'জীবন তো তোমাকে ছেড়েই যাবে' মৃত্যু সম্পর্কে সুফি ভাবনা



আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

“মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো, ভ্রাতৃবৃন্দ

কারণ, মৃত্যু যে আসবে তা অনিবার্য,

কিন্তু তুমি তোমার আশা ছেড়ো না

হৃদয় যদি তোমার সাথে রূঢ় আচরণও করে

তোমার মাঝে মৃত্যুর প্রতিফলন রেখো

তা হলে তুমি সচেতন থাকবে, 

এবং তোমাকে ভালো কাজের দিকে ফেরাবে,

কারণ জীবন তো তোমাকে ছেড়েই যাবে।”

মৃত্যু সম্পর্কে মানুষকে এই পরামর্শ দিয়েছেন শায়খ ইবনে আল-হাবীব (১২৯৬-১৩৯১)। মৃত্যুকে শরীরের মৃত্যু হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু সুফিরা যখন বলেন যে তারা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন, তখন তারা এটিকে মৃত্যু হিসেবেই দেখেন। অনন্ত প্রেম এভাবে জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ইমাম আল-গাজ্জালী (পুরো নাম: আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তুসী আল-গাজ্জালী, মৃত্যু: ১১১১ খ্রিস্টাব্দ) বলেছেন যে, মৃত্যু সম্পর্কে স্মরণ করার তিনটি দিক রয়েছে:

১. জগতের সাথে যুক্ত ব্যক্তি স্মরণ করার ব্যাপারে উদাসীন থাকে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে, পৃথিবীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভীতি তাকে আবিষ্ট রাখে। 

২. অনুশোচনাকারীর স্মরণ: এই স্মরণে ভীতি তার ওপর আরও জাঁকিয়ে বসে এবং তার অনুশোচনায় সে ভেঙে পড়ে অতীতের ভুলত্রুটিকে সংশোধন করতে তার চেতনা তীব্র হয়ে ওঠে, যার আধ্যাত্মিক পুরস্কার ব্যাপক।

৩. সর্বজ্ঞের স্মরণ: যিনি মৃত্যুর পর তার প্রেমাস্পদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁকে দেখতে পাবেন এবং তাঁর বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সম্ভানা বিস্মৃত হন না।

হযরত হুদায়ফা তাঁর মৃত্যুর সময়ে বলেছেন, “তাঁর আকাঙ্খার মুহূর্তে তাঁর প্রিয়জনের আবির্ভাব ঘটেছে।” তৃতীয় পর্যায়ের পর আরেকটি পর্যায় রয়েছে, তার চেয়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যখন তুমি মৃত্যুকে আর অপছন্দ করবে না, এটি আকাঙ্খা করো না, অথবা মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়া অথবা বিলম্বিত হওয়ার আকাঙ্খা করো না। এর চেয়ে বরং তোমার প্রিয়জন যে আদেশ দিয়েছেন সেটিকেই প্রাধান্য দাও। শুধু তখনই তুমি পরিপূর্ণতা ও আত্মসমর্পণের জায়গায় উপনীত হবে।

ভারতের খ্যাতনামা এক সুফি সাধক শরফ আল-দীন মানেরি (মৃত্যু: ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ), যার সঙ্গে নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। মানেরি মানুষকে তিন শ্রেনিতে বিভক্ত করেছেন: ইর্ষাপরায়ণ ও লোভী; যারা সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী; এবং যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, '‘প্রমোদ প্রিয় মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবে না এবং ভাবলেও জাগতিক লাভের জন্য ভাবে। সৃষ্টিকর্তার স্মরণ এ ধরনের মানুষের কোনো কাজে আসে না, বরং এতে তারা সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে আরও দূরে সরে যায়। দ্বিতীয় ধরনের মানুষ সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হন, মৃত্যুকে স্মরণ করেন, হৃদয়ে মৃত্যুভীতি পোষণ করেন এবং সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হন। তারা সৃষ্টিকর্তার দিকে ফেরার আগেই হয়তো তাদের মৃত্যু চলে আসে। তৃতীয় পর্যায়ের মানুষ, যারা আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে পৌঁছেন তারা মৃত্যুকে সবসময় স্মরণ করেন; কারণ তিনি যার সঙ্গে নিবিড় হতে চান মৃত্যু সেই কাংখিতের নিকটবর্তী হওয়ার একটি সুযোগ। এ ধরনের মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চান, যাতে তারা পাপীদের এই আবাস থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেন। মানেরি বলতে চেয়েছেন যে, সাধারণ মানুষ মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে চায়, অপরদিকে সুফিরা মৃত্যুকে ভালোবাসেন ও মৃত্যু কামনা করেন।

