চিরবিদ্রোহী নজরুল
১৪২৮ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২০২১ সালের নজরুল জন্ম-জয়ন্তী (১১ জৈষ্ঠ্য) নানা কারণে তাৎপর্যবাহী। করেনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার। ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন। এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি 'বিদ্রোহী', যা এ বছরই স্পর্শ করতে চলেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'বিজলী' পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক 'প্রবাসী' (মাঘ ১৩২৮), মাসিক 'সাধনা' (বৈশাখ ১৩২৯) ও 'ধূমকেতু'তে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল।
'বিদ্রোহী' প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল 'চির উন্নত শির' রূপে বিরাজমান।
মধ্য কলকাতার তালতলা লেনের ৩/৪ সি বাড়িটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার আঁতুড়ঘর। ১৯২১ সালে দ্বিতল এই বাড়িটিতে বসে কবি লিখেছিলেন রক্তে দোলা জাগানিয়া ‘বল বীর.. চীর উন্নত মম শির।’কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে, আজও এই কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কোনও বিতর্ক নেই বাঙালি জীবনে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমোচনীয় রেকর্ড সৃষ্টিকারী কবিতা 'বিদ্রোহী' নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। 'ছায়ানট কলকাতা' নামের নজরুল চর্চায় নিবেদিত সংগঠন কলকাতায় যেসব এলাকায় নজরুল বসবাস করেছেন, সেসব ঠিকানা পুনরাবিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে 'বিদ্রোহী' কবিতা রচনার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে।
'ছায়ানট কলকাতা'র সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী সোমঋতা মল্লিক আলাপকালে আমাকে জানিয়েছেন, 'মালিকানার হাত বদল আর ইতিহাসের চলমানতায় নজরুল-স্মৃতিধন্য অনেক বাড়ি ও অবস্থান বিস্মৃত হয়ে গেছে। বদলে গেছে ল্যান্ডস্কেপ। তথাপি আমরা বাংলার, বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ নজরুলের কলকাতা-সংশ্লিষ্ট ইতিবৃত্ত পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী।'
দুঃখজনকভাবে, সুবিশাল সাহিত্যভাণ্ডার রচনা করেছেন নজরুল মাত্র ২০/২২ বছরের সংক্ষিপ্ত পরিসরেই। তারপরেই তিনি চিরনির্বাক হয়ে যান। তার সচেতন জীবনের পুরোটাই এবং অসুস্থতার দীর্ঘবছর কেটেছে কলকাতায়। ফলে নজরুল স্মৃতির কারণে কলকাতা এক সম্মানীত নগরী।
দমদম পেরিয়ে বিমানবন্দর বা যশোর রোড কিংবা ভারতীয় ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে তিলোত্তমা কলকাতায় প্রবেশের মুখে সুবিশাল-নান্দনিক নজরুল এভিনিউ অবধারিতভাবে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গ জীবনে এই মহান কবির বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির চিত্তে তার নিত্য উপস্থিতি ঘোষণা করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমণীয় রমনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত নজরুল আছেন বাঙালির সংস্কৃতি ও মানসপটে চিরপ্রবহমান।
অসীমান্তিক বাঙালি জীবনে, বিশ্বায়নের বৃহত্তর বাঙালি পরিসরে, বিশ্বব্যাপ্ত বঙ্গ সংস্কৃতির প্রসারিত ভূগোলে নজরুল আছেন চিরবিদ্রোহের 'শির উচুঁ' সাহসে ও প্রত্যয়ে। অন্যায়, অসাম্য, অমানবিকতা, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল এক জ্বলন্ত বিদ্রোহ, স্ফুলিঙ্গ-সম তীব্র প্রতিবাদ এবং সুমানবিক চেতনা-ঋদ্ধ আলোর মশাল।