তমিজ উদদীন লোদীর কাব্যিক ঐশ্বর্য



সাঈদ চৌধুরী
সাঈদ চৌধুরী  ও কবি তমিজ উদদীন লোদী

সাঈদ চৌধুরী ও কবি তমিজ উদদীন লোদী

  • Font increase
  • Font Decrease

আশির দশকের কবি তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা নতুন প্রজন্মের কবিরা নিরন্তর চর্চায় ব্রতী। শুধু কাব্যিক ঐশ্বর্য নয়, প্রবাস জীবনের প্রেক্ষাপটেও তিনি আলোচিত। তার কবিতা চলমান সমাজের দর্পন। যাপিত জীবনের প্রতীকী বিবরণ। তার পংক্তিমালায় রয়েছে অপরিমেয় মুগ্ধতা। খ্যাতিমান ইংলিশ কবি জন কীটস যেমনটি ভাবেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়’।

 ‘কী দ্রুত আনন্দ যায়, বিষাদ যায়, অহমিকা, দাপট যায়/ বিত্ত, বৈভব, চেয়ার ও সূরম্য বাগান পড়ে থাকে/ রাতারাতি গোটা মানুষটাই চলে যায়।’ তমিজ উদদীন লোদীর লেখায় রয়েছে জনমানুষের প্রতি এমন অপরিসীম দরদ। সমসাময়িক অনাচার এবং অপ্রাসঙ্গিকতাও কবিতায় তুলে ধরেছেন তিনি। কবি মনের অনুভূতিগুলো তখন সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায় সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। আর তখনই সেটা হয়ে উঠে কালোত্তীর্ণ কবিতা। 

কবির ভাষায় ‘রাত দৌড়াচ্ছে দিনের পেছনে আর দিনের পেছনে রাত/ বৃক্ষের মতো জীবন চৌচির হচ্ছে, যেন করাত/ কেটে নিচ্ছে সমস্ত সুষমা/ আমরা প্রতীক্ষায় আছি কখন কাটবে এই অমা।‘ এমন  শাশ্বতিক ও চিরন্তন ভাবনাগুলো পাঠক মনে শিহরণ জাগায়।

সত্তর দশকে সিলেটের তিন কবি জাতীয়ভাবে দুর্দান্ত প্রতাপে দেদীপ্যমান ছিলেন। তারা হলে গণমানুষের কবি দিলওয়ার, বিশ্বাসী কবিকণ্ঠ প্রফেসর আফজাল চৌধুরী ও ডাক সাইটে আমলা কবি মোফাজ্জল করিম। জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ ভাবে আলোচিত না হলেও তখন সিলেটে সামগ্রীক ভাবে আরো অনেকে ভাল কবিতা লিখে পাঠক মুগ্ধতা লাভ করেছেন। 

আশির দশকে সাহিত্যে নান্দনিকতা ও নতুনত্বের আভা ছড়িয়ে নিজেদের আগমন বার্তা সগৌরবে জানান দেন বেশ ক‘জন নতুন লেখিয়ে। তাদের মধ্যে তমিজ উদদীন লোদী, সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন সালেহ প্রমুখ ছিলেন সামনের কাতারে। তারা প্রায় সকলেই ছিলেন সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের সাথে সম্পৃক্ত। দীর্ঘদিন আমি সংলাপের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় সংলাপ মঞ্চের লেখকদের সফল জয়যাত্রা আমাকে উজ্জীবিত করে। 

প্রায় প্রথম থেকেই কবি তমিজ উদদীন লোদী এক নতুন আঙ্গিকে লেখালেখি শুরু করেন। তার কবিতার শরীরে অন্যরকম লাবণ্য দেখা যায়। তিনি রহস্যের গালিচায় কল্পনার বিস্তার ঘটাতে থাকেন। তার কবিতা পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে তা নয়, নতুন বোধেরও জন্ম দেয়। এই ধারায় তিনি এখনো পাঠকে নতুন নতুন সৃষ্টি উপহার দিচ্ছেন। শুধুই বসন্তের ঘ্রাণ কবিতায় তার পরিচয় বহন করে। 

‘.যখন হার্ডকপি থেকে সংকুচিত হচ্ছে সাহিত্য/ আর অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোয় জ্বলছে/ পাতার পর পাতায় তারাবাতি/ তখন শীতরাজ্য থেকে উঁকি দিচ্ছো তুমি,বসন্ত।/ শুকনো পাতা, ধুলো আর ঘ্রাণ। শুধুই বসন্তের ঘ্রাণ/ ঈষৎ ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো আমাদের আড্ডার প্ল্যাটফর্মে/ এসে থেমে যাচ্ছে। শাদা পাথরের মতো ঝকঝকে কিছু/ গোলাপ কে যেন কার খোঁপায় এঁটে দিচ্ছে নিরিবিলি।/ শীত জর্জরিত হাওয়া কেমন স্বর্গীয় হয়ে উঠলো হঠাৎ/ আবার কেমন ফিরে এলো জ্যোৎস্না যাপন, আশ্লেষ।/ কুয়াশার আস্তরণ পার হয়ে অদৃশ্য আগুন/ গোলাপ ফোঁটার মতো কেমন রক্তিম হয়ে উঠলো’।

