কে এই আনারকলি?

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪.কম

ছবি: বার্তা ২৪.কম

আনারকলি যে একেবারেই কাল্পনিক চরিত্র নন, তার আরও প্রমাণ বিদ্যমান। সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও অবাস্তব চরিত্র হলে মুঘল ঘরানার বাইরের ঐতিহাসিকগণ তার নাম, ধাম, পিতৃপরিচয় লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পেতেন না। বলা হয়েছে যে, আনারকলির আসল নাম নাদিরা বেগম। কোথাও তাকে বর্ণনা করা হয়েছে শার্ফ-উন-নেসা নামে। ঐতিহাসিকরা তাকে তুর্কমেন বংশোদ্ভূত বলেছেন। যদিও কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন, তিনি পারসিয়ান ছিলেন। কারও মতে, আনারকলি ছিলেন ইতালীয় রক্ত ঐতিহ্যের অধিকারী।

প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, এক বণিক দলের সঙ্গে ইরান থেকে তৎকালীণ মুঘল রাজধানী লাহোর আসেন নাদিরা বানু। সেখান থেকে মুঘল হেরেমে। হেরেমে তার পদবি ছিল ‘কানিজ’। শব্দটি উর্দু এবং এর বহুবিধ অর্থ আছে। যেমন, নতর্কী, সেবাদাসী, মনোরঞ্জনকারী ইত্যাদি। আবার হেরেম শব্দটিও বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে। আরবি, ফারসি, তুর্কিতে ‘হেরেম’-এর প্রধান অর্থ ‘জেনানাখানা’ বা সংস্কৃতে ‘অন্তঃপুর’, আধুনিক বাংলায় ‘মহিলা মহল’ বা ‘নারী আবাসস্থল’।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: আনারকলি: রকমারি'তে প্রিঅর্ডার শুরু

কিন্তু এসব প্রকাশ্য অর্থের বাইরেও ‘হেরেম’-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়-জ্ঞাপক অর্থ রয়েছে। মুঘল অন্তঃপুর নিয়ে গবেষণাকারীরা অসংখ্য উপপত্নী, যৌনদাসীর উপস্থিতির কারণে ‘হেরেম’কে ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ বলেও শনাক্ত করেছেন। মুঘল হেরেমের আরও অনেক ‘কানিজ’ বা যৌবনবতী নারীর মতো আনারকলিও ছিলেন একজন। তবে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র। নাচে, গানে, পটিয়সী। তার গায়ের রং ডালিম বা আনারের ফুলের মতো সুন্দর ছিল। মুগ্ধ সম্রাট আকবর নিজেই তার নাম দিয়েছিলেন ডালিম ফুল বা আনারকলি।

আরও পড়ুন: রহস্যময়ী চরিত্র আনারকলি

পরিচিতির মতোই আনারকলির জন্ম-বৃত্তান্ত ও জীবন-কাহিনী সম্পর্কেও একাধিক তথ্য জানা যায়। একটি বিবরণ এমন যে, আনারকলি ছিলেন এক ইতালীয় সওদাগরের সুন্দরী কন্যা। পিতার সঙ্গে আফ্রিকার উত্তর উপকূল থেকে সওদাগরী জাহাজে তিনিও যাত্রাসঙ্গী ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। সফরের এক পর্যায়ে জাহাজ জলদস্যু কবলিত হয়। পাষ- দস্যুদল জাহাজের সবাইকে হত্যা ও লুটপাট করলেও সুন্দরী আনারকলিকে হত্যা না করে ইস্তাম্বুলের ক্রীতদাস বাজারে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে এক পতিতালয়ের মালিক তাকে কিনে নিয়ে যায় এবং পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য উপযুক্ত নৃত্য, গীত ও ছলাকলা শিক্ষা দেয়। পতিতালয়ের মালিক কিছুদিন পর আরও বেশি দামে আনারকলিকে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। সেই ব্যক্তি তাকে কিছুদিন নিজের কাছে রাখে এবং পরে নানাবিধ সুবিধা লাভের আশায় তুরস্কের সুলতানকে নজরানা দেয়। সেখানে কয়েক বছর অবস্থানের পর আনারকলিকে তুরস্কের সুলতান মুঘল সম্রাট আকবরকে উপহার স্বরূপ পাঠান।