হযরত আয়িশা (রা.) নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চান, “শেষ বিচারের দিনে কারা শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন?” রাসুল সা: উত্তর দেন: “যে ব্যক্তি প্রতিদিন ও রাতে বিশবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে।”

অন্য এক হাদিসে আছে: “বিশ্বাসীর জন্য মৃত্যু এক উপহার, কারণ পৃথিবী তাদের কাছে কারাগার তূল্য এবং পৃথিবীতে তারা সবসময় যাতনাক্লিষ্ট থাকে। মৃত্যু সেসব যাতনা ও কারাগার থেকে মুক্তি এবং নিঃসন্দেহে অমূল্য উপহার।”

সুফিরা প্রায়ই নবী মুহাম্মদের একটি হাদিসের উল্লেখ করেন, যাতে বলা হয়েছে: “আন-নাসু নিয়াম-ওয়া ইদা মাতু’নাতাবাহু,” অর্থ্যাৎ “মানুষ ঘুমিয়ে থাকে এবং যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তারা জাগ্রত হয়।”

মহানবীর এই বক্তব্যের মধ্যে জালালুদ্দীন রুমি দেখতে পেয়েছেন যে তিনি অনন্তের ভোরের আলোর দিকে নির্দেশ করেছেন, যার মধ্যে আমরা আমাদের বর্তমান জীবনে স্বাপ্নিকের মতো যে সকল কাজ সম্পন্ন করেছি সেসব কাজকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। তখন আমরা স্বপ্নের অবয়বগুলোকে অস্পষ্ট দেখবো না, বরং উন্মোচিত বাস্তবতা হিসেবে দেখতে পাবো।

ওপরের হাদিসটি মাথায় রেখে উর্দু কবি মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৫) লিখেছেন:

“হায়, ওহে মূর্খ, মৃত্যুর দিনে প্রমাণিত হবে, আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি, যা শুনেছি, সেসব কাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়।”

আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) বলেছেন:

“সারারাত ধরে স্বপ্নের এক অবয়বের সাথে আমার যাতনার কথা বলেছি, এই কথাগুলো থেকেই আমার নিদ্রাহীনতা এসেছে।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উপদেশ দিয়েছেন “মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ করতে,” যাতে আমরা যখন মারা যাবো তখন যাতে আসলে মারা না যাই। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি অসঙ্গতি রয়েছে; সুফিরা জীবনের প্রতি আকর্ষণের জন্য মৃত্যুবরণ করতে চেষ্টা করেন, একইভাবে তারা জীবনের আকর্ষণের প্রতি নিজেদেরকে উন্মোচিত করেন।

জীবনের আকর্ষণের জন্য মৃত্যুবরণ সম্পর্কে বলতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, মৃত্যুর পর আমাদের বাইরের বোধগুলো আর কাজ করে না। আমাদের জীবদ্দশায় বাইরের বোধ-অনুভূতি তাদের সক্রিয়তা বন্ধ করলে আমাদের ভেতরের বোধগুলো জেগে ওঠে। অনেকের জানা থাকতে পারে যে, আমরা আমাদের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমাদের কান বন্ধ করতে পারি এবং আমাদের অন্য আঙুলগুলো দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বন্ধ করে কল্পনা করতে পারি যে, আমরা সকল স্পর্শেন্দ্রিয়কে অবরুদ্ধ করেছি। কিন্তু সুফিরা জীবনের আকর্ষণের প্রতি নিজেদেরকে উন্মোচিত করার চেষ্টা করতে পাবেন।