এক অপূর্ব কাব্য সুষমায় বর্ণিল তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা বার বার পড়তে ইচ্ছে হয়। তার অনেকগুলো কবিতা চিত্ররূপময়তার অন্যরকম নিদর্শন বলা যায়। যেখানে রুপের শুধু বহিরাঙ্গ নয়, গভীর অন্তরাঙ্গও রয়েছে। ব্রাঁকুসির ভাস্কর্যের মতো কবিতায় তিনি লিখেন, ‘মা বলেছিলেন, ‘এই তোদের বাড়ি, এখানেই থাক তোরা‘/ আমরা থাকিনি, থাকতে পারিনি/ এক অদৃশ্য মায়া হরিণ টেনেছে নিয়ত। তার সজল ডাগর চোখ/ অশ্রুসজল। জলরংয়ের একটি নঞর্থক ছবি এঁকেছে শুধু।/ শহরের ধূসর প্রান্তরেখা হাতছানি দিয়ে ডেকেছে বারংবার/ বাস্তব আর আধা-বিমূর্ত রূপায়নের দিকে ছিল আমাদের যাত্রা/ কী এক দুর্নিবার টান সমস্ত পিছুটানকে কেমন আলগা করে দিয়েছিল/ মূলত আমরা শেকড়কে উপেক্ষা করে উপপ্লবী হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।/ পড়ে থাকল জন্মভিটে, পড়ে থাকল মায়াটান/ বুকের ভেতর থেকে উড়ে গেল সারস, জলপিপি, অজস্র সরল টিয়া/ কার্ণিশে বসে থাকা পায়রাগুলো ডানা ঝাপটালো/ আমরা শহর থেকে নগর, নগর থেকে গোলার্ধ পাড়ি দিলাম।/ অথচ দেখো, বাস্তব ও পরাবাস্তবের দোলাচলে/ উড়ে আসে সেইসব সারস, জলপিপি আর অজস্র সরল টিয়া/ বুকের ভেতর সেইসব পায়রারা গেরবাজ/ একটি সবুজ ধানকাউনের দেশ আধা-বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয়ে ওঠে/ শুশ্রূষার জন্য আকুল হয়ে ওঠে প্রাণ/ চেনা ভাটিয়ালি আর বাউলের সুর ব্রাঁকুসির ভাস্কর্যের মতো জেগে থাক ‘।

এখানে বলে রাখা ভাল, আশির দশকের কবিদের তখন শাসন করছিলেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিরা। এমনকি তারও আগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার প্রচন্ড আধিপত্য চলছিল। এছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক কবিতা ও প্রেমের কবিতা ব্যাপক সাড়া জাগায়। আল মাহমুদ, শামসুর রহমান প্রমুখ এই সময়ে সেরাদের সেরা হিবেবে বিবেচিত হন।

নতুন কবিদের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, ওই ধারার বাইরে গিয়ে নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার। তমিজ উদদীন লোদীসহ মাত্র কয়েকজন সেই চ্যালেঞ্জ যথার্থ ভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তবে নতুনত্ব মানে অতীতকে বিসর্জন নয়, নান্দনিকতায় উপস্থাপন। চিরায়ত সত্যকে ধর্ম ও দার্শনিকতায় বিশ্লেষন। সমকালীন অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা থেকে কবিতাকে পাঠকের কাছে নিয়ে এসছেন তারা। 

তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় এক ধরনের নষ্টালজিয়া অনুভূতির দেখা পাই। ‘শৈশবে এক বিচিত্র ভালোবাসা ছিল বৈশাখকে ঘিরে/ ঈশানে মেঘ, ঘন, কালো,/ প্রকৃতি মেঘাচ্ছন্ন থম ধরা/ উড়ছে ধুলোর কুণ্ডলি, ঝরাপাতা/ আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসে ষাঁড় ছিড়ে ফেলছে দড়ি।/ ভেজা হাওয়ার ঘ্রাণ, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি/ উজিয়ে আসছে কৈ ডাঙ্গায়, অনবদ্য কানকো গাঁথার ভঙ্গি/ টুপটাপ ঝরে পড়ছে কাঁচা আম এইসব দৃশ্যাবলী।/ ভৌতিক ছায়ার মতো দোলে ঝড়ের মহিমা আর/ খুব তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে জীবন ও মৃত্তিকা’।

পাঠক হৃদয়ে চিরচেনা বিষয়ের মধ্যেও এক ধরণের বিস্ময়বোধক জাগিয়ে রাখে তমিজ উদদীন লোদীর লেখায়। আর এই বিস্ময়বোধই আসলে কবিতা। এতে তিনি যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে চলেছেন, তা আমাদের সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়।

কবির ভাষায়, ‘দীর্ঘ কোমা থেকে বেরিয়ে সে দেখলো অচেনা আকাশ আর হাসপাতাল জুড়ে/ ওষুধ আর জীবাণুনাশকের গন্ধ। শুভ্রপোশাকের সেবিকা আর তাদের জুতোর খুটখাট।/ সে দেখলো তার মৃত্যুর(!) পর কাগজ জুড়ে আবক্ষ ছবি। শোকবাণী।/ দেখলো পাখিরা গাইছে। নদীগুলো স্রোতোবাহী।/ রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান, ব্যারিকেড। সঙ্গীণ উঁচিয়ে শৃঙ্খলাবাহিনী।/ সভায় সভায় একইরকম চেঁচানো। একইরকম গলাবাজি।/ হুস শব্দে চলে যাওয়া রাজন্য ও তার হুইশেলবাহিনী।/ তিমিরে পড়ে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা, জনতার ঢল/ ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, অন্ধকারের সাতকাহন।/ একই সমান্তরালে আমলা ও পুলিশ/ কলম ও ব্যাটন।/ তাকে ছাড়া থমকে গেল না তো কিছুই! / থেমে নেই কিছু। যথাযথ আছে সব।/ কিছুই আটকে নেই বরং চলছে সব ঠিকঠাক। কিন্তু সে তো শুনেছে,বারবার শুনেছে/ তাকে ছাড়া চলবে না এ রাজ্যের কিছুই।/ তাহলে চলে। কারো জন্য কিছুই আটকে থাকে না শেষতক!

