বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা প্রয়োজন

কবির ভাষায় ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এই উপলব্ধিটা সর্বকালে সর্বদেশে একই রকম। বিধাতা আপন হাতে প্রকৃতিকে সৃষ্টি করে সেখানে এমন এক ভারসাম্য তৈরি করে দিয়েছেন যাতে এই প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রতিটি প্রাণী সহজে অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অগ্রসরমান সভ্যতা ও মানুষের অপরিমিত বাসনার কারণে এখন প্রকৃতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণীকুল।
প্রাণীকুল প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ এবং সম্পদও বটে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যই আমাদের বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হবে। কারণ প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর উদ্যোগে জাতিসংঘের ৮০টি সদস্য দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে কনজারভেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড স্পেসিস অব ওয়াইল্ড ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা (সিআইটিইএস) সনদ অনুমোদিত হয়। এই সনদে ৩৪ হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ৩ মার্চকে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো বন্যপ্রাণী সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববাসীকে সোচ্চার করে তোলা। সেই থেকে জাতিসংঘ প্রতিবছর বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস উদযাপন করে আসছে।
সারা বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার, বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা, বন ও বনভূমি হ্রাস এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে একসময় প্রচুর বন্যপ্রাণী ছিল। আমাদের অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে গত কয়েক দশকের ব্যবধানে আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বেশ কয়েক প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে আছে একশিঙ্গা গণ্ডার, বারশিঙ্গা, প্যারা হরিণ, রাজশকুন, বাদিহাঁস, গোলাপি শিরহাঁস, ময়ূর, মিঠাপানির কুমির, হকস্ বিলড্ টারটেল ইত্যাদি।
বাংলাদেশ বন বিভাগ দেশে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করছে। ১৯২৭ সালের বন আইনকে যুগোপযোগী করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের বন্যপ্রাণী আইনকে সংশোধন করে ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন -২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী আইনে দণ্ড ও শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে।
গত এক দশকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বাংলাদেশ বন বিভাগ বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বন অধিদপ্তর ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় বন্যপ্রাণী উইং সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজশাহী, রংপুর ও হবিগঞ্জে তিনটি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার ও নিধন বন্ধের লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে ঢাকায় এবং সকল বিভাগীয় শহরে ‘বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট’গঠন করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার বন্ধের লক্ষ্যে বন বিভাগ, পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, কাস্টমস ও বিজিবি’র সমন্বয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আহত ও উদ্ধারকরা বন্যপ্রাণীকে চিকিৎসাসেবা দিতে চারটি ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট ও হটলাইন চালু করা হয়েছে। বন বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাজীপুর শাল বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে আন্তর্জাতিক মানের ‘ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ৪১টি এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা বা প্রোটেকটেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৭টি জাতীয় উদ্যান, ২০টি অভয়ারণ্য, একটি ইকোপার্ক, দুটিটি বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা ও মেরিন প্রোটেকটেড এলাকা। বন্যপ্রাণীর বংশ বিস্তার ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে কক্সবাজার ও গাজীপুরে দুইটি সাফারি পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। ২২টি সংরক্ষিত এলাকাতে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সহযোগী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ওই সব এলাকায় বিশেষজ্ঞ দিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। সারাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও ইকো ট্যুরিজমকে সমৃদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও আবাসস্থল উন্নয়ন’ প্রকল্পের কাজ চলমান।
ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। নিয়মিতভাবে বাঘ মনিটরিং কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনের চারপাশের গ্রামগুলোতে বন বিভাগ ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে ‘টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে, যাতে লোকালয়ে বাঘ দেখামাত্র খবর আদান-প্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
সরকার ২০১০ সালে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা, গবেষণা ও বিশেষ অবদানের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন’ পদক চালু করে। বাঘ ও হাতির আক্রমণে নিহত ও আহত পরিবারকে সহায়তাদানের জন্য ২০১০ সালে ‘বন্যপ্রাণীর আক্রমণে জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে এক লাখ ও আহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫০ হাজার করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ২০১১-২০১৬ মেয়াদে ৪২১টি পরিবারের মধ্যে দুই কোটি ২৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান দেওয়া হয়েছে।
ফসলের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ এবং রাশি রাশি বৃক্ষে ঘেরা নিরিবিলি, ছায়া সুনিবিড় অসংখ্য গ্রামের সমাহার হচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশ। এক সময় বাংলাদেশ ছিল বিপুল বনরাজির ভাণ্ডার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন ও অবাধ বৃক্ষনিধনের ফলে সেই সম্পদ আজ নিঃশেষিত প্রায়। এছাড়া লাগামহীন বৃক্ষনিধনের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যাচ্ছে দ্রুত, বাড়ছে সিসার পরিমাণ, বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি ও বনজপ্রাণী। দেশে বনভূমি কমে যাওয়ায় শুধু বন্যপ্রাণী নয়, আবহাওয়ায়ও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। শীত ও বর্ষা কমে গিয়ে গ্রীষ্মের দাপট বেড়ে গেছে শুধু দাপট নয়, গ্রীষ্মঋতু বসন্তকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে।
এই অবস্থায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বেশি বেশি করে বন সৃষ্টি করতে হবে, বন পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষেত্রে আইনের কঠোরতা আরোপ করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে বন সৃষ্টি করতে হবে এবং যে সব বন আছে সেগুলোকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে হবে। বন না থাকলে বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ই থাকবে না। তাই সাধারণ মানুষ সচেতন হলে সহজেই বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে বন সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল নির্মাণ করা সম্ভব। দেশ ও জাতির স্বার্থেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা দরকার। বন্যপ্রাণী যাতে নিশ্চিহ্ন হতে না পারে সেদিকে সবার নজর দেওয়া জরুরি।
বন ও বন্যপ্রাণী আমাদের জাতীয় সম্পদ। আমাদের বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন। অহরহ বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী নিধন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম একটি বিরাজমান পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য একটি যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন করেছে। তবে আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়, প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা তৈরি করা। দেশ ও জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের যুগপৎ ভূমিকা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।