আরও পড়ুন: কল্পনা ও ইতিহাসের ট্রাজিক নায়িকা আনারকলি

আরেকটি ভাষ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনাকারী আফগানিস্তান ছিল তৎকালে পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ। আফগানিস্তান ভূ-কৌশলগত দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম এশিয়া, পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে যাতায়াত পথের মতোই চীন হয়ে দূরপ্রাচ্যে যাওয়ার পথও আফগানিস্তান হয়েই প্রসারিত ছিল। প্রাচীন বাণিজ্য-যোগাযোগ পথ ‘সিল্ক রোড’ আফগানিস্তানকে ছুঁয়ে গিয়েছিল বলে তখনকার বিশ্বের প্রায়-সকল সমৃদ্ধ দেশের নাগরিক, ব্যবসায়ী, পর্যটকদের আনাগোনা ছিল সেখানে। তেমনই এক বিদেশি বণিক দলের কাছ থেকে আনারকলিকে সংগ্রহ করেন আফগানিস্তানের মুঘল-প্রতিনিধি এবং রাজধানীতে পাঠিয়ে দেন সম্রাট আকবরের মনোরঞ্জনের জন্য। তবে, অন্য আরেকটি মতানুযায়ী, মুঘল শাসিত উপমহাদেশ ছিল সে সময়ের বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনী ও সমৃদ্ধ দেশ, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভাগ্যান্বেষণে অসংখ্য মানুষ এসে হাজির হতেন। তেমনিভাবে নিজের পরিবার সঙ্গে কিংবা অন্য কারও মাধ্যমেমুঘল ভারতে এসেছিলেন বা আসতে বাধ্য হয়েছিলেন আনারকলি।

আরও পড়ুন: আনারকলি: মুঘল হেরেমের রহস্যময়ী নারী

তবে, ঘটনা যা-ই হোক না কেন, ঘটনাচক্রে আনারকলি মুঘল সম্রাট আকবরের হেরেমে স্থান লাভ করেন। অনেকের মতে, আকবর তাকে নিজের শয্যাসঙ্গী করেছিলেন। এ নিয়ে লেখালেখি ও নাটক রয়েছে। আবার, অধিক প্রচারিত ভাষ্য হলো, আকবর-পুত্র শাহজাদা সেলিম আনারকলির প্রেমে পড়েন। হেরেম থেকে গোপনে বাইরে এনে শাহজাদা সেলিম প্রণয়ে মত্ত হতেন এবং অভিসারেও যেতেন আনারকলিকে নিয়ে। কিন্তু সম্রাট আকবরের অনিচ্ছায় শাহজাদা সেলিম ও আনারকলির প্রেম সফল হয় নি এবং আনারকলি বিয়োগান্তর পরিণতি লাভ করেন, এটাই সর্বাধিক প্রচারিত ভাষ্য।

অন্যদিকে, অ্যালেক্স রাদারফোর্ড-এর Empire of Moghil: Ruler of the world নামক গবেষণা গ্রন্থ আরেক কথা জানাচ্ছে, যেখানে আকবর, সেলিম ও আনারকলির ত্রিভুজ প্রেমের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। অ্যালেক্স রাদারফোর্ড হলেন দুইজনের ‘পেন নেইম’ বা লেখক নাম। তারা হলেন ডায়না প্রিসটন এবং মাইকেল প্রিসটন। মুঘল ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী পশ্চিমা গবেষকদের অন্যতম এই দুইজন লেখক অ্যালেক্স রাদারফোর্ড নামে Empire of Moghil: Ruler of the world ছাড়াও মুঘল ইতিহাস বিষয়ক Empire of Moghil সিরিজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এগুলো হলো: Empire of Moghil: Raiders from North, Empire of Moghil: Brothers at Wat, Empire of Moghil: Ruler of the World, Empire of Moghil: The Tainted Throne, Empire of Moghil: The Serpent's Tooth, Empire of Moghil: Traitors in the Shadows.

তাছাড়াও মুঘল ঘটনাবলীর বিশ্বস্ত সাংস্কৃতিক বিবরণ ‘তাজমহল ট্রিলজি’র রচয়িতা ভারতীয়-আমেরিকান লেখক ইন্দু সুন্দারেসানের আখ্যানে কিছু কিছু ঘটনা বিচ্ছুরিত। ‘তাজমহল ট্রিলজি তে তিনটি গ্রন্থ রয়েছে: BOOK ONE: The Twentieth Wife, BOOK TWO: The Feast of Roses, BOOK THREE: Shadwo Princess.

কাহিনীগুলোর সূত্রপাত ইরান থেকে ভারতের পথে আগত আমত্য গিয়াস বেগের পরিবারের যাত্রাপথে। পথিমধ্যে কান্দাহারে গিয়াস-পত্নী মেহেরুন নেসা নামে এক কন্যার জন্ম দেন। গিয়াস বেগ সম্রাট আকবরের রাজদরবারে স্থান পান। তার কন্যা বিবাহ সূত্রে বিড়ম্বিত ভাগ্য বরণ করে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে জন্মের ৩৪ বছর পর নূরজাহান নামে মুঘল ভারতের সম্রাজ্ঞীর আসন লাভ করেন। এটাই প্রথম গ্রন্থের উপজীব্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রন্থে সম্রাট শাহজাহান পত্নী মমতাজ আর তদীয় কন্যা জাহানারার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। মুঘল হেরেমের অন্তরঙ্গ বিবরণ, প্রেম ও প্রণয়ের বহু ভাষ্য লিপিবদ্ধ থাকলেও আনারকলি প্রসঙ্গ বিশেষভাবে আলোচিত হয় নি। তবে, মুঘল হেরেমের বেপরোয়া জীবন, বহু নারীর দীর্ঘশ্বাস, ব্যর্থ প্রেমের বুক চাপা আর্তনাদের মধ্যে আনারকলি ও তার মতো বহু নারীই যে সকরুণভাবে আবর্তিত হয়েছিল, তা স্পষ্ট।

