে, ও কারিগর দয়ার সাগর, মরিলে কান্দিস না আমার দায় গানগুলি হারিয়ে যাবার নয়। গীতিকার ও গানের মানুষ হিসাবেও হুমায়ূন আহমেদ স্বতন্ত্রই ছিলেন।