আল্লাহ সুন্দরতম এবং তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন। আল্লাহ পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন একটি আয়নার মতো, যার মধ্যে তাঁর সৌন্দর্য ও মহিমার প্রশংসা করা যেতে পারে। সুফিরা জীবনের আরাধনা করেন। আল্লাহ হচ্ছেন ‘আল-হাঈ’, জীবন্ত। তিনি অবিনশ্বর, নির্বাণের মৃত্যু। আমরা আমাদের নিজেদের পরিবেশের মধ্যে তাঁর অস্তিত্ব দেখতে পাই।

‘আল-হাঈ’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে চিশতি পীর খাজা মঈনুদ্দীন (রাহ.) (১১৩৫-১২৩৮) আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন আত্মসমর্পণ করতে। তিনি বলেছেন, “তোমার এমন হওয়া উচিত, যেমন যারা জানাজা ও দাফনের জন্য প্রস্তুত করতে মৃতকে গোসল করায় তুমি তাদের হাতে একটি মৃতদেহ।” মৃত্যুর পর আমরা মধ্যবর্তী জগতে প্রবেশ করি আমাদের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক দিকগুলোর সম্পূূর্ণ বিপরীত ধারা নিয়ে। আমাদের চিন্তাভাবনা তখন এই জগতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু মধ্যবর্তী জগতে সেগুলো বাইরের দিকে প্রকাশিত হয়।

হযরত আলী (রা.) আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন মৃত্যুকে মনের মধ্যে এমনভাবে রাখতে হবে যেন আজকের দিনটিই আমাদের জীবনের শেষ দিন। আবার একই সময়ে আমাদের এমনভাবে বাঁচা উচিত যেন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আরও হাজার বছর পড়ে আছে।

সুফিবাদে আমিত্বের রূপান্তর আমাদের মন্দের দিকে প্ররোচিত করে, যাকে মৃত্যু হিসেবে দেখা যেতে পারে। শায়খ আবদ আল-রাজ্জাক আল কাশানি (মৃত্যু: ১৩৩০), যিনি আল-আরাবি নামে বেশি পরিচিত, তিনি সবুজ, সাদা, লাল ও কালো মৃত্যুকে সুফি পথের অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সুফিরা, নিজেদের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছেন, সেজন্য অনেক সময় কালো বস্ত্র ধারণ করেন। অবশ্য এর আগে তারা অন্য রঙয়ের জামাকাপড় পরিধান করতে পারেন, কারণ তারা সেই পর্যায়ে উন্নীত হননি। সবুজ মৃত্যু নির্দেশ করে রঙচটা, জোড়াতালি দেওয়া পোশাক পরিধানের। কেউ যদি এজন্য সুন্দর জামাকাপড় ত্যাগ করার মধ্যে সন্তুষ্ট থাকে এবং ইবাদতের জন্য সাধারণ বস্ত্র ধারণের মধ্যে নিজেকে সীমিত রাখে তাহলে তিনি সবুজ মৃত্যুর সান্নিধ্য লাভ করবেন।

ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)-কে (৭৬৭-৮২০) একবার জরাজীর্ণ, স্বল্পমূল্যের পোশাক পরিহিতি অবস্থায় দেখে এক অজ্ঞ ব্যক্তি তাঁর সমালোচনা করলে তিনি উত্তর দেন:

“আমার পিরহানের যদি কানাকড়ি মূল্যও না থাকে, তাতে কী আসে যায়, আমার এই জরাজীর্ণ বস্ত্রের নিচেই আছে এক অমূল্য প্রেমের আত্মা, তোমার পোশাক সূর্যের, কিন্তু এর ঔজ্জ্বল্যের নিচেই অন্ধকার, আমার পোশাক ঘনকালো রাতের মত, যার নিচে আছে একটি সূর্য।” 