জীবনের সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাত, সার্থকতা-ব্যর্থতার চিত্র তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বহুমার্ত্রিক বর্ণনায়। স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ আর অপমৃত্যু দেখে কবি বিচলিত বোধ করেন। তার চেতনায় মৃত্যুভয় অন্যরকম জিজ্ঞাসা হিসেবে উপস্থিত হয়। সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে কবি উচ্চারণ করেন, ’আগ্রাসী লোভ এবং মৃত্যুভয়/ এ দুটোকে যারা অতিক্রম করতে শিখে নেয় তাদের ভয় দেখিয়ে লাভ কি?‘

কবির এই সাহসী উচ্চারণ শোষিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রভাবিত করে। তরুণ হৃদয়ে মুক্তবুদ্ধির আভায় সমাজ পরিবর্তনের প্রত্যয় জাগরিত হয়। পশ্চিম তীর ও জেরুজালেম কবিতায় সেই দৃঢ় প্রত্যয় আবারো লক্ষ্য করা যায়।

কবি লিখেন, ‘খুব দূরে নয় জেরুজালেম। এখনো পয়গম্বরের/ পায়ের স্পর্শ নিয়ে ঝুলে আছে পবিত্র পাথর।/ তবে কেন শুধু গাজা কেন শুধু পশ্চিম তীর?/ তোমাদের রক্তের বুদবুদ এতো দ্রুত কী স্থিত হতে পারে?/ পাথরে পাথরে লেগে আছে সেজদার দাগ/ এখনো রাখাল খলিফার পদস্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে মাটি/ মহত্বে, শান্তিতে আর সাম্যে/ ভ্রাতৃত্বের মহান আহবান সত্ত্বেও নেতানিয়াহুরা আসে/ আইজ্যাক রবিনেরা যতই নিহত হোক/ রক্তের দাগের ভেতরেই ইহুদীরা অন্য পথ খোঁজে।/ উটেদের কাঁটাগাছ চিবানোর মতো/ বিভৎস উৎসাহে শান্তি ছুঁড়ে ফ্যালে সাগরের জলে।/ খুব দূরে নয় জেরুজালেম। রক্তের ভেতর দিয়েই/ একদিন তোমাদের হবে/ দেখে নিও একদিন তোমাদেরই হবে।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষামূলক উদ্ধৃতি গুলো যেমন আজও আশ্চর্য সমসাময়িক! বিভিন্ন প্রসঙ্গে তার ভাবনা একালেও আমাদের নতুন করে ভাবায়। তেমনি তমিজ উদদীন লোদীর উদ্ধৃতি কবিতা পাঠককে জাগ্রত ও আপ্লুত করে। আমাদের মেরুদন্ডহীন দলকানাদের সাংবাদিকতা দেখে তিনি যথার্থেই বলেন, ‘মিডিয়ায় গজিয়েছে কিছু বিবেকহীন ফাংগাস/ তারা মিথ্যার ছাই দিয়ে ধরে যাচ্ছে মাছ।’

মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেছেন, ‘প্রতিদিনই জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ গুরুতর মিথ্যা বলে’। ওয়াইজম্যানের মতে, ‘মানুষ মিথ্যা বলায় বেশ ভালো, মিথ্যা শনাক্ত করণে বেশ বাজে’। পুরুষ মোরগগুলো এমনভাবে আওয়াজ করে খাবারের মিথ্যে প্রলোভন তুলে ধরে, নারী মোরগগুলো এতে ছুটে আসে। এরপর তাদের খাবারের পরিবর্তে অন্যকর্মে বাধ্য করে। এমনি শত রকমের পশুবৃত্তি দেখে মানুষ অসদুপায় অবলম্বন করে। এই ভন্ড পশুদের খোলস উন্মোচন করে তমিজ উদদীন লোদী বলেন, ’বাইরে বাইরে বলছো ভালোবাসি/ ভেতরে বলছো খুন/ বাইরে বাইরে ঠাণ্ডা জল/ ভেতরে জ্বলন্ত আগুন’।

ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমস্ত নক্ষত্র পূঞ্জে যে জটিলতা ও রহস্য তার থেকেও রহস্যময় মানুষের মন’। অন্যত্র বলেছেন, ‘সবাই তোমাকে কষ্ট দিবে, কিন্ত তোমাকে এমন একজনকে খুজে নিতে হবে, যার দেয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে’| তার মতে, ‘পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়’।

আর কবি তমিজ উদদীন লোদী বলছেন, ‘মানুষ মানুষের কাছে যায়/ প্রীতির জন্য যায়/ বিনাশের জন্য যায়/ বিনাশ করতেও যায়/ তবু মানুষ থাকতে পারে না মানুষ ছাড়া।‘ তবে তিনি অভয় দিয়ে বলেন, ’ভালোবাসাই একমাত্র/ মানুষকে মানুষ আর মানবিক করে/ হিংস্রতা ধ্বংসের নাম/ ইতিহাস বলে।’ কবির এমন পংক্তিমালা মানবিক ভালবাসার মূল্যবোধকে জাগ্রত করে।

