চিরবিদায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান
ফরিদপুরের ভাণ্ডারিকান্দি তার আদিবাস। বড় ভাই বিশ্ববরেণ্য স্থপতি এফ. আর. খান মারা যান সৌদি আরবের জেদ্দায়। তিনি নিজেও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান খান শনিবার (২২ মে) বিকেলে আমেরিকার ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
১৯৩৮ সালে জন্ম নিয়ে এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আমেরিকার উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্বকালে এবং পরবর্তীকালের কিছুদিন ঢাকায় বসবাসকালে তিনি সংস্কৃতি জগতেও কাজ করেন। শেকসপিয়ারের কালজয়ী নাটক 'মুখরা রমণী বশীকরণ'-এ তার অভিনয়শৈলী দর্শকদের মুগ্ধ করে। বিখ্যাত নায়িকা আজমেরি জামান রেশমার সঙ্গে অভিনীত সেই নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে তিনি ফুলব্রাইট প্রফেসর হিসেবে বাংলাদেশে কাটান এবং এক টার্মের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে যুক্ত থাকেন। তখন তিনি আমাদের স্মাতকোত্তর শ্রেণিতে 'পলিসি মেকিং প্রসেস' পড়ান। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক হিসেবে তার অত্যন্ত আকর্ষণী ব্যক্তিত্ব, মেধাবী পাঠকৌশল ও পাণ্ডিত্যের দ্বারা আমাদের শিক্ষাজীবন প্রভূত উপকৃত হয়েছে।
শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তখন প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান খানের সঙ্গে আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার সুবাদে আমি সে সময় তার একাধিক সাক্ষাতকার গ্রহণ করি, যা সাপ্তাহিক রোববার এবং সাপ্তাহিক বিচিন্তায় প্রকাশিত হয়। 'নেতৃত্ব' বা লিডারশিপ বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য বিশেষজ্ঞ। তখনই তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বের নানা দিক রাজনীতি বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কাঠামোর আলোকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।
সে সময় তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিখ্যাত টি ফ্যামেলি তথা ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা রহমানের বোনের সঙ্গে। মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের নোটন হাউস, যা বর্তমানে পাক্ষিক অনন্যা কার্যালয়, সেখানেও তার সঙ্গে আমার একাধিক বার মিলিত হওয়ার এবং অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। তার সঙ্গে তার বই প্রকাশনার কাজের সুবাদে ইউপিএল'র মহিউদ্দীন আহমেদের মতিঝিল রেডক্রস ভবনের অফিসে এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার ভগ্নিপতি সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তোবারক হোসেনের মোহাম্মদপুর হুমায়ুন রোডের বাসভবনেও মিলিত হয়েছি।
তিনি ছিলেন প্রকৃতই সজ্জন, আপত্য স্নেহপ্রবণ, হাস্যরসে ভরপুর একজন সজিব মানুষ। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন জ্ঞানের অন্বেষী। জ্ঞানচর্চা, বিকাশ ও বিতরণে তিনি শুধু বাংলাভাষীদের কাছেই নন, আন্তর্জাতিক পণ্ডিতমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বরং বাংলা ভাষার পরিমণ্ডলের চেয়ে ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকার ইংরেজি ভাষা বলয়ে তিনি অধিকতর পরিচিত ও স্বীকৃত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান খানের বৌদ্ধিক আলোকছটার প্রমাণ তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো। এসবের মধ্যে অনেক বইই আছে বাংলাদেশের রাজনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে। বিশেষত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সামরিক শাসন এবং নেতৃত্বের প্রশ্নটি তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সে বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত বই Leadership in the Least Developed Nation, Bangladesh, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত Leadership Crisis in Bangladesh: Martial Law to Martial Law এবং ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বই The Third World Charismat: Sheikh Mujib and the Struggle for Freedom তার অন্যতম গবেষণা।
প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান খান ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল সায়েন্স এসোসিয়েশনের বাংলাদেশ স্টাডিজ চ্যাপ্টারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ মেধার বিকাশেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অথবা তার অ্যাকাডেমিক লেখালেখির মাধ্যমে প্রণোদনার সঞ্চার করেছেন। তার মৃত্যুতে এসব ক্ষেত্রে শূন্যতার সঙ্গে সঙ্গে একজন নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিরবিদায়জনিত বেদনা অনুভূত হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চার অঙ্গনে।