কালো মৃত্যু নির্দেশ করে যে, কেউ অন্যান্য মানুষের দ্বারা যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তারা যে যন্ত্রণা দিয়েছে তাতে তার কোনো ক্ষতি হয়নি; বরং এর মধ্যেই তিনি পরিতৃপ্তি খুঁজে পেয়েছেন; কারণ তিনি এটিকে দেখেছেন তার কাক্ষিতের নিকট থেকে আগত আশির্বাদ হিসেবে। এ সম্পর্কে এক সূফি কবি বলেছেন;

“তোমাকে আকাংখা করার জন্য দোষারূপ করলেও তা মধুর, তোমার স্মৃতির প্রেমের জন্য তারা দোষ দিতে চাইলে দিক, আমি নিজেকে নিজের দুশমন ভেবেও তাদের ভালোবাসতে চেয়েছি, তুমি আমাকে ছোট ভাবলে আমি ছোট হতেও প্রস্তুত, ভৎর্সনার প্রাপ্য হওয়ার চেয়ে কে বেশি সম্মানিত হতে পারে?”

যিনি কালো মৃত্যুবরণ করেন তিনি আল্লাহর মাঝে নির্বাণ লাভ করেন এবং সত্যের অস্তিত্বের মাঝে জীবিত থাকেন।

শ্বেত মৃত্যু হচ্ছে ক্ষুধা। এই মৃত্যুর এ ধরনের নামকরণের কারণ হচ্ছে, এটি ভেতরকে আলোকিত করে এবং হৃদয়ের মুখকে উজ্জ্বল করে। কেউ যদি তার ক্ষুধা হ্রাস করতে না পারে তাহলে তিনি শ্বেত মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে তার বৃদ্ধিমত্তার পুনর্জাগরণ ঘটে। কারণ অধিক আহার্য গ্রহণ বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলীকে হত্যা করে। যখন কারও লোভের মৃত্যু ঘটে তখন তার কৃচ্ছতা পুনঃজাগ্রত হয়।

সূফি বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যু হচ্ছে স্বার্থপর আকাংখাকে দমন করা। এটি সুস্পষ্টভাবে স্বার্থপর প্রেমের দিক নির্দেশ করে, যা সব ধরনের লালসা ও সহজাত দৈহিক চাহিদার সঙ্গে যুক্ত। কারও স্বার্থপরতা যদি নিচের স্তরের দিকে ঝুঁকে, তাহলে হৃদয়কেও নিচের দিকে টেনে নিতে চায়। কেউ যদি নিজের লালসার কাছে মৃত্যুবরণ করে সেক্ষেত্রে হৃদয় প্রকৃত প্রেমের সহজাত পথে এগিয়ে যায়। কেউ যদি তার অহংকার দমনে সফল হন, তাহলে তিনি যে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সূফিরা সেটিকে বলেছেন লাল মৃত্যু।

আমরা কিছু দৃষ্টান্তের দিকে লক্ষ্য করতে পারি। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রাহ.) তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে নিজের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। লোকজন ভেতর থেকে অদ্ভুত এক শব্দ শুনতে পায়। তিনি আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি আল্লাহর প্রেমে মৃত্যুবরণ করেন।

চিশতি তরিকার লোকজন মনে করেন, মৃত্যু সম্পর্কে সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, তারা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবেন এবং জীবিত থাকলে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকবেন। অতএব জীবিত বা মৃতাবস্থায়ও তারা তাদের বন্ধুর সঙ্গেই থাকেন।

বিখ্যাত সুফি শায়খ গাউসুল আজম আবদুল কাদির জিলানি (রাহ.) (মৃত্যু: ১১৬৬ সাল) বলেছেন: “অহংকারের সকল ব্যাধির সর্বোত্তম নিরাময় হচ্ছে মৃত্যুকে স্মরণ করা।”