‘দু:খ আর অপমানকে আড়াল করে কবি এলেন বৃক্ষের কাছে/ দেখলেন বৃক্ষ শান্তিদায়ী/ তিনি হাত রাখলেন পাতায় হাত রাখলেন শেকড়ে/ যেন তিনি পুনর্বার খুঁজে পেলেন নিজেরই শেকড়।’ তমিজ উদদীন লোদীর এমন আগ্রহ উদ্দীপক কবিতার ইতিবাচক ভাবনার সঙ্গে অগ্রসর পাঠক তার নিজের ভাবনার মিল খুজে পান। তার কলমের ঐশ্বর্যে গৌরবান্বিত বোধ করেন।

গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়’। তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় এমনটি দেখতে পাই। গত চার দশকে আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি এক স্বাতন্ত্র স্বত্ত্বা আবিষ্কার করেছেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি মানুষের সুখ-দু:খ দেখতে পারেন। নানা উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় অনুচ্চারিতকে উচ্চারণ ও অনালোকিতকে আলোকিত করেন। জীবন বোধকে মানবিকীকরণ বা হিউমানাইজেশন করাই যেন তার কাজ।

করোনার দৃশ্য বর্ণনা করে কবি লিখেছেন, ‘অক্সিজেন সিলিণ্ডারটি পড়ে আছে পাশে/ নারীটির মুখে মাক্স, চোখে পৃথিবীপরিমাণ অসহায়ত্ব/ পেছনে জ্বলছে অস্থায়ী শ্মশান/ পুড়ছে সার সার লাশ, ভারি হয়ে উঠছে বাতাস’।

এই দৃশ্য ভীতির, এই দৃশ্য যাতনার শীরোনামে তমিজ উদদীন লোদীর আহত ও বেদনার হৃদয় ছোঁয়া কবিতা। ‘শ্মশানে ও গোরস্থানে মৃত্যুদৃশ্য/ সারসার শব সারসার লাশ/ দিনশেষে মানুষ মরিছে সভ্যতার/ এই দৃশ্য ভীতির, এই দৃশ্য যাতনার/ ফাঁপা বেলুনের মতো চুপসে যাচ্ছে সব/ ধর্মাধর্মহীন শুধু লাশ, শুধু শব!

কালজয়ী সাহিত্য কেবল ভাষার সুষমায় পূর্ণতা পায়না। গভীর জীবন দর্শন থাকতে হয়। কবি তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা ও গল্পে সময়ের চালচিত্র ও অন্তর্নিহিত জীবনবোধ নান্দনিকতার সাথে প্রবাহমান। লেখায় তিনি বিজ্ঞান ও দর্শনের ব্যবহার করেন অপূর্ব সুষমায়। 

যে যাচ্ছে দরজার ওপারে কবিতায়  লিখেন, ‘হে সূর্য, হে প্রকৃতি, হে নিসর্গের অফুরন্ত সৌন্দর্যের বিভা/ হে বন্ধু, বন্ধুভাবাপন্ন কিংবা বন্ধুপ্রতিমেরা/ হে আমার প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ শত্রু ভায়েরা/ আমার আরোহে, অবরোহে বিচলিত স্বজনেরা/ দেখো আমিও যাচ্ছি রহস্যময় দরজার ওপারে।/ কিংবা যে রহস্যময় পর্দা ঝুলছে এপারে-ওপারে/ তার রহস্য ভেদ করার জন্য আমি যাচ্ছি/ কোনো যোগাযোগ মাধ্যম-ই আমার এই রহস্যের অনুগামী হবে না/ কোনো দূরভাষ যন্ত্রেই ধরা পড়বে না আমার কণ্ঠস্বর/ একমুখি এই যাত্রায় পড়ে থাকবে বিগত যৌবন/ পড়ে থাকবে সিঁড়ি টপকাবার যাবতীয় কসরত/ পড়ে থাকবে রিরংসা, ঈর্ষা ও হিংসার প্রণোদনা/ পড়ে থাকবে নামে এবং বেনামের হিংস্রতা।/ তীব্র হাওয়ায় উড়ে যাওয়া শুকনো পাতার মতো/ উড়ে যাচ্ছি আকৃতিহীন স্তব্ধতায়/ বসন্ত এবং হেমন্ত পড়ে থাকছে চৈত্রের ধুলোর আস্তরণে/ অতিক্রম করছি আলোকবর্ষের পর আলোকবর্ষ/ গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি পেরিয়ে যাচ্ছি নিমেষে।/ কে থাকবে আমার বানানো প্রাসাদের সিংহ দরোজায়?/ যার প্রতিটি ইটে লেগে আছে রক্তের দাগ/ যার পেছনে রহস্যাবৃত ভণ্ডামি, সুবিধাবাদ/ কর্মযজ্ঞের ধারালো ব্লেডে কাটা মুণ্ডুর মতো অভিশাপ!/ এইসব ফেলে আমি যাচ্ছি নি:সঙ্গ ন্যালাখ্যাপা উন্মাদের মতো।’

আটার শতক থেকে বাংলা সাহিত্যে নানা ভাবে বিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যাসাগর আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহলী ছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার জন্য বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ সফলতার সাথে বিজ্ঞানের ব্যবহার করেছেন। তার বিজ্ঞান মনস্ক বহুমাত্রিক জীবন বোধ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