মুঘল ইতিহাসে রাজদরবারের মতো হেরেমের প্রসঙ্গও গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচিত হয়েছে আরও অনেকে লেখক, গবেষকের কলমে। বৃহত্তর হেরেম ছিল মুঘল রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোর নেপথ্য ক্ষেত্র। মুঘল রাজমহিলারা ক্ষমতার বিন্যাসে নিজ নিজ স্বার্থানুযায়ী গোপনে বা প্রকাশ্যে অংশ নিতেন। কেউ সফল হতেন, কেউ হতেন না। রাজরমণীর পাশাপাশি বিভিন্ন উপপত্নী, নতর্কী প্রমুখের ভূমিকাও মুঘল ইতিহাসের কোনও কোনও পর্যায়ে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আনারকলির কথা বিশেষত কেউই আলোচনা করেন নি। এহেন নীরবতার বিষয়টিও কম আশ্চর্যজনক নয়।

ইন্দু সুন্দারেসানের মতো বাংলায় আনিস সিদ্দিকী ‘মুঘল হেরেমের অন্তরালে’ নামক চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেন, যা মূলত নূরজাহানের ভাগ্যাহত জীবনের উত্থান-পতনকে কেন্দ্র করে। একইভাবে তাজমহলে শায়িতা, সম্রাট শাহজাহান পত্নী মমতাজ মহল, শাহজাহানের কন্যা জাহানারা, রওশনারা প্রমুখের কথা এসেছে।

সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারী লড়াইয়ে জাহানারা দারাশিকোহর এবং রওশানার আওরঙ্গজেবের পক্ষে ছিলেন। তখন রাজদরবারের মতোই হেরেমও ছিল ক্ষমতাচর্চার অন্যতম ক্ষেত্র। ফলে মুঘল হেরেম নিয়েও গবেষণার অন্ত নেই। যেমন, Domesticity and Power in the Early Mughal World, The Mughal Harem, A Visit to the Mughal Harem: Lives of Royal Women, South Asia, Edicts from the Mughal Harem, The Women Of Mughal Harem, The Naked Mughals: Forbidden Tales of Harem and Butchery, Mughal Harem, Mahal: Power and Pageantry in the Mughal Harem, Escape from Harem ইত্যাদি।

এসব গ্রন্থ মুঘল সাম্রাজ্যের বিবর্তনের সমান্তরালে হেরেমের উত্থান ও বিকাশ, সম্রাট আকবরের হাতে হেরেমের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গোড়াপত্তন, হেরেমের অভ্যন্তরে পাওয়ার, পলিটিক্স ও পার্সোনালিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এসেছে হেরেমের আলোকিত ও অন্ধকার নানা দিকও। বিশেষ বিশেষ কাউকে কেন্দ্র করে উপন্যাস বা আখ্যান বা কাহিনীও রচিত হয়েছে। তবে প্রায়-সকলেই আনারকলি সম্পর্কে বিশেষ কোনও আলোচনাই করেন নি। হয় তারা নীরব থেকেছেন, নয় এড়িয়ে গেছেন। যে মুঘলদের যাবতীয় বিবরণ ও আদ্যোপান্ত বর্ণনা রক্ষিত রয়েছে, সেখানে একজন উল্লেখযোগ্য রাজনতর্কী সম্পর্কে সকলের উদাসীনতাও আনারকলি সম্পর্কে আগ্রহ ও রহস্য সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট।

তদুপরি মুঘল হেরেমের বহু সম্রাজ্ঞী ও শাহজাদি রাজদরবার ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকের ভূমিকা পালন করলেও কেউই সামাজিকভাবে ও নাগরিক জনশ্রুতিতে প্রকাশিত হতে পারেন নি। এমন কোনও মুঘল রমণী নেই, যিনি হেরেমে অবস্থান করেও রাজনীতি ও রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র দেশে ও জনগণের মধ্যে আলোচিত হয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম আনারকলি। হেরেম তার অবস্থান হলেও তিনি হেরেমের চার দেওয়ালের বাইরের আলোচনায় চলে এসেছেন। ইতিহাসে চাপা পড়লেও মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীনভাবে পাখা মেলেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের বিশাল অঞ্চলের বিপুল মানুষের কাছে।