কেউ যখন মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন থাকে তখন তিনি ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। মৃত্যুর কথা ভাবার অর্থ হচ্ছে পরলোকের জীবনের জন্য উত্তম প্রস্তুতি গ্রহণ। খাঁটি ও পবিত্র জীবনের সুবিধা হচ্ছে, এমন জীবন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যু ভীতি থেকে মুক্ত রাখে। শায়খ আবদুল কাদির জিলানি ইবাদত করতেন এবং সকলের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। তিনি সিজদায় অবনত হতেন এবং যখন তাঁর মাথা তুলতেন তখন অদৃশ্য থেকে একটি কণ্ঠ শুনতেন, যার মর্ম: “হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি সন্তষ্ট চিত্তে তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও/আমার বান্দাদের সঙ্গে আমার উদ্যানে প্রবেশ করো।”

সুফিরা বলেন, মৃত্যু সম্পর্কে ধ্যান করে আমরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি যে, আমরা কে? আমরা কি আমাদের দেহ? কিন্তু আমাদের দেহের তো মৃত্যু ঘটে। আমাদের প্রভুর কাছে কী ফিরে যায়? যে প্রশান্ত আত্মার কথা বলা হয়েছে সেটি কী? এর গুণগুলো কী? কীভাবে এ ধরনের প্রশান্ত আত্মা অর্জন করা সম্ভব?

সৃষ্টার কাছে জীবন সমর্পণ করা আগে আবদুল কাদির জিলানি উচ্চারণ করেন, “আমি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি, যার সমতুল্য আর কেউ নেই, যিনি জীবন্ত এবং যার মৃত্যু ঘটে না এবং যার কোনো ভয়ভীতি নেই। বাস্তবিকপক্ষে তিনি পবিত্রতম, যিনি তাঁর সৃষ্টির কাছে মৃত্যুকে প্রেরণ করার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আল্লাহ সেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল।” এই শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর তিনি অনন্ত ভূমিতে প্রবেশ করেন।

সুফিদের কাছে মৃত্যু ভীতিকর অন্ধকারে চলে যাওয়া নয়, তাদেরকে বন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়ার অন্তিম যাত্রা। কিন্তু কেউ জানে না যে কখন মৃত্যু আসবে। গাছের সবুজ পাতা একসময় ঝরে পড়ে, ফুল শুকিয়ে যায় এবং তারকাগুলো হারিয়ে যায়, কিন্তু মৃত্যুর কোনো মৌসুম নেই। মৃত্যুর নিজস্ব মৌসুম রয়েছে। সুফিদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক, সার্বজনীন ও আবশ্যিক। তারা মৃত্যুবরণ করেন, যাতে তাদেরকে আর মরতে না হয়। জীবন তাদের কাছে মৃত্যু এবং মৃত্যু তাদের কাছে জীবন! 

ইবনে আল-আরাবি বলেছেন;

“হে ঘুমন্ত ব্যক্তি, কতজন আছে যারা ঘুমোচ্ছে না?

তোমাকে ডাকা হয়েছে, অতএব ওঠো!

আল্লাহ তোমাকে সবার মাঝে নেয়ার জন্য ডাকছেন, যদি ঘুমোতে চাও, তাহলে তাঁর পাশে গিয়ে ঘুমাও, এই ডাকেও তোমার হৃদয় বধির হয়ে আছে,

তুমি সৃষ্টির জগতে জেগে থাকো, যা তোমাকে প্রতিবার ধ্বংস করেছে, বিদায়ের আগে তোমার আত্মার খেয়াল করো, যাত্রার সময় রসদের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমির (১২০৭-১২৭৩) মতে “মৃত্যুর পূর্বে মারা যাওয়ার ধারণা এক ধরনের পুনরাবৃত্তি, যা বার বার ঘটে।” সুফিবাদে মৃত্যুকে আধ্যাত্মিক জীবনের উচ্চতর স্তরে পৌঁছার উপায় হিসেবে দেখা হয়।