সত্যজিৎ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, রামেন্দ্রসুন্দর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য রচনায় সচেষ্ট ছিলেন। তবে তাদের প্রায় সকলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশী লেখার অনুবাদ করেছেন। রামেন্দ্রসুন্দর মুর্শিদাবাদ থেকে যুদ্ধবিশারদ হিসেবে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৮৮৭ সালে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নে এমএ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান থেকে অনেক রস আহরণ করে বাংলা সাহিত্যে ছড়িয়েছেন।

অবশ্য লেখায় বিজ্ঞান নির্ভরতা ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বা সায়েন্স ফিকশন আলাদা বিষয়। অবিভক্ত বাংলায় উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায় (১৮৬৯-১৯৩১)। এরপর অনেকেই এ ধারায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ কেউ বেশ সফলতা দেখিয়েছেন। তাদের গল্পে অদ্ভুত অনেক কিছু আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ তা আয়ত্ব করতে চায়। এসব বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন অনেক বড় লেখক। সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃত আইজ্যাক আজিমভের মতে, যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞানকে গল্প লেখার কাজে ব্যবহার না করলে সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান সৃষ্টি সম্ভব নয়।

বিজ্ঞান আশ্রয়ী তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় আধুনিক বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হয়ে ওঠে। গ্রামের চিরচেনা চিত্র যেমন তার লেখায় নতুন ভাবে কৌতুহল উদ্দীপ্ত হয়।

কবিতায় তমিজ উদদীন লোদীর সহজ সমীকরণ, ’যে গান আমি গাইব বলে মনস্থ করেছিলাম/ তার স্বরলিপি হারিয়ে গেছে কবে/ সুরের অন্বেষণে হন্যে হলে দেখি সুর নেই/ শুকনো নদীচরের মতো শুষ্ক হয়ে আছে।/ আমি যে লেখাটি লিখব বলে ভেবেছি দীর্ঘকাল/ তা দূরন্ত হরিণের মতো ছুটছে অবিরাম।/ পর্বতশীর্ষে দুষ্প্রাপ্য ফুলের জন্য আমি যখন আরোহী/ তখন কে এসে ফুলটি নিয়ে গেল টেরটিও পাইনি।/ ক্যাকটাস মাড়িয়ে আমি যখন দুষ্প্রাপ্য পাথর স্পর্শ করার প্রায়/ তখন আমার চোখের সামনেই পাথরগুলো গড়িয়ে যায়/ জানতেও পাইনি কোথাকার পাথর কোথায় গড়ালো?/ এ্যাক্রোবেটের মতো লাফাতে লাফাতে চালাকেরা যায়/ বানর লাফের মতো উঠে যায় মই বেয়ে।/ অনুভূতিঋদ্ধ সম্পর্কগুলো টুটে যায় হৃদয় বিদ্ধ করে/ পথের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে একঘেয়ে শূন্যতায়।’

উড়ে যায় সহাস্য সারস কবিতায় তমিজ উদদীন লোদীর দর্শন চোখে পড়ে। ‘জার্মান রোমান্টিসিজমের মতো/ যুক্তির দর্শনের বিপরীতে অনুভবের দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চাও/ তুমি বলো/ মানুষ কোনো গাণিতিক বা বিমূর্ত ধারণা নয়/ যুক্তিবাদ শুধু বস্তবিশ্বের ব্যাখ্যা দেয়, যা স্বরূপতই খণ্ডিত/ আমি দেখি রোমান্টিক ধারণা-আবৃত টিউলিপ ফুটেছে/ সেই চিরায়ত ঘুঘু ডেকে যাচ্ছে অবিরত/ এখনো যুবতী ব্রীড়ানত আঙ্গুলে প্যাচাচ্ছে শাড়ি/ কোথায় যে হারিয়ে যায় ' সাইন্স অফ লজিক'/ প্রকৃতির সরল উপাখ্যানে উড়ে যায় সহাস্য সারস ।

আমদের উঠোন জুড়ে কবিতায় দেখতে পাই ‘আমাদের বাড়িতে শুকনো পাতা ঝরে, হলদে পাতা ঝরে/ রাত্রিতে বাঁশপাতাগুলো কাঁপে/ মাঝে মাঝে বিভ্রম হয় জ্যোৎস্না কাঁপে নাকি বাঁশপাতা!/ কখনো মনে হয় ইঙ্গমার বার্গম্যানের জাদুলণ্ঠন দোলে।/ কখনো মনে হয় সুররিয়ালিজম, ডাডাইজম, এক্সপ্রেসনিজমের রসায়ন এসে দাঁড়িয়েছে দোরে/ কখনো উত্তরাধুনিকতার ধুলো এসে জমছে চৌকাঠে/ তবু কেমন করে জানি লিরিক আর দার্শনিকতা আমাদের ছুঁয়ে যায়/ আমদের উঠোন জুড়ে আছড়ে পড়ে বাউলের শতকণ্ঠ গা‘।