রুমি বলেছেন, “আমাদের মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো। প্রেমিকের জীবনের সঙ্গেই তো মৃত্যু জড়িত। যদি তুমি তোমার প্রেমাস্পদের জীবন জয় করতে না পারো, তা হলে নিজেকেই হারাবে।” মৃত্যু সম্পর্কে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ও এর প্রকাশ অনেক সময় বেহেশতে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রাপ্তির ধারণার মধ্যে হারিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেছেন, মৃত্যুকে সবাই ভয় করে, কিন্তু প্রকৃত সুফিরা হাসে। কোনোকিছুই তাদের হৃদয় কে সন্ত্রস্ত করে না। ঝিনুকের খোলসের ওপর যত আঘাত আসুক তাতে মুক্তা ভাঙে না।” মৃত্যুতে তিনি কাঁদতে নিষেধ করেছেন, “আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদো না, কারণ আমি সেখানে নেই, আমি মরিনি।” রুমির মৃত্যু ভাবনা তাঁর অনেক কবিতায় এভাবে ওঠে এসেছে: 

“মৃত্যুর সঙ্গে চলে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, সূর্য অস্তমিত হয়, চাঁদ ডুবে যায়, কিন্তু তারা চলে যায় না।”

তাঁর আরেকটি কবিতায় আছে:

“পাথরের মৃত্যু হলে সে গাছ হয়ে ফিরে আসে, একটি গাছ মরে গেলে প্রাণী হয়ে জন্ম নেয়, আমি প্রাণী হিসেবে মরি এবং মানুষ হয়ে জন্ম নেই, আমার ভয়ের কী আছে? মৃত্যুতে আমি কী হারিয়েছি।”

মৃত্যু নিয়ে সাধারণত খুব বেশি কথাবার্তা না হলেও এবং ধর্মীয় গোড়ামির জালে আবৃত থাকলেও মৃত্যু ধর্মীয় আলোচনায় মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে বিদ্যমান থাকে। সুফিবাদে মানুষের সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় এবং জীবনের আধ্যাত্মিক বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়, যা মৃত্যুকে এড়ানোর পথ হিসেবে নয়, বরং মৃত্যুর বাস্তবতার শক্তিকে উচ্চতর, খাঁটি ও অধিক গুণসম্পন্ন জীবনের নিয়ে যাওয়া হয় এবং বোঝানো হয় যে পার্থিব জীবনের যে সীমাবদ্ধতাে তাকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। মৃত্যুই মানুষকে অসীমে নিয়ে যাওয়ার পথ। সেজন্য সুফিরা মৃত্যুকে বার বার স্মরণ করার কথা বলেন। মৃত্যুকে স্মরণ করাও ইবাদতের অংশ। সুফিরা কোরআনের এই আয়াতগুলো স্মরণ করিয়ে দেন, “তোমরা কি মনে করেছো যে আমি তোমাদের আমোদ-প্রমোদ করার জন্য সৃষ্টি করেছি এবং আমার কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে না?” (আল-মুমিনুন: ১১৫)। “বলো যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো তা অবশ্যই তোমাদের ধরে ফেলবে। এরপর অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সকল জ্ঞানের অধিকারীর কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে এবং তোমরা যা করেছো তা তোমাদের জানানো হবে,” (আল-জু’মা: ৮)।