বিজ্ঞান মানসের ফলে সাহিত্যে এই কবি শুধু কল্পনা আশ্রয়ী লেখায় ব্যস্ত হতে দেখা যায়না। বরং ধর্ম ও বিজ্ঞানের শিক্ষায় সত্য ও বিশ্বস্ততার মানদন্ডে শানিত তার কল্পনার জগত। ফলে অনেক গুলো লেখায় দেখেছি, কবির ভাবনা জগত আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পটভূমি থেকে উৎসারিত। কবির ভাষায় ‘গোধূলির স্পন্দিত আলোয় নিসর্গ নমিত হলে/ গাঢ় হয়ে উঠল শিথিল এষণা/ লুক্কায়িত গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো অণুজীব/ হামাগুড়ি দিতে থাকলো মিউটেন্টগুলো।/ অতীন্দ্রিয় রহস্যের মতো অন্ত্যজ জীবনগুলো/ উত্তুঙ্গ আনন্দ থেকে নেমে যেতে থাকলো বিষণ্ণ বিধুর আকাঙ্ক্ষায়/ গোরস্থানে নেমে এলো সারসার শাদা অন্ধকার/ জীবন গড়িয়ে গেলো জীবনপাতে।/ এপিটাফের পর এপিটাফে ছেয়ে গেল/ যেন বাগান পাথরের/ পাথরে খোদিত অক্ষরগুলো নিষ্প্রাণ স্মৃতি হতে থাকলো/ একদা যে বাগানে অজস্র পাখির আনাগোনা ছিল/ সেখানে শুধুই হাওয়া বইতে থাকলো বিপন্নতায়’।

মহাকাব্য সম্পর্কে তমিজ উদদীন লোদীর উপলব্ধি ‘পুরাণ ও মহাকাব্যের যৌথ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন/ ব্যাসদেব, বাল্মিকী, ভার্জিল ও হোমার/ নেমে আসেন দান্তে, গ্যেটে, মিল্টন ও মাইকেল/ তারপর আর কোনো মহাকাব্য নেই/ যদিও কায়কোবাদ 'মহাশ্মশান'-এ প্রয়াস নিয়েছিলেন/ এপিকের রাজ্যে তারপর খা খা শূন্যতা/ স্থবির জলাশয়ে আর কোনো ঢেউ নেই/ কবিতার অন্তর্লোকে নানা বাঁক/ আত্মশ্লাঘার নেশা/ তবু কোথায় যেন হারিয়ে গেল মহাকাব্য/ দিকহারা নাবিকের মতো ।

জীবন কবিতায় তিনি জানান দেন, ‘রাত গভীর হলে কী এক সুনসান নিরবতা নেমে আসে চারপাশে।/ শুধু মাঝে মাঝে ট্রেনের শব্দ।/ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে ঝাঁকিয়ে চলে যায়। ঘুমিয়ে থাকে বিধ্বস্ত নগর।/ চাপা পড়া ইটের ফাঁক থেকে উঁকি দেয়া চারাটির মতো, জীবন নড়ে ওঠে। আবারো দাঁড়াতে চায়, যেন টলমলে শিশু। রাতের স্তব্ধতার ভেতর আমি জীবনের নড়াচড়া টের পাই। অজস্র মৃত্যুর ভেতরেও যে এখনো টিকে থাকার সংগ্রামে নিরত’।

কবি তমিজ উদদীন লোদী মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে আত্মার খোরাক অন্বেষণ করেন। আত্মাকে পোড়ালে তুমি কবিতায় অপূর্ব পংক্তিমালা পাঠক মনে ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। ‘শরীর তো বাহানা মাত্র। আসলে আত্মাকে পোড়ালে তুমি।/ সিয়ামের অদৃশ্য আগুনে। জঠরশূন্য তুমিও জানলে কতটুকু ক্ষুধার আগুন। তুমিও রমাদানে ক্ষুধার্তের কাতারে দাঁড়ালে।/ মিথ্যা ও অশ্লীলতাকে পরিহার করলে তুমি। তুমি অন্বেষণ করলে তাকওয়া। তোমার জন্যে অপেক্ষমান কাওসারের পেয়ালা। তুমি সংবরণের মাধ্যমে অর্জন করছো পবিত্রতা। আর পবিত্রতা চাদোয়ার মতো নেমেছে সবখানে।/ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এক রাত্রি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে নাজাত। সওমের পবিত্রতায় ধৌত হচ্ছো তুমি। তুমি মানুষ হয়ে উঠছো, পবিত্র মানুষ। তোমার চারপাশে ঘূর্ণিত হচ্ছে আলো। অপার্থিব অলৌকিক এক আলো।/ যে আলোয় ভিজে যাচ্ছো তুমি। ভিজে যাচ্ছে পার্থিব পৃথিবী।

ঐশী গ্রন্থ থেকে কবি তমিজ উদ্ দীন লোদীর কাব্যানুবাদ অপূর্ব ব্যঞ্জনায় আমাদের মুগ্ধ করে প্রতিদিন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আমপারা কাব্যানুবাদের রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ ও সৃজন চৈতন্য যেমন পাঠক মনে সাড়া জাগিয়ে ছিল।

সূরা আল-ফালাক বা ঊষা: ‘বলো, আমি আশ্রয় চাই ঊষার স্রষ্টার/ তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে/ অনিষ্ট হতে রাতের অন্ধকারের, যখন তা গভীর হয়/ এবং অনিষ্ট হতে সে সব নারীদের যারা গ্রন্থিতে ফুঁ দেয়/ এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা কর ‘।

সূরা আন-নাস বা মানব সম্প্রদায়: ‘বলো, আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের/ মানুষের অধিপতির/ মানুষের প্রভুর/ আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে/ যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে/ জিন ও মানুষের মধ্য থেকে‘।

সূরা আল-কারিআহ বা মহাপ্রলয়: ‘মহাপ্রলয় কী?/ মহাপ্রলয় সম্মন্ধে তুমি কী জানো?/ সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো/ পর্বতসমূহ হবে ধূনিত রঙিন পশমের মতো।/ তখন যার পাল্লা ভারি হবে/ তার হবে পরিতৃপ্তির জীবন/ আর যার পাল্লা হালকা হবে/ তার আশ্রয় হবে অতল গুহায়/ তুমি কি জানো তা কী?/ তা অতি উত্তপ্ত আগুন।

সূরা আল-ইনফিতার বা বিদীর্ণ হওয়া: ‘যখন আকাশ বিদীর্ন হবে/ যখন নক্ষত্রমণ্ডলী বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়বে/ যখন সমুদ্র বিস্ফোরিত হবে/ এবং যখন কবরসমূহ খুলে দেয়া হবে/ তখন সবাই জানবে, সে কি আগে পাঠিয়েছে এবং/ পরে কি রেখে গিয়েছে।/ হে মানুষ! কি তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্মন্ধে বিভ্রান্ত করলো?/ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে বলিষ্ঠ করেছেন/ এবং ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন।/ যে আকৃতিতে চেয়েছেন সেভাবেই তোমাকে গঠন করেছেন।/ কখনো নয়, বরং তোমরা শেষ বিচারকে মিথ্যা মনে করো/ নিশ্চয় তোমাদের আমল সংরক্ষণের জন্য রয়েছে তত্ত্বাবধায়কগণ।/ সম্মানিত লেখকবৃন্দ/ তারা জানে তোমরা যা করো।/ অবশ্যই পুণ্যবানগণ থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে/ আর পাপীরা থাকবে জাহান্নামে/ তারা কর্মফল দিবসে তাতে প্রবেশ করবে/ এবং তারা অনুপস্থিত থাকতে পারবে না।/ কর্মফল দিবস সম্মন্ধে তুমি কী জানো?/ আবার বলি, কর্মফল দিবস সম্মন্ধে তুমি কী জানো?/ সেদিন পরস্পরের জন্য কিছুই করার সামর্থ্য থাকবে না/ এবং সেদিন কর্তৃত্ব হবে শুধুই আল্লাহতালার ‘।

সূরা আল হুমাযা বা পশ্চাতে পরনিন্দা: ‘দুর্ভোগ তাদের প্রত্যেকের যে আড়ালে ও সম্মুখে মানুষের নিন্দা করে/ যে অর্থ সম্পদ জমায় এবং বারবার তা গণনা করে/ সে ধারণা করে যে, তার অর্থ-সম্পদ তাকে অমর করে রাখবে।/ কখনো নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়/ তুমি জানো হুতামা কী?/ তা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন/ যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।/ নিশ্চয় তা তাদেরকে (পাপীদের) পরিবেষ্টন করে রাখবে।/ যা দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে নির্মিত ।

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম: ‘দিনের প্রশান্তি শেষে রাত্রির চাদর ফেড়ে এলো/ ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ এই রাত্রি-লাইলাতুল ক্বদর/ ছুঁয়ে যাচ্ছে পবিত্রতা, ছুঁয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য পরশ/ ঐশী গ্রন্থের আবির্ভাবের এই রাত্রি/ ধুয়ে দিচ্ছে পাপ, অমানবিকতা/ ছুঁয়েছে আলো, ছুঁয়েছে কূল-মাখলুকাত/ নেমে আসছে জ্যোতি, নুর/ পূণ্যের প্রস্রবনে ভেসে যাচ্ছে ঘরদোর/ পৃথিবী, আকাশ ও বহ্মাণ্ড/ ভেসে যাচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি/ সমুদ্রপ্রতিম পবিত্রতায় ভেসে যাচ্ছে সব।/ আমরা তো পাপী বান্দা, তীব্র গুনাহগার/ পবিত্র রাত্রিতে আমাদের ক্ষমা করো, হে পরওয়ারদিগার !

‘বেজোড় রাত্রিতে তাকে অনুসন্ধান করো/ রহমতের আলো এসে ধুয়ে দেবে তোমাকে/ হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এই রাত্রি/ নাজাতের পথ দেখাবে’।

আল-কুরআন থেকে নেয়া কবিতায় দারুণ এক কাব্যময়তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কবি তমিজ উদদীন লোদী আরবি বাক্যরীতি অক্ষুণ্ন রেখে ভাষার সুষমায় অপূর্ব রূপ দিয়েছেন। আর এখানেই তিনি অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। সত্য ও সুন্দরকে আবিষ্কার করতে তিনি যেমন অতীতের কাছে ফিরে যান। একই ভাবে বিজ্ঞান ও কুরআন থেকে মহা সত্যকে অবলিলায় তুলে আনেন। পৃথিবীর মুক্ত চিন্তার জ্ঞাণীদের মত তিনি সাহসের সাথে এগিয়ে চলেছেন। স্থানীয় কোন বলয়ে হীনমন্যতায় হাবুডুবু খাননি। তার ভাবনার জগত মহাসগরে নিমজ্জিত। যেখানে পাঠকের সাথে রয়েছে গভীর সুরঙ্গ পথ। সেখানে আলোক রশ্মির মত দেখা মিলে কবি  তমিজ উদদীন লোদীকে।