ইসলামের প্রাথমিক সময় থেকে যারা মৃত্যু সম্পর্কে সুক্ষ্ম ও গভীরভাবে আলোচনা করেছেন তাদের অন্যতম ইমাম গাজ্জালি তাঁর “কিতার জিকর আল-মওতাওয়া-মাবা’দাহু" (মৃত্যুর স্মরণ ও পরবর্তী জীবন), যা তাঁর “ইহইয়া উলুম আল-দীন” (ধর্মীয় বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ) গ্রন্থের ৪০ খণ্ডের অংশ, তাতে বলেছেন, “প্রতিটি যাত্রা শুরুর জন্য রসদ সংগ্রহ জরুরি। অতএব এই পৃথিবী থেকে পরবর্তী জীবনে যাত্রার জন্য সেই রসদ হিসেবে আল্লাহর ভীতিকে গ্রহণ করো। কারণ মানুষ জানে না যে রাতের অবসানে যে পুনরায় জাগ্রত হবে কিনা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো উচ্চ আশা করার কারণ থাকতে পারে না।"

ওমর ইবনে আজিজ (রাহ.)-কে (৬৮২-৭২০) ইসলামী সাম্রাজ্যের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্বেও তিনি সবসময় মৃত্যুকে এমনভাবে স্মরণ করতেন যে, তাঁর এক বিচারক মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্বস্থি বোধ করতেন। ওমর ইবনে আজিজ তঁকে বলেন, “আমাকে কবরস্থ করার তিন দিন পর আপনি দেখতে পাবেন আমার চোখের মণি গলে আমার গাল বেয়ে পড়ছে, আমার ঠোঁট শুকিয়ে আমার দাঁতের সঙ্গে লেগে আছে, আমার মুখ হা হয়ে আছে এবং পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে, আমার পেট ফুলে আমার বুকের ওপরে ওঠে গেছে, পেছনের অংশে আমার মেরুদণ্ড বের হয়ে আছে এবং কেঁচো-পোকামাকড় ও পুঁজ আমার নাক দিয়ে বের হচ্ছে, এখন আমাকে যেভাবে দেখছেন তখন আপনি অনেক অকল্পনীয় কিছু দেখতে পাবেন।” তাঁর কথা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, এটি শুধু একজনের মৃত্যুর কল্পনা নয়, মৃত্যুর প্রক্রিয়ার ওপর গভীর ভাবনা।

ইমাম গাজ্জালির আধ্যাত্মিক জীবনের অভিযাত্রা এবং নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মৃত্যু সম্পর্কে ধ্যান ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ জিকর বা অনুশীলন। তিনি বিশ্বাস করতেন নিদ্রা মৃত্যুর অতি-নিকটে। তাঁর কাছে প্রতিটি দিন ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিন। সেজন্য তিনি তাঁর মুরিদদের উপদেশ দিতেন ঘুম থেকে ওঠেই প্রথমেই মুখে যে কথা উচ্চারণ করা উচিত তা হলো আল্লাহর প্রশংসা। রাসুল মুহাম্মদও এর ওপর জোর দিয়েছেন। এই অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষকে সবসময় আল্লাহর ওপর নিরঙ্কুশ নির্ভরশীল হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনের ওপর আলোকপাত করতে গাজ্জালি মানুষকে তাদের জীবনে খুব বেশি আশা পোষণ না করতে উৎসাহিত করেছেন, কারণ মৃত্যুর আগমণ আকস্মিক, মৃত্যু আসার সুনির্দিষ্ট সময়, নিয়ম ও বয়স নেই। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের মৃত্যুর ভাবনা ধৈর্যের অনুশীলনের পাশাপাশি জীবনের অবশিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত থাকার বোধ জাগিয়ে রাখে। এরই প্রতিফলনের জন্য ইমাম গাজ্জালি পরামর্শ দিয়েছেন; ১) বিছানাকে মক্কামুখী রাখতে; ২) ডান পাশে কাঁত হয়ে শয়ন করতে, যেভাবে কবরে মৃতকে শোয়ানো হয়; ৩) সবসময় স্মরণ করতে যে কেউ এভাবেই কবরে শয়ন করবে এবং সাথে থাকবে শুধু তার ভালো ও মন্দ কর্ম; এবং ৪) ঘুমানোর আগে দোয়া করতে হবে: ‘হে প্রভু, জীবিত ও মৃতাবস্থায় আমি তোমার সঙ্গেই আছি, প্রভু, আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি।’ 

ইরাকের কুফাবাসী সুফি আল-রাবি ইবনে খুতায়াম আল-থাওয়ারি (মৃতু: ৬৮২ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে জানা যায় যে তিনি কবরের মধ্যে ঘুমাতেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সামান্য কিছু সময়ের জন্যও যদি আমার হৃদয় মৃত্যু চিন্তা পরিত্যাগ করে, তা হলে আমার হৃদয় দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।” ইমাম গাজ্জালিও পরামর্শ দিতেন প্রত্যেকের কবর খনন করতে। কিন্তু এটি শরিয়ত সম্মত নয়। কিন্তু অনেক সুফি তাদের অনুসারীদের নিজ নিজ কবর খনন করতে পরামর্শ দিয়েছেন মৃত্যুকে সহজে মেনে নেওয়ার আবেগ সৃষ্টির উদ্দেশে। এর ফলে মৃত্যুর সঙ্গে পরিচয় ঘটবে এবং মৃত্যুকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হবে। সেজন্য সুফিরা তারুণ্য ও সুস্বাস্থ্যের ওপর অতি আস্থাশীল হওয়াকে শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার জন্য বিপজ্জনক বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ তারুণ্য ও সুস্বাস্থ্যের অহঙ্কারে মানুষ মৃত্যুকে দূরবর্তী সম্ভাবনা বলে মনে করে। মৃত্যু যে অতি-নিকটে এবং মৃত্যুর প্রক্রিয়া সাময়িক নয় তা মাথায় রেখে গাজ্জালি দিন ও রাতে অন্তত বিশবার মৃত্যুকে স্মরণ করতে এবং পরবর্তী জীবনে কল্যাণের জন্য মানুষের কী করা উচিত অহর্নিশি তা ভাবতে বলেছেন।

শুধু সুফি সাধকরাই নন, অন্যান্য ধর্মেও মৃত্যুর আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সুফি বিশ্বাসের অনুরূপ বক্তব্যই রয়েছে। খ্রিষ্টবাদে ভয়শূন্য চিত্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ইশ্বরের উপস্থিতিতে স্বর্গে অনন্ত জীবন লাভ করতে বলা হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী জীবনে স্বর্গ বা নরক লাভ নির্ভর করে পৃথিবীতে একজন মানুষের ইশ্বরে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের ওপর। হিন্দু ও বৌদ্ধরা দুটি প্রাচীন ধর্মের অনুসারী এবং দুটি ধর্মানুসারীরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন, যা নির্ভর করে মৃত্যুর সময় একজন ব্যক্তির মনের অবস্থা কী ছিল তার ওপর। ভগবদ গীতায় মৃত্যুর রহস্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মৃত্যু ডেকে আনতে পারে এমন কোনোকিছুর মোকাবিলা পরিহার করাই আমাদের সমগ্র জীবনের ভিত্তি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে মৃত্যু যন্ত্রণাদায়ক একটি ঘটনা। কিন্তু আমরা যখন মৃত্যুর প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করি তখন মৃত্যু আমাদের জীবন্ত আত্মা দিয়ে এত সহজে ও এত দ্রুত অতিক্রম করে যে আমরা বিস্মিত হই যে আমরা মৃত্যুকে এত ভয় করি কেন? যেহেতু আত্মা অমর এবং মৃত্যু শুধু একটি দেহ পরিবর্তন করে, যাকে আমরা আমাদের পরিধেয় পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি।”

মৃত্যু সম্পর্কে বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামা’র বক্তব্যও একই ধরনের। তিনি বলেছেন, “মৃত্যু মানে আমাদের বস্ত্র পরিবর্তন। বস্ত্র পুরনো হয়ে যায়, এরপর তা পরিবর্তন করার সময় আসে। একইভাবে দেহ পুরনো হয়ে যায় এবং তখন সময় আসে নবীন দেহ ধারণের।”

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট অনুবাদক।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;