আগুন ও পুষ্পের বাগান কবিতায় তমিজ উদদীন লোদীর কাব্য ভাবনা পাঠক অঙ্গে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। ‘আগুন জ্বলছিল, প্রজ্জ্বলিত আগুন/ দাউ দাউ আগুনে পুডছিল ক্রোধ/ পুডছিল ক্ষমতা ও রাজার আক্রোশ/ কাঠ ফাটছিল, স্ফুলিঙ্গ উড়ছিল হাওয়ায়/ এ আগুন নমরুদের আগুন/ সিনানের রাজা নমরুদ/ ঈশ্বর দ্রোহী স্বয়ং ঈশ্বর।/ পিতৃহন্তা সে ইডিপাসের মতো বিয়ে করেছিল মাতাকে/ ইব্রাহীম বললেন, ' আমার প্রতিপালক যিনি তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান'/ নমরুদ বলল , ‘ আমিও তো জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই‘/ একত্ববাদের মহিমা বর্ণনাকারি ইব্রাহীম/ নমরুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন/ প্রতিমা ভেঙে ফেলার অপরাধে তাঁকে নিক্ষেপ করা হলো অগ্নিকুণ্ডে/ দাউদাউ আগুনের ভেতর নিমেষে তৈরি হলো পুষ্পের উদ্যান/ ইব্রাহীম সহাস্যে নিরাপদে অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে এলেন/ ক্রোধে ফেটে পড়লো নমরুদ/ বললো, 'তোমার আল্লাহর যদি যথার্থই অস্তিত্ব থাকে, তবে/ তাকে আমার সাথে যুদ্ধ করার জন্য ডেকে আনো'। তার পরের কাহিনী সর্বজনবিদিত/ নমরুদ তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমে যায়/ আকাশে নিক্ষেপ করে তীর/ অত:পর নমরুদ পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয় মশক বাহিনীর কাছে/ নিজের মৃত্যুও ডেকে আনে মশক দংশনে।/ পাপ ও পতনের সমারোহে ফেটে যায় রাজার গরিমা/ ঔদ্ধত্য বিধ্বস্ত হয়, জিদের শির নত হতে থাকে ক্রমে।/ ধুলায় গড়িয়ে যায় সীমাবদ্ধ মানুষের অসীম বাসনা/ বস্তুত ঔদ্ধত‌্য ও অহংকার যুগপৎ ভেসে যায় জলে ।

আড়াল ও বহ্নি কবিতায় তমিজ উদদীন লোদীর ঐন্দ্রজালিক বিস্ময়ের প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। ‘একটি আড়াল আছে/ আড়ালের আড়ালে আরো আরো আড়াল আছে/ সেখানে সত্য থাকেন/ সত্যের বিপরীতে বসে থাকে শয়তান/ সে জাল বোনে/ সে ছিটিয়ে দেয় মধু দেয়ালে দেয়ালে/ মধু থেকে জন্ম নেয় বহ্নি/ বহ্নি থেকে প্রজ্জ্বলন হয়, পাড়া জ্বলে ওঠে’।

যাবতীয় প্রলয়ের রঙ কবিতায় তমিজ উদদীন লোদীর অনুভবী দর্শন পাঠকের  বিস্ময় ও কৌতূহল জাগ্রত করে। কবি বলেন, 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' বলা গেলে বেশ হতো। জানি পৃথিবীময় এখনো শুভ মানুষেরাই গরিষ্ঠ। শুভ্র ও সুন্দরের পূজারিরা ফুল ও প্রার্থনায় নিয়ত নিরত। নির্বাণ জেনেও কল্যাণের ব্রতে নিমিত মানুষেরা বারবার অবনত হয় আজও। নিমজ্জন জেনেও শুশ্রূষার অন্বেষণে ছুঁড়ে ফেলে যাবতীয় প্রলয়ের রঙ।/ দূষণের ভেতরেও মানুষ প্রবজ্যা। খুঁজে ফেরে স্রোতস্বিনী, নদীর উজান, স্রোত । খুঁজে ফেরে মানুষের ভেতরের অনন্ত মানুষ। নির্মোহ জীবনের প্রতিকৃতি। রেনেসাঁসের ভেতর থেকে উঠে আসা প্রচ্ছন্ন অর্জন। ঋত ও সত্যের নিয়ম।/ তবু নঞর্থক বিপ্লবের মতো মধ্যযুগ, মাফিয়া কি কোচা-নোস্ত্রার মতো হানা দেয় স্বস্তির পৃথিবীতে। প্রতিহিংসা ভয়ংকর শিল্প হয়ে ওঠে। শবদেহ গড়ায় মাটিতে। দয়া ও ক্ষমার বিপরীতে বেড়ে ওঠে ক্ষমাহীন হত্যার আয়ুধ। প্রান্তিকতা ছুঁয়ে তারা ফিরে যেতে চায় প্রস্তর যুগেরও আগে কোনো প্রাইমেট সভ্যতায় ।

কালোত্তীর্ণ কবি তমিজ উদদীন লোদীর জন্ম সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামে,  ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি। দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন। সেখানে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত।

প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে-কখনো নিঃসঙ্গ নই (কবিতা), এক কণা সাহসী আগুন (কবিতা), নানা রঙের প্যারাশূট (কবিতা), চাঁদভস্ম (কবিতা), আমাদের কোনো প্লাতেরো ছিল না (কবিতা), অনিবার্য পিপাসার কাছে (কবিতা), আনন্দময় নৈরাশ্য ও ইস্পাত মানুষেরা (কবিতা), ‘দৃশ্যকল্প ও কতিপয় রাতের রমণী’ (কবিতা), নির্বাচিত কবিতা, হ্রেষাধ্বনির বাঁকবদল (গল্প), নিরুদ্দিষ্টের জলাবর্ত (গল্প), হাডসন স্ট্রিটের সুন্দরী (গল্প) ও শতাব্দীর সেরা আমেরিকার নির্বাচিত গল্প (অনুবাদ) উল্লেখযোগ্য।  

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সময় সম্পাদক, কবি কথাশিল্